টিসিবির ট্রাকসেল পয়েন্টে বাজারদরে ‘অতিষ্ঠ’ মানুষের ভিড়

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, সকাল সোয়া ১১টা। রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে টিঅ্যান্ডটি মাঠ সংলগ্ন যাত্রী ছাউনির কাছে আলাদা সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অন্তত ২০০ নারী-পুরুষ। লাইনে কে কার আগে দাঁড়াবেন তার জন্য তারা নিজেরাই সিরিয়াল ঠিক করে নিচ্ছেন। এ নিয়ে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়তেও দেখা গেল কাউকে কাউকে। কিন্তু যার জন্য এই অপেক্ষা, সেই টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) পণ্য বিক্রয়কারী ট্রাকের দেখা তখনো মেলেনি।

রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে টিঅ্যান্ডটি মাঠ সংলগ্ন যাত্রী ছাউনির কাছে টিসিবির ট্রাকের অপেক্ষায় থাকা মানুষ। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে অর্থনৈতিকভাবে কাবু হয়ে গেছে সীমিত আয়ের মানুষ। আয় বাড়েনি, কিন্তু জীবনযাপনের ব্যয় বেড়েছে। সংসার চালাতে হিমশিম অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো।

এ অবস্থায় বাজারমূল্যের থেকে খানিকটা কম দামে টিসিবির ট্রাক থেকে খাদ্যপণ্য কিনতে প্রতিদিন অনেক মানুষকে ভিড় করতে দেখা যায় নির্দিষ্ট পয়েন্টগুলোতে। আগে এই সেলিং পয়েন্টগুলোতে সাধারণত নিম্ন আয়ের মানুষের ভিড় বেশি চোখে পড়ত। কিন্তু করোনাকালে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই চিত্র অনেকটা পাল্টেছে।

বিভিন্ন সময়ে সমাজের বিদ্যমান অসংগতিগুলোকে কথায়-গানে তুলে ধরা শিল্পী কবীর সুমন 'ঘরে ঘরে হানা দেওয়া' এই বাজারদরের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে লিখেছিলেন, 'থলি হাতে যায় লোকে অলিতে-গলিতে/জীবন আসলে বাঁধা পাকস্থলীতে'।

এই 'পাকস্থলীতে বাঁধা' জীবনকে টেনে নিতে এখন টিসিবির ট্রাকের লাইনে অনেক 'ভালো পোশাক' পরা সুবেশ মধ্যবিত্তের দেখাও মিলছে।

এমন একজনকে পাওয়া গেল মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তিনি চাকরি করেন বিটিসিএলের (বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড) টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনে। বর্তমানে দুর্মূল্যের বাজারে সীমিত বেতনে দিন চলা দায়। এ অবস্থায় খানিকটা সাশ্রয়ের জন্য অফিসে হাজিরা দিয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে তিনি টিসিবির ট্রাকের লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন।

দ্য ডেইলি স্টারকে ওই নারী বলেন, 'এখান থেকে যে পরিমাণ পণ্য আমি কিনব, তাতে আমার সর্বোচ্চ ২০০ টাকা সাশ্রয় হবে। এটাই আমার জন্য অনেক।'

কথা হয় কাছাকাছি জায়গায় আলাদা সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা মুজিবুর রহমান নামের আরেক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি জানান, টিসিবির ট্রাক থেকে ৫৫০ টাকার পণ্য নেওয়ার জন্য তিনি সকাল পৌনে ৯টার দিকে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। এই টাকায় ২ লিটার তেল, ২ কেজি চিনি, ২ কেজি ডাল ও ৩ কেজি পেঁয়াজ পাওয়া যাবে।

কলাবাগান এলাকার বাসিন্দা মুজিবুর রহমানের মালিকানায় ৪/৫টি রিকশা আছে। এগুলো ভাড়া দিয়েই তার সংসার চলে। হতাশ কণ্ঠে ওই ব্যক্তি বলেন, 'কোনোদিন ট্রাক আসে ১০টায়। কোনোদিন ১১টায়। কোনোদিন আসেই না। টাইমের কোনো ঠিক-ঠিকানা নাই।'

একই জায়গায় লাইনের বাইরে কিছুটা 'দলছুট' অবস্থায় পাওয়া গেল মো. হাসান নামের (৫৫) নামের একজনকে। ফুটপাতে পা ঝুলিয়ে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন তিনি। জানালেন, মহামারির আগে তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। এখন 'টুকটাক' ব্যবসা করেন। ট্রাকের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হাসান বলেন, '১০০ ট্যাকা লাভের লাইগা যতক্ষণ এইখানে বইস্যা আছি, ততক্ষণে আমার ৩০০ ট্যাকা আয় হইতো।'

কাজীপাড়ায় টিসিবির ট্রাকের অপেক্ষায় থাকা মানুষের সারি। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

এর আগে সকাল ১০টার দিকে টিসিবির আরেকটি ট্রাকসেল পয়েন্ট কাজীপাড়াতে গিয়েও দেখা মেলে একই রকম চিত্র। ওই জায়গায় প্রায় আধা ঘণ্টা অবস্থানকালে কোনো ট্রাক আসেনি। সেখানেও সকাল থেকে প্রায় শ'খানেক মানুষ অপেক্ষায় ছিলেন।

কোলে ৩ বছরের সন্তান নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা গুলবাহার বানু নামের এক নারী বললেন, 'ট্রাক একেক দিন একেক সময়ে আসে। কোনো দিন আধা ঘণ্টা এক ঘণ্টা দাঁড়াইলেই হয়। আবার কোনোদিন লাইন এত লম্বা থাকে যে, শেষ পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায় না।'

টিসিবি থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে অনুসারে কাজীপাড়া ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের মতো ঢাকায় টিসিবির এমন ট্রাকসেল পয়েন্টের সংখ্যা ৮০টির বেশি। যার একটি কারওয়ান বাজারে টিসিবি কার্যালয়ের সামনে। কিন্তু দুপুর ১২টায় সেখানে গিয়ে কোনো ট্রাক চোখে পড়েনি। কাউকে অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়নি।

জানতে চাইলে টিসিবির ঊর্ধ্বতন কার্যনির্বাহী ও তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সিরিয়াল অনুসারে আমাদের ২টি গোডাউন থেকে প্রতিদিন ১০০টি ট্রাক বিভিন্ন গন্তব্যে যায়। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে এই কার্যক্রম শুরু হয়। শেষ ট্রাকটা ছাড়তে কখনো কখনো সাড়ে ১১টা, ১২টাও বেজে যায়। এ ক্ষেত্রে লোডিং শেষে সিরিয়ালের ভিন্নতার জন্য ট্রাকগুলোর জায়গামতো পৌঁছাতে অনেক ক্ষেত্রে দেরি হয়।'

বাজারমূল্যের থেকে খানিকটা কম দামে টিসিবির ট্রাক থেকে খাদ্যপণ্য কিনতে প্রতিদিন অনেক মানুষকে ভিড় করতে দেখা যায় নির্দিষ্ট পয়েন্টগুলোতে। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

আওয়ামী লীগ সরকার এই মেয়াদে দায়িত্ব নিয়েছিল ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি। সরকারি সংস্থা টিসিবির ওই দিনের বাজারদরের তালিকা ও গত বৃহস্পতিবারের তালিকার তুলনামূলক বিশ্লেষণ অনুসারে, এ সময়ের মধ্যে মোটা চালের দাম ১৫, মোটা দানার মসুর ডাল ৭৭, খোলা সয়াবিন তেল ৫৪, চিনি ৪৯ ও আটার দাম ২১ শতাংশ বেড়েছে। নিত্যব্যবহার্য পণ্য ও শিক্ষা উপকরণের দামও এখন বাড়তি।

এ ছাড়া ২০২১ সালের শুরুতে যে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের ১২ কেজির সিলিন্ডার ৮০০-৮২০ টাকা ছিল, এখন তা কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ২৪০ টাকায়।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস), পিপিআরসি ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর জরিপ অনুসারে, করোনাকালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ২১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সরকার এই দাবি নাকচ করলেও ২০২০ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তাদের এক জরিপে মানুষের আয় ২০ শতাংশ কমে যাওয়ার তথ্য দিয়েছিল।

Comments

The Daily Star  | English

BNP not in favour of banning any political party: Fakhrul

'Who are we to ban a political party? The people will decide,' says the BNP leader

47m ago