‘সব ছেড়ে বাঁচার জন্য ছুটছি’- ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় কিয়েভের বাংলাদেশিরা

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে অবস্থানরত খালেদ, আওয়াল ও সন্তানসহ মোহন। ছবি: সংগৃহীত

সন্তানকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তানিয়া খাতুন ভোর ৪টার দিকে ঘুমাতে যান। কিছুক্ষণ পরেই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তার। 'আরও কয়েকটি বিস্ফোরণের শব্দে আমরা নিশ্চিত হলাম যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ঘর কেঁপে উঠছিল। ভয়াবহ শব্দ।'

ইউক্রেনে রুশ বাহিনী হামলা শুরুর কয়েক ঘণ্টা পর রাজধানী কিয়েভে অবস্থানরত বাংলাদেশি তানিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে ফোনে এ কথা বলছিলেন।

তানিয়ার স্বামী মেহেদী হাসান মোহন ২ দশকেরও বেশি সময় ধরে ইউক্রেনে বসবাস করছেন। তিনি দ্য স্টারকে বলেন, 'আমরা কী করব বুঝতে পারছিলাম না। কখনো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি। শহরে সতর্কতার সাইরেন বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমরা পোল্যান্ডের সীমান্তবর্তী শহরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। আশঙ্কা করছি রাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।'

চল্লিশোর্ধ্ব মোহন এক সময় উচ্চশিক্ষার জন্য ইউক্রেনে গিয়েছিলেন এবং এখন কিয়েভে বেশ কয়েকটি দোকানের মালিক তিনি।

ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরু হওয়ার পর রাজধানী কিয়েভ ছাড়তে শুরু করে বাসিন্দারা। ছবি: রয়টার্স

বাইরে রাস্তার পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, 'সাইরেন বাজার পর হাজার হাজার লোক শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করেন। গাড়িগুলো যখন এক্সপ্রেসওয়েতে যানজটে পড়ে, তখন অনেকে গাড়ি থেকে নেমে হামাগুড়ি দিয়ে আগাতে থাকেন।'

ফিলিং স্টেশনগুলোতে আতঙ্কিত বাসিন্দাদের ভিড় দেখে মোহন ভাবছিলেন যে গাড়িতে থাকা তেলে ৯০০ কিলোমিটার দূরে পোল্যান্ডের সীমানা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবেন কি না।

তিনি বলছিলেন, 'সবকিছু রেখে চলে যাচ্ছি। বাড়ি, ব্যবসা, গাড়ি সব রেখে যাচ্ছি। যদি বেঁচে থাকি, তাহলে ফিরে এসে বাঁচার নতুন লড়াই শুরু করতে হবে।

ডেইলি স্টার কিয়েভে বসবাসরত পাঁচ বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলেছে।

তাদের মধ্যে তিন জন জানান যে তারা পোল্যান্ড সীমান্তের দিকে যাচ্ছিলেন এবং বাকি দুই জন জানান যে তারা কিয়েভে নিরাপদ অবস্থানে যাচ্ছেন।

ইউক্রেনে বর্তমানে বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস বা কনস্যুলেট না থাকায়, পোল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাস ইউক্রেনের ডি-ফ্যাক্টো কূটনৈতিক মিশন হিসেবে কাজ করে।

ইউক্রেনে কত বাংলাদেশি বসবাস করে তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে বাংলাদেশি প্রবাসীরা জানিয়েছেন, সেখানে প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষার্থী আছে যাদের প্রায় ৫০০ জন কিয়েভে থাকেন।

৪৫ বছর বয়সী আবদুল আওয়াল প্রায় ২৫ বছর ধরে ইউক্রেনে বসবাস করছেন। সেখানে শিক্ষাজীবন শেষ করে, দেশটির স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কিয়েভের পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। আমরা আমাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়েছি এবং পোলিশ সীমান্তে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি।'

বাংলাদেশে আওয়ালের ঠিকানা সাভারের হেমায়েতপুর। তিনি জানান, 'এখানে আমার একটা ব্যবসা আছে। আমি একটা ছোট দোকান চালাই। কিন্তু এ মুহূর্তে জীবন বাঁচাতে হবে সবার আগে।'

দুই মেয়ের বাবা আওয়াল বলেন, 'এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া আমার জন্য বেদনাদায়ক। সামনের জীবনটা অনিশ্চিত। ঘর ছেড়ে যেতে হচ্ছে। আমি জানি না আমাদের জন্য সামনে কী আছে। তবে, নিরাপদ জায়গায় পালিয়ে যাওয়া ছাড়া এখন আমার সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।'

টাঙ্গাইলের খালেদ হাসান খান ৩৮ বছর ধরে কিয়েভে বসবাস করছেন। সেখানে তার সঙ্গে আছেন স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েরা।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সকালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট সামরিক আইন জারি করেন। তিনি জনগণকে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেন। নাগরিকদের বাড়িঘর ছেড়ে না যাওয়ার জন্য বলেন। কিন্তু সবাই নিরাপদ স্থানে যাওয়ার জন্য রাস্তায় ভিড় করছে।'

'আমি (ইউক্রেন) ছাড়ছি না। আমি প্রায় ৪০ বছর ধরে এই দেশে আছি। এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে এই দেশের মানুষকে ছেড়ে যেতে পারব না। সবার যা হয় আমারও তাই হবে। সবাই মরলে আমিও মরব,' বলেন তিনি।

খালেদ জানান, প্রতিটি এলাকায় কিছু আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। তিনি পরিবারসহ সেখানে যাবেন।

তিনি বলেন, 'অনেকের বৈধ কাগজপত্র না থাকায় যেতে পারবে না। তারা এখানে উদ্বাস্তু হিসেবে বসবাস করছে।'

ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার আগে তিনি বলেন, 'ভাই, আমাদের জন্য দোয়া করবেন।'

Comments

The Daily Star  | English
High tax expenditure in Bangladesh

Vat, Tax hikes: Short-sighted state policies to hurt people

The current high level of inflation has already placed significant financial pressure on the common people, and increasing taxes in this context will create even more strain

13m ago