সাইবার হামলা থেকে যেভাবে ঘটতে পারে পারমাণবিক যুদ্ধ
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে না নামলেও পশ্চিমা শক্তিগুলো একজোট হয়ে কূটনৈতিক ও বাণিজ্য যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই পারমাণবিক হামলার কথা আলোচনায় এলেও এখন সেসব ছাপিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সাইবার যুদ্ধ। ইউক্রেন ও রাশিয়ার সাইবার যুদ্ধ কীভাবে পারমাণবিক যুদ্ধে গড়াতে পারে তা নিয়ে আলোচনার আগে কিছু প্রাসঙ্গিক কথা।
২০১৫ সালে রাশিয়ার হ্যাকারদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের বিদ্যুৎ গ্রিড ব্যবস্থায় সাইবার হামলার অভিযোগ উঠে। এর প্রায় দুই বছর পর ইউক্রেনের একটি অ্যাকাউন্টিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে কুখ্যাত 'নোটপেটিয়া' (NotPetya) ম্যালওয়্যার ছড়ানোর অভিযোগ উঠে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। এই ম্যালওয়্যার খুব দ্রুত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এতে বিশ্বের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়।
নোটপেটিয়া হামলার পর বলা হচ্ছিল ইউক্রেন রাশিয়ার সাইবার যুদ্ধের 'পরীক্ষার ক্ষেত্র'। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইউক্রেনের সরকারি দপ্তর ও বিভিন্ন সংস্থাকে লক্ষ্য করে সাইবার হামলা হয়। ইউক্রেনও রাশিয়ার বিভিন্ন ওয়েবসাইটে হামলা চালায়। এই যুদ্ধে পাশ্চাত্যের দেশগুলো ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ায় বিশ্বব্যাপী একটি সাইবার যুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি হয়।
বিংশ শতকের ইতিহাস
গত শতাব্দীর দুই বিশ্বযুদ্ধের পর কোরিয়া যুদ্ধ, আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধসহ আরও বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ হয়েছে। এতে বিংশ শতাব্দী একটি যুদ্ধের শতক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই শতকের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়ংকর ও বিধ্বংসী যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই যুদ্ধের পরে বিশ্ব রাজনীতিতে ইউরোপের একক আধিপত্য আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। এর মধ্যে আমেরিকা প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যানের নির্দেশে জাপানের দুই শহরে পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়। এরপর আর কারও বিরুদ্ধে এই মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি, যদিও সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
পার্শ্ববর্তী ভারত-পাকিস্তানসহ এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৮টি দেশ পারমাণবিক শক্তিধর হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক পারমাণবিক বোমাগুলো আছে রাশিয়া ও আমেরিকার হাতে। এগুলোর কয়েকটার বিস্ফোরণেই পুরো বিশ্ব ধোঁয়া আর ধুলায় ঢেকে যাবে, আড়ালে চলে যাবে সূর্য। উৎপাদন করা যাবে না খাবার। অর্থাৎ, পৃথিবীতে প্রাণীদের টিকে থাকাই হুমকিতে পড়বে। এই পরিণতির কথা চিন্তা করে পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো বেশকিছু চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যেখানে এই অস্ত্র ব্যবহারে বিরত থাকার কথা বলা আছে। তবে অনেক দেশ সেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি বা করলেও পরে বেরিয়ে এসেছে।
বিংশ শতকের শেষ দিকে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা কমতে শুরু করে। ১৯৫২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ছোট-বড় মিলিয়ে শতাধিক পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর বেশিরভাগ ছিল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে, নয়তো অস্ত্র পরীক্ষা চালানোর কারণে। ১৯৮৬ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের চেরনোবিলের দুর্ঘটনা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, এখনো সেখানে মানুষ বাস করতে পারে না। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন থেকে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা স্তিমিত হতে থাকে।
কিন্তু, পারমাণবিক যুদ্ধের সেই উত্তেজনা আবারও ফিরে এসেছে। ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়া-ন্যাটোর পাল্টাপাল্টি হুমকিতে আবারও স্নায়ুযুদ্ধের স্মৃতি ফিরে আসছে। সম্প্রতি পুতিন তার দেশের পারমাণবিক শক্তিকে বিশেষ সতর্ক অবস্থায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। যদিও এই অস্ত্রের ব্যবহারের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে, পাহাড়সম অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাশিয়াকে একঘরে করার চেষ্টার পরিণতি কী হবে তা অনুমান করা কঠিন। সরাসরি পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা কম থাকলেও সাইবার হামলার পরিণতি পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
সাইবার হামলায় রাশিয়ার শক্তিমত্তা আগেই প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি সিএনএন জানায়, রাশিয়া ইউক্রেনে হামলার পরেই মার্কিন সরকার তাদের বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির প্রতি উচ্চ সতর্কতা জারি করেছে। গত কয়েক বছরের মধ্যে দেশটিতে যে কয়টি সাইবার হামলা হয়েছে তার অধিকাংশই ছিল রাশিয়ান হ্যাকারদের কাজ। ফলে, রাশিয়ান হ্যাকারদের সক্ষমতা সম্পর্কে আমেরিকার স্পষ্ট ধারণা আছে।
সাইবার যুদ্ধ কি?
কোনো ওয়েবসাইট বা নেটওয়ার্কে প্রবেশ করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নেওয়া বা অকেজো করে ফেলাই হলো সাইবার হামলা। আক্রান্ত দেশটি পাল্টা হামলা চালালেই সেটা পরিণত হয় সাইবার যুদ্ধে। বর্তমান বিশ্বের প্রায় সবকিছুই ইন্টারনেটভিত্তিক, উন্নত দেশগুলোর অধিকাংশ কার্যক্রম পরিচালিত হয় ডিজিটাল পদ্ধতিতে। ফলে, এসব দেশের বিভিন্ন কোম্পানি, সরকারি-বেসরকারি, সামরিক-বেসামরিক সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা নথি চুরি করতে এখন আর সেখানে উপস্থিত থাকতে হয় না, দূরে বসেই হ্যাকাররা হাতিয়ে নিতে পারে সব নথি।
প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন ডিভাইস, ওয়েবসাইটে স্থাপন করতে পারে বিভিন্ন ম্যালওয়ার, র্যানসামওয়্যার, ফিশিংসহ ক্ষতিকর প্রোগ্রাম।
দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, ২০২১ সালের জুলাই মাসে অন্তত দেড় হাজার প্রতিষ্ঠান রাশিয়াভিত্তিক 'রেভিল' হ্যাকারদের হামলার মুখে পড়ে। তার দুই মাস আগে 'ডার্ক সাইড' নামে আরেক রাশিয়ান হ্যাকার দলের হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের কলোনিয়াল পাইপলাইন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ওই হ্যাকারদের বিরুদ্ধে তখন আমেরিকার বহু প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, সরকারি দপ্তর, সামরিক অফিস, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বহু প্রতিষ্ঠানে হামলার অভিযোগ ওঠে। সাইবার হামলায় আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি প্রাণহানির ঘটনার কথাও তখন জানা গিয়েছিল।
সাইবার হামলার প্রকারভেদ
হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ বলছে, সাইবার হামলা দুই ধরনের হতে পারে: প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ।
পরোক্ষ হামলা
এই পদ্ধতিতে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা তার কম্পিউটারকে পৃথকভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হয় না। এখানে একটি দেশ বা অঞ্চলের পাওয়ার গ্রিড, সাপ্লাই চেইন, ব্যাংকিং সিস্টেম, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট, যোগাযোগ কিংবা পরিবহন ব্যবস্থাকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়। এগুলো রক্ষা করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির কিছু করার থাকে না। কিন্তু, বিদ্যুৎ, খাবার, পানি এবং নগদ টাকা ছাড়া কে কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবে?
প্রত্যক্ষ হামলা
সরাসরি বলতে এখানে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো বোঝানো হচ্ছে। যেমন: একটা দেশের সামরিক প্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান। কোনো যুদ্ধে একটা পক্ষের প্রধানকে লক্ষ্য করে হামলা চালালে, তা যুদ্ধের হিসাব নিকাশ পাল্টে দেবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি তাদের কম্পিউটারের সমস্ত ডাটা চুরি হয় বা মুছে ফেলা হয়, কিংবা তাদের ডিভাইসগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়া হয় তাহলে এর পরিণতি যুদ্ধের ফলাফল পাল্টে দিতে যথেষ্ট।
কীভাবে সাইবার হামলা পারমাণবিক যুদ্ধ ঘটাতে পারে?
প্রাসঙ্গিক ছোট্ট একটা ঘটনা বলা যাক, সালটা ছিল ১৯৮৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর, বিশ্ব যেদিন একটা পারমাণবিক যুদ্ধের খুব কাছে চলে গিয়েছিল। স্নায়ুযুদ্ধের চরম উত্তেজনাকর এক সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণের পূর্ব সতর্কীকরণ ব্যবস্থার জন্য নিয়োজিত স্ক্রিনে বড় লাল অক্ষরে ভেসে ওঠে 'লঞ্চ' শব্দটি। সেই কম্পিউটার স্ক্রিনে প্রথমে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে সোভিয়েতের দিকে একটি আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়েছে, একটি থেকে খুব দ্রুতই সংখ্যাটা ৫টিতে পরিণত হয়। অর্থাৎ কি না, সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ধেয়ে আসছে পারমাণবিক অস্ত্রসহ ৫টি ক্ষেপণাস্ত্র! সেই নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দায়িত্বে থাকা সোভিয়েত কর্মকর্তা কম্পিউটার স্ক্রিনের ওপর বিশ্বাস করেনি, অপেক্ষা করেছে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিশ্চয়তার জন্যে। তার এই বিচক্ষণতা ছিল বিরলতম ও অনেক দুঃসাহসী আচরণের উদাহরণ। বিশেষ করে সেই সময়ের তেমন পরিস্থিতিতে একজন সোভিয়েত কর্মকর্তার পালটা হামলা চালানোর কোনো বিকল্প ছিল না।
সেই যাত্রায় সোভিয়েত কর্মকর্তার বিচক্ষণতা রুখে দিয়েছিল একটা ভয়ংকর পারমাণবিক যুদ্ধ। সূর্যের আলোতে রাডারের ভুলে যে ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে চলেছিল, তা একাই থামিয়ে দিয়েছিলেন স্ট্যানিস্লাভ পেত্রভ নামের সেই কর্মকর্তা। কিন্তু বিশ্বকে বাঁচানো পেত্রভ নিজ দেশেই হয়েছিলেন অপমান-অবজ্ঞার শিকার। এমনকি তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তও করা হয়েছে। অর্থাৎ, গল্পটা বলার মূল কারণ হচ্ছে, যন্ত্রের প্রতি নির্ভরশীলতা কতটা ভয়ংকর পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে তা তুলে ধরা। কারণ, প্রযুক্তি নির্ভর বর্তমান বিশ্বে অস্ত্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রনির্ভর।
বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণসহ পুরো প্রক্রিয়া কম্পিউটার এবং অন্যান্য ডিজিটাল ব্যবস্থার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। সাইবার আক্রমণের জন্য এগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ৷ প্রতিটি পরমাণু অস্ত্র, প্রাথমিক সতর্কীকরণ রাডার, লঞ্চিং কম্পাউন্ডের সমন্বয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অর্থাৎ, এসব পারমাণবিক ফ্যাসিলিটিগুলো মূলত যোগাযোগ এবং ডাটা-প্রসেসিং সিস্টেমের একটি বর্ধিত নেটওয়ার্ক, যা সাইবারস্পেসের ওপর নির্ভরশীল। যা সক্রিয় করার নিয়ন্ত্রণ থাকে একটি দেশের শীর্ষ কর্মকর্তা, বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীদের হাতে। আর শত্রুদেশের কোনো হ্যাকারগোষ্ঠী যদি এই সাইবারস্পেস কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানদের ডিভাইসের নিয়ন্ত্রণ পেয়ে যায় তাহলে ঘটে যেতে পারে মারাত্মক কোনো ঘটনা, যদিও এসব বিষয় আরও জটিল। তবে, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর এসব অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ যদি সাইবার আক্রমণকারীর হাতে চলে যায় তাহলে কী ঘটতে পারে তা এখনও অনুমান করা সম্ভব না।
সম্প্রতি, পাকিস্তানের ভূখণ্ডে আঘাত হানা ভারতের সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের কথাই ধরা যাক। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ক্ষেপণাস্ত্রটি দিক পরিবর্তন করে ভারতের হরিয়ানা থেকে পাকিস্তানে আঘাত হানে। দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক শক্তিধর এই দেশ দুটোর বৈরিতা কারও অজানা নয়। যদি কোনো সাইবার অপরাধী ইচ্ছাকৃতভাবে এমন ঘটনা ঘটায় তাহলে এর পরিণতি অনুমান করা কঠিন কিছু না।
তথ্যসূত্র:
সিএনএন, হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ, দা ওয়াশিংটন পোস্ট, বিবিসি, টাইমস, ভক্স ও আল জাজিরা।
Comments