মানবিক সংকটে শ্রীলঙ্কা

জ্বালানি তেল কিনতে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে ফিলিং স্টেশনে মানুষের দীর্ঘ সারি। ছবি: রয়টার্স

'আমাদের এখন বেঁচে থাকার জন্য চাল প্রয়োজন। জ্বালানির তীব্র সংকট চলছে। আমাদের সবজি ও কম দামে ফল প্রয়োজন। রান্নার জন্য গ্যাস দরকার। আমাদের পেট্রোল, ডিজেল, কয়লা এবং গ্যাস দরকার। না হলে জীবন ধারণ করাটা অনেক কঠিন হয়ে পড়বে।'

'বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা যদি সাশ্রয়ী মূল্যে চাল পাঠান তাহলে আমরা খুবই উপকৃত হবো। এখানে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি।'

কথাগুলো বলছিলেন শ্রীলঙ্কার একটি বেসরকারি রেডিও স্টেশনের অনুষ্ঠান বিভাগের সাবেক কর্মী রুফাইদা করিম। সম্প্রতি চাকরি হারিয়ে তিনি এখন কাজ খুঁজছেন। আজ শনিবার তার সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারের কথা হয়।

রুফাইদা করিম

বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির কারণে বেশ কয়েকদিন ধরেই শ্রীলঙ্কায় খাদ্য ও জ্বালানির সংকট চলছে। জ্বালানি তেলের জন্য ফিলিং স্টেশনগুলোতে দীর্ঘ লাইন দেখা যাচ্ছে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। সংকটের মুখে কেউ কেউ দেশ ছাড়ছেন।

ভারতের দ্য হিন্দুর সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কা থেকে পালিয়ে আসা ১৬ জন তামিলনাড়ুতে আটক হয়েছেন।

আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এ বছর বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে শ্রীলঙ্কার প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে সাকুল্যে ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালেও এটা ছিল প্রায় সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার।

গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে বলেছেন, তাদের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলার।

গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, দেশটির জিডিপির ১০ শতাংশ আসে পর্যটন থেকে। গত বছর এই আয় ৬২ শতাংশ কমেছে। ২০১৯ সালে একটি চার্চে বোমা হামলা এবং করোনাভাইরাসের কারণে এই খাতে ধস নামে। তাছাড়া সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমে গেছে। সরকারি তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালে ৫৪৮ মিলিয়ন ডলার এফডিআই কমেছে। ২০১৯ সালে এফডিআই ছিল ৭৯৩ মিলিয়ন এবং ২০১৮ সালে ছিল ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার।

জ্বালানি তেল কিনতে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে ফিলিং স্টেশনে মানুষের দীর্ঘ সারি। ছবি: রয়টার্স

সংবাদমাধ্যম দ্য কুইন্টের তথ্যমতে গত ২ দশকে চীন শ্রীলঙ্কাকে সবচেয়ে বেশি ঋণ সহায়তা দিয়েছে এবং বিনিয়োগ করেছে। বর্তমানের চীনের দেওয়া ঋণের পরিমাণ ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। যা ২০২২ সালের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।

শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ও এএফপির তথ্য অনুসারে, দেশটিতে গতমাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ। জানুয়ারি মাসে এটি ছিল ১৪ দশমিক ২ শতাংশ এবং ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ছিল ১২ দশমিক ১ শতাংশ।

তবে, দেশটিতে খাবারের দাম বেড়েছে আরও বেশি। সরকারি তথ্য মতে, খাদ্য মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ ছাড়িয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে এটি ছিল ২৫ শতাংশ এবং ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ছিল ২২ দশমিক ১ শতাংশ। ৪০০ গ্রাম দুধের মূল্য শূন্য দশমিক ৯০ ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে। যা শ্রীলঙ্কার প্রায় ২৬২ রুপির সমান।

শ্রীলঙ্কায় ১৯৮৩ সালে তামিল বিদ্রোহীদের সঙ্গে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ২০০৯ সালে এই গৃহযুদ্ধ শেষ হয়। তবে তখনও শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে এতটা দুর্দিন ছিল না।

বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য মতে, ১৯৯০ সালে দেশটির জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১০ সালে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ শতাংশ। ২০১১ ও ২০১২ সালে এই হার বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ৯ দশমিক ১ শতাংশ। তারপরে থেকে জিডিপি আবার কমতে শুরু করে যা কখনো ৫ শতাংশের ওপরে উঠেনি। ২০১৮ সালে এই হার ছিল ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, ২০১৯ সালে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২০ সালে এই হার কমে দাঁড়ায় মাইনাস ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০২১ সালে এই হার ছিল মাইনাস ১ দশমিক ৫ শতাংশ।  

জ্বালানি তেল কিনতে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে ফিলিং স্টেশনে মানুষের দীর্ঘ সারি। ছবি: রয়টার্স

দেশটিতে কাগজেরও তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। কাগজ সংকটের কারণে গত সপ্তাহে প্রায় ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নিউজপ্রিন্ট সংকটের কারণে ইংরেজি সংবাদপত্র 'দ্য আইল্যান্ড' এবং সিংহলি 'দিভাইনো' ছাপা সংস্করণ বন্ধ করে দিয়েছে। অনলাইনে তারা কার্যক্রম চালাচ্ছে।

নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কাকে সিঙ্গাপুরের আদলে গড়ে তুলতে ২০০৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে মাহিন্দা রাজাপাকসের সরকার কঠিন শর্তে প্রচুর ঋণ নেয়। এই টাকায় বিলাসবহুল ভবন ও বন্দর নির্মাণ করা হয়। কিন্তু এসব খাতে কোনো বেসরকারি বিনিয়োগ আসেনি।

পরবর্তীতে শ্রীলঙ্কান প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা শ্রীসেনার ওপর এই ঋণের বোঝা চাপে। তবে তিনি পরিস্থিতি সামাল দিয়ে ওঠেন। তার সময়কালে বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার। প্রায় ৫২ বছর পরে শ্রীলঙ্কার বাজেটে উদ্বৃত্ত দেখা দেয়।

শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রদূতের বরাত দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন বলা হয়েছে, সংকট মোকাবিলায় শ্রীলঙ্কা বিভিন্ন দেশের কাছে সহায়তা চেয়েছে। ভারত সম্প্রতি শ্রীলঙ্কাকে জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় দেড় বিলিয়ন ডলারের ক্রেডিট লাইন দিয়েছে এবং চীন আড়াই বিলিয়ন ডলারের ক্রেডিট লাইন দেওয়ার কথা বিবেচনা করছে। দেশটির সরকার ক্রেডিট লাইনের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গেও যোগাযোগ করছে।

শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে একটি কাঁচাবাজার। ছবি: সংগৃহীত

রুফাইদা করিম বলেন, 'আমাদের কেরোসিন এবং নারকেল তেল দরকার। পেট্রোল ও ডিজেলের অভাবে আমাদের বিদ্যুৎ সংকট চলছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালাতে পেট্রোল এবং ডিজেল প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে জ্বালানি সরবরাহ করা হলে নাগরিকদের পরিবহনে জন্য ডিজেল-পেট্রোল থাকবে না।'

'আমাদের পরিবহন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ট্রেনে কয়লা দরকার। এটিরও সংকট রয়েছে।'

শ্রীলঙ্কায় চালের দাম দিগুণ বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'ভালো মানের ১ কেজি চাল কিনতে প্রায় ৫০০ থেকে ৫৫০ রুপির মতো লাগছে। নিম্ন মানের চাল কিনতেও ২০০ রুপির মতো লাগছে। কৃষকদের ফসল উৎপাদনের জন্য সার প্রয়োজন। আমাদের সারের সংকট রয়েছে।'

শ্রীলঙ্কার বহুমূখী সংকটের কথা তুলে ধরে তিনে বলেন, 'আমাদের রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট মেরামত করা খুব জরুরি।'

Comments

The Daily Star  | English

Lease land, grow your own veggies, grains

It all began with a surprise addition to lunch -- long bean mash.

16h ago