উন্নয়নের তেল ও স্যালাইন তত্ত্ব

বলা হয়, প্রয়োজনই আবিষ্কারের জননী। সেই ধারাবাহিকতায় এবার একজন প্রান্তিক হোটেল ব্যবসায়ী ‘আবিষ্কার’ করেছেন কীভাবে সয়াবিন তেল সাশ্রয় করতে হয়। বাজারে সয়াবিন তেলের দাম নিয়ে যখন নাগরিকদের মনে নানা প্রশ্ন—তখন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত একটি ভিডিও সেই আলোচনার আগুনে ঘি ঢেলেছে।

বলা হয়, প্রয়োজনই আবিষ্কারের জননী। সেই ধারাবাহিকতায় এবার একজন প্রান্তিক হোটেল ব্যবসায়ী 'আবিষ্কার' করেছেন কীভাবে সয়াবিন তেল সাশ্রয় করতে হয়। বাজারে সয়াবিন তেলের দাম নিয়ে যখন নাগরিকদের মনে নানা প্রশ্ন—তখন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত একটি ভিডিও সেই আলোচনার আগুনে ঘি ঢেলেছে।

ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, তেল সাশ্রয়ের জন্য ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার মথুরাপুর বাজারের ব্যবসায়ী আব্দুল হামিদ সয়াবিন তেলের বোতল ঝুলিয়ে সেই বোতলের সঙ্গে যুক্ত করেছেন স্যালাইনের পাইপ—যাতে করে পাইপ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় তেল পরোটা ভাজার কড়াইয়ে পড়ে।

কেন এই পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, বাজারে তেলের দাম চড়া, তাই এমন কৌশল নিয়েছেন। পাল্টা প্রশ্ন, তেল ছাড়াও তো পরোটা ভাজা যায়। আব্দুল হামিদ বলেন, অধিকাংশ মানুষই তেল ছাড়া পরোটা খেতে চান না। আবার পরোটার দাম বাড়িয়ে দিলেও ক্রেতারা ক্ষুব্ধ হন। ফলে পরোটার দাম না বাড়িয়ে কীভাবে ক্রেতাদের সন্তুষ্ট রাখা যায়, সে বিষয়ে তাকে চিন্তা করতে হয়েছে।

আব্দুল হামিদের এই আবিষ্কারের প্রশংসা করতে হয়। যদিও এই আবিষ্কার নতুন করে কিছু প্রশ্নেরও জন্ম দিয়েছে যে চারিদিকে এত এত উন্নয়ন এবং এত এত নিয়ন্ত্রণের পরেও নিত্যপণ্যের বাজার কেন অনিয়ন্ত্রিত? কেন ব্যবসায়ীরা চাইলেই যেকোনো পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে পারছেন? যখন মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি নিয়ে চারিদিকে প্রশংসার রোল, তখন কম দামে পণ্য কিনতে টিসিবির লাইনে কেন ভিড় বাড়ছে? কেন সেই লাইনে মুখ ঢেকে দাঁড়াচ্ছে মধ্যবিত্ত?

প্রসঙ্গত, তেল সাশ্রয়ের এই অভিনব পদ্ধতিকে 'বৈজ্ঞানিক তেলতন্ত্র' হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা। আবার এই 'তেলতত্ত্ব' বা 'তেলতন্ত্র' নিয়ে সিরিয়াস আলোচনার বাইরে কিছু রসিকতাও হচ্ছে। যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এসব রসিকতা ছাড়িয়ে গেছে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনের একটি সংবাদে একজন বয়স্ক পুরুষের কান্নার ভিডিও।

পেশায় নৈশপ্রহরী। বেতন ৯ হাজার টাকা। ছেলেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সামান্য আয়ে সংসার চলে না। ফলে রাতে নৈশপ্রহরীর কাজ করলেও দিনে রিকশা চালান ওই বাবা। তারপরও জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়েছে, তাতে টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে অকপটে, মুখ না ঢেকেই নিজের সংকটের কথা বলেছেন। কোন পর্যায়ে গেলে একজন বয়স্ক পুরুষ ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে কান্না করেন, সেটি বোঝার মুরদ আমাদের রাষ্ট্রের আছে কি না—সেই প্রশ্ন তোলাও বিপজ্জনক। কারণ ভোজ্যতেলের দাম বাড়লেও নানাবিধ জাগতিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া এবং বিবিধ ভয় এড়াতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে বিরাট জনগোষ্ঠী অব্যাহতভাবে তেল দিতে ব্যস্ত, তাদের কাছে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির ইস্যুতে এইসব জনপ্রতিক্রিয়া সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধিতা কিংবা রাষ্ট্রকে বিব্রত করার সামিল।

অতএব, একজন পঞ্চাশোর্ধ মানুষ যদি সংসারের খরচ মেটাতে ব্যর্থ হয়ে ক্যামেরার সামনে কান্না করেন, সেটিকেও ষড়যন্ত্র বলে আখ্যা দেওয়ার মানুষের অভাব নেই।

একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী অভিযোগ করেছেন, বিএনপির ব্যবসায়ীরা নিত্যপণ্য মজুদ করে দাম বাড়িয়ে বাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করেন। এটা খুবই ভালো পর্যবেক্ষণ। তার মানে সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে, কোন কোন ব্যবসায়ী কোন কোন পণ্য কোথায় কীভাবে মজুদ করে কোন প্রক্রিয়ায় দাম বাড়াচ্ছেন। যদি তা-ই হয়, তাহলে ওই দুষ্কৃতিকারীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না কেন এবং তাদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না কেন—সেই প্রশ্নও নাগরিকদের মনে রয়েছে। দ্বিতীয় প্রশ্ন, যে দলটি গত প্রায় ১৬ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে; অনেকটা নেতৃত্ব শূন্যতায় যে দলটি বিপর্যস্ত; যে দলের নেতাকর্মীদের বড় অংশই সারাক্ষণ গ্রেপ্তার আতঙ্কে থাকেন; সেই দলের ব্যবসায়ীরা যদি এখনও বাজারে গোলযোগ সৃষ্টির ক্ষমতা রাখেন, তাহলে সেই ব্যর্থতা কার?

গত ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেল নেক্সাস টেলিভিশনে নারী উদ্যোক্তা মেলায় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ উন্নয়নের একটি সুন্দর সংজ্ঞা দিয়েছেন। তার মতে, 'উন্নয়ন শুধু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়। আমরা অনেক টাকা আয় করলাম, ব্যাংকে রাখলাম, গাড়ি কিনলাম, বাড়ি বানালাম—এগুলো উন্নয়ন নয়। উন্নয়ন হচ্ছে একটি সংস্কৃতি। আমরা কীভাবে চলাফেরা করি, কীভাবে কথা বলি, কীভাবে কাজ করি, কীভাবে সবাইকে সম্পৃক্ত করি এবং সবাইকে নিয়ে কীভাবে আমরা এগিয়ে যাই—সেগুলোই উন্নয়ন। সবাইকে সম্পৃক্ত করা না গেলে প্রকৃত উন্নয়ন হয় না। কাউকে পেছনে ফেলে টেকসই উন্নয়ন হয় না।'

অতএব পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মাথাপিছু আয় প্রায় ২ হাজার ৬০০ ডলার, রাস্তায় কোটি টাকা দামের ব্র্যান্ড নিউ গাড়ির সারি, অভিজাত শপিংমল ও তারকা হোটেলে ক্রেতার ভিড় নিঃসন্দেহে উন্নয়নের সূচক—কিন্তু প্রশ্ন হলো সেই উন্নয়ন সবাইকে নিয়ে হচ্ছে কি না? কত শতাংশ মানুষ আমোদে থাকলেন আর বাকি কত শতাংশকে স্যালাইনের পাইপ দিয়ে তেল ঢালতে হচ্ছে, সেই অনুপাতটা খুব জরুরি। উন্নয়ন নিশ্চয়ই ১০ শতাংশ মানুষের জন্য নয়। উন্নয়নের সুফল যদি রাষ্ট্রের প্রান্তিক মানুষকে স্পর্শ না করে; টিসিবির লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে যদি মধ্যবিত্তেরও মাথা নিচু হয়ে যায়, তাহলে সেই মাথাপিছু আয়ের ২ হাজার ৬০০ ডলার কোনো অর্থ বহন করে কি না—সেই প্রশ্নটাও জরুরি।

তবে বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট এবং এ নিয়ে নাগরিকদের মনে ক্ষোভ থাকলেও জাতীয় জীবনে তেলের যে কোনো সংকট নেই তা প্রতিনিয়ত টেলিভিশনের টকশো এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখ রাখলে স্পষ্ট হয়। সমস্যা হলো, এই তেল দিয়ে রান্না করা যায় না। আবার এই তেল যেহেতু বোতলজাত নয় এবং বাজার থেকে কিনতে হয় না, বরং এই তেল মানুষের মগজপ্রসূত—ফলে বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট যতই ঘনীভূত হোক না কেন, প্রশ্নহীন নিঃশর্ত আনুগত্যের সমাজে এই তেলের কখনো অভাব হয় না।

বস্তুত উন্নয়নের বহির্কাঠামো দেখেই আমাদের খুশি থাকতে বলা হয়। সেতু নির্মাণের ব্যয় কেন বছর বছর বাড়বে; পৃথিবীর যেকোনো দেশের তুলনায় আমাদের দেশে সড়ক নির্মাণ ব্যয় কেন বেশি হবে; সেই সড়ক নির্মাণের ১ বছর পরেই কেন তার চামড়া উঠে যাবে; অবৈজ্ঞানিক কালভার্ট নির্মাণের মধ্য দিয়ে আমাদের ছোট ছোট নদীগুলো কেন খুন করা হবে; লাখ লাখ টাকা খরচ করে সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করে সংযোগ সড়ক না দিয়ে সেগুলো কেন অব্যবহৃত ফেলে রাখা হবে; ফসলের ক্ষেতের মধ্যে অপ্রয়োজনে কেন কালভার্ট নির্মাণ করা হবে; ফসলের জমি উজাড় করে কল-কারখানা গড়ে তোলার ফলে ২০ বছর পরে দেশের খাদ্য চাহিদা যখন আরও এক-দেড়গুণ বেড়ে যাবে, তখন পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য দেশে উৎপাদন করা সম্ভব হবে কি না; ফসলের জমি ও নদীর জমি সুরক্ষায় কঠোর আইন প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা কতটুকু রয়েছে—ইত্যাদি প্রশ্ন করলে আপনি উন্নয়নবিরোধী।

রাষ্ট্র চায় নাগরিকরা বিনা প্রশ্নে সকল উন্নয়ন মেনে নেবে। কিন্তু সেই উন্নয়ন করতে গিয়ে জনগণের পয়সার কত শতাংশ লুটপাট হলো; লুটের টাকা স্থানীয় মাস্তান, ঠিকাদার, প্রকৌশলী, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের কোন স্তর পর্যন্ত পৌঁছালো এবং এই লুটের টাকা দিয়ে কীভাবে বিদেশে সেকেন্ড হোম এবং বেগম পাড়া গড়ে তোলা হলো—সেইসব প্রশ্ন করা যাবে না। রাষ্ট্র চায় প্রশ্নহীন আনুগত্য। ফলে কেউ যদি সত্যি সত্যিই স্যালাইনের পাইপে সয়াবিন তেল দিয়ে পরোটা ভাজেন, সেখানে তার এই সাশ্রয়ী মানসিকতার প্রশংসা না করে এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে বরং তিনি উন্নয়ন ও সরকারবিরোধী কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ কি না—সেটি খোঁজা হবে।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Sheikh clan’s lust for duty-free cars

With an almost decimated opposition and farcical elections, a party nomination from the ruling Awami League was as good as a seat in the parliament.

4h ago