ভালোবাসা দিয়ে না পেয়ে, কখন মানুষ সবচেয়ে সুখী হয়

ছবি: সংগৃহীত

প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্কে মানুষ কখন সবচেয়ে বেশি সুখী হয়? এই প্রশ্নের উত্তরে অনেকে মনে করতে পারেন, খুব বেশি ভালোবাসা পেলেই বুঝি মানুষ সবচেয়ে সুখী হয়। তবে, বিশ্বখ্যাত কিছু সাইকোঅ্যানালিস্ট থেকে শুরু করে কবি-সাহিত্যিকরা ঠিক উল্টো যুক্তি ও তার ব্যাখ্যা করেছেন। তারা মনে করেন প্রেম-ভালোবাসা মূলত পাওয়ার চেয়ে, দেওয়াতেই প্রকৃত সুখ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতায় এ বিষয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সেখানে তিনি লিখেছেন, 'তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান– গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।'

প্রেম-ভালোবাসার বিষয়ে জার্মান সাইকোঅ্যানালিস্ট ও সমাজবিজ্ঞানী এরিক ফ্রম মনে করেন, অধিকাংশ মানুষের কাছে প্রেমের প্রশ্নটি মূলত প্রেম পাওয়ার প্রশ্ন— দেওয়ার প্রশ্ন নয়। সে জন্য তাদের কাছে সমস্যার বিষয়, কী রূপে প্রেম পাওয়া যায়, কী রূপে প্রেম পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা যায়। আর এই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য তারা নানা রকম পথ ও পন্থা অবলম্বন করে থাকে।

এরিক ফ্রম তার 'দ্য আর্ট অব লাভিং' বইটিতে এ বিষয়ে বিস্তৃত ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। বইটিতে তিনি প্রেমকে একটি আর্ট বা কলা হিসেবে দেখিয়েছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, প্রেম যদি বিদ্যা হয় তাহলে অবশ্যই তা শেখার জন্য জ্ঞান ও চর্চার প্রয়োজন। কিন্তু, অধিকাংশ মানুষ একে ভাগ্য বলেই মনে করে।

এরিকের মতে যেহেতু প্রেমের প্রবৃত্তি বর্জন করা সম্ভব না, সেজন্য এই ব্যর্থতা থেকে বাঁচার একটাই উপায়— তা হলো এই ব্যর্থতার কারণগুলো অনুসন্ধান করে প্রেমের অর্থ অনুধাবন করা। আর এর প্রথম উদ্যোগ হলো—এটা বোঝা যে, প্রেম হলো একটি কলাবিশেষ। প্রকৃতভাবে বেঁচে থাকাটাও এক ধরনের কলা বা অনুশীলন। অন্য যেকোনো কলা বিদ্যা শিখতে হলে যেভাবে অনুশীলন করা প্রয়োজন, প্রেমের ক্ষেত্রেও সেইভাবে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন।

প্রেমের চর্চা ও সফলতার বিষয়ে তিনি বলেছেন, 'আপনার প্রেম যদি আপনার প্রেমাস্পদের হৃদয়ে প্রেম না জাগাইতে পারে, আপনি প্রেমিক বা প্রেমিকা রূপে আপনার জীবনকে প্রকাশিত করেও প্রেম না পান তাহলে আপনার প্রেমে নিষ্ফল।'

প্রেমে পড়ার কারণ

আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব কায়রোর (এইউসি) সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক হানি হেনরির মতে, আমাদের প্রেমে পড়ার প্রধানতম কারণগুলোর মধ্যে আছে, নৈকট্য লাভ, আবেগ ও প্রতিশ্রুতির মতো বিষয়গুলো। 

এ বিষয়ে এরিক ফ্রমও মনে করেন, দান ছাড়াও আরও কতগুলো উপাদন থেকে প্রেমের সক্রিয় রূপ সুস্পষ্ট হয়। যেমন- যত্নশীলতা, দায়িত্ববোধ, শ্রদ্ধা ও জ্ঞান। 

প্রেমে পড়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে গিয়ে এরিক বলেছেন, মানুষের গভীরতম চাহিদা হলো তার বিচ্ছিন্নতাবোধের অবসান, তার একাকীত্বের বন্দিশালা থেকে মুক্তি। সব যুগের এবং সব সংস্কৃতির মানুষ এই একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সচেষ্ট— কী করে বিচ্ছিন্নতা জয় করা যায়, কী করে মিলন সাধন করা যায়। নিজের ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবন অতিক্রম করে ঐক্যসাধন করা যায়। আদিম গুহাবাসী মানুষ, মিশরের কৃষক, মেষপালক যাযাবর, ফিনিশীয়, জাপানি বা আধুনিক কেরানি সবার ক্ষেত্রেই প্রশ্নটি এক।

নিঃসঙ্গতা বোধ জয় করতে মানুষ নানা ধরনের চেষ্টাও করে থাকে, সেগুলোকে মোটা দাগে ৩টি ভাগে ভাগ করেছেন এরিক। প্রথম উপায় হিসেবে বলেছেন, অনেকে মাদকতাজনিত বিভোর অবস্থা থেকে মুক্তির পথ খোঁজে। তবে, বিভোর অবস্থা কাটার পর তাদের নিঃসঙ্গতা আরও বেড়ে যায়। এর ফলে তাদের মাদক সেবনের পরিমাণও বেড়ে চলে।

দ্বিতীয় উপায় হিসেবে অনেকে মৈথুন কর্মের উল্লাসের মধ্যে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। তাদের অবস্থা একটু ভিন্ন রকম হয়। এই প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক ও সুস্থ উপায় বললেও এটাকে সমস্যার আংশিক সমাধান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তিনি। তবে, অনেকের ক্ষেত্রে এগুলোতে নিঃসঙ্গতা না কমে বরং অভ্যাসে পরিণত হতে পারে।

মিলন লাভের তৃতীয় উপায় হিসেবে এরিক ফ্রম সৃজনশীল কাজের কথা উল্লেখ করেছেন। এটা শিল্পীর কাজও হতে পারে, আবার কারিগরের কাজও হতে পারে। কাঠমিস্ত্রি একটি টেবিল বানানোর সময়, স্বর্ণকার একটি অলঙ্কার বানানোর সময়, চিত্রকর তার ছবি আঁকার সময় বা কৃষক তার শস্য উৎপাদনের সময় সমগ্র বিশ্বের সঙ্গেই মিলিত হয়। এ ধরনের মিলন কেবল উৎপাদনকারী বা সৃজনশীল কাজের মাধ্যমেই সম্ভব।

অন্যদিকে, কেরানির কাজ বা যন্ত্রচালিত মেশিন পরিচালনার মধ্য সৃজনশীলতা নেই উল্লেখ করে এ ধরনের কাজে মিলন সম্ভব না বলেও মনে করেন এরিক। সৃজনশীল কাজ বলতে তিনি বুঝিয়েছেন- যে কাজ আমরা পরিকল্পনা করে করি ও তার ফলকে আমরা স্বচক্ষে দেখি।

এরিকের মতে, অন্য আরেক জনের সঙ্গে প্রেমের মিলনে আবদ্ধ হওয়ার চেয়ে আর কোনো বড় আকাঙ্ক্ষা মানুষের মধ্যে নেই। এটাই মানুষের আদিমতম ক্ষুধা। এটাই মনুষ্যজাতিকে, সম্প্রদায়কে, পরিবার ও সমাজকে একত্রে বেঁধে রেখেছে।

গ্রহণ করেছ যত, ঋণী তত করেছ আমায়

এরিক ফ্রম মনে করেন, দানের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষেত্র বৈশ্বয়িক দানের ক্ষেত্র নয়। যে বস্তুগুলো মানুষের একবারে নিজস্ব, সেই বস্তুগুলোর দান করা হলো সর্বোচ্চ দান। দান করে মানুষ আরেকজনের জীবনে নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি করে এবং সেই তরঙ্গের প্রতিঘাত তাকেও স্পর্ষ করে। যথার্থ দিতে পারলে সেও প্রতিদান পায়। 

তার মতে, প্রেম মূলত দেওয়ার জিনিস, পাওয়ার জিনিস না। দানের ফলে একটি নতুন ভাব জন্মায় এবং দাতা-গ্রহীতা উভয়ে এই ভাবের মাহাত্মটি উপলব্ধি করে কৃতজ্ঞতাপ্লুত হয়ে ওঠে। প্রেমের ব্যাপারেও—প্রেমদানের মাধ্যমে প্রেমাস্পদের হৃদয়েও প্রেমের উদয় হয়।

প্রেমের ক্ষেত্রে দান ছাড়াও আরও কতগুলো উপাদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলোর মধ্যে আছে, যত্নশীলতা, দায়িত্ববোধ, শ্রদ্ধা ও জ্ঞান।

ফ্রয়েডের মতে প্রেম মূলত যৌন প্রবৃত্তি বা রিরংসার প্রকাশ বা উদগতি (Sublimation) তবে এরিক ফ্রম মনে করেন প্রেম বা মিলনেচ্ছা মূলত মৌলিক শক্তি। তার একটি প্রকাশ হলো যৌন সঙ্গমের ইচ্ছা বা রতি। তবে প্রেমের ব্যাপারে ফ্রয়েডের মতকে ভুল বলে খারিজ করেছেন এরিক।

এরিক মনে করতেন ভালোবাসা পাওয়ার চাইতে দেওয়ার সার্থকতা বেশি বলে মানুষ ভালোবেসে স্বকামজনিত আত্মকেন্দ্রিক একাকীত্ব ও বিচ্ছিন্নতার কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে। এর মাধ্যমে সে এক নতুন সাযুজ্য, একত্ব ও মিলনের স্বাদ অনুভব করে।

প্রেমের নীতি ও প্রকার

বয়স ও মানসিক অবস্থা ভেদে প্রেমের ক্ষেত্রে কয়েকটা নীতির কথাও উল্লেখ করেছেন এরিক ফ্রম। যেমন- শিশুসুলভ প্রেমের নীতি হলো, 'যেহেতু আমি ভালোবাসা পাই, তাই আমি ভালোবাসি '; অপরিণত প্রেমের নীতি হচ্ছে, 'যেহেতু তোমাকে আমার প্রয়োজন, তাই তোমাকে ভালোবাসি' আর পরিণত প্রেম বলে, 'যেহেতু ভালোবাসি, তাই তোমাকে আমার প্রয়োজন' প্রেমকে সর্বতোমুখী ও কয়েক প্রকারের বলে মনে করেন এরিক ফ্রম। তিনি বলেছেন, প্রেমের প্রকারভেদ নির্ভর করে প্রেমের বস্তুর ভিন্নতার ওপর। তার প্রকারেভেদগুলো হচ্ছে-

ভাতৃপ্রেম, যেটি সব ধরনের প্রেমের ভিত্তিস্থলে রয়েছে। ভাতৃপ্রেমই সর্বপেক্ষা মৌলিক প্রেম। যে প্রেমের উপাদান অন্য ব্যক্তির জীবনের প্রতি যত্নশীলতা, শ্রদ্ধা ও দায়িত্বশীলতা। এই ধরনের প্রেমের বিষয়ে এরিক বলেছেন, নিজের আত্মীয়-স্বজনকে ভালোবাসা এমন কোনো কৃতিত্ব নয়, বরং অসহায় দরিদ্র ও অপরিচিত ব্যক্তির প্রতি প্রেমই ভাতৃপ্রেম।

ভাতৃপ্রেম ও মধুরপ্রেম যেখানে সমান ও সমমানের মধ্যে প্রেম। মাতৃপ্রেম মূলত শিশুর জীবন ও তার প্রয়োজনের প্রতি দায়িত্বশীলতা। মাতৃপ্রেম মাতা ও শিশুর মধ্যে প্রেম। সুতরাং এখানে প্রেম অসমানের মধ্যে। একজনের সমস্তটিই চাওয়া, অন্যজনের সমস্তটিই দেওয়া। এই নিঃস্বার্থ ও পরোৎসর্গকারী গুণের জন্য মাতৃপ্রেমকে শ্রেষ্ঠ প্রেম সর্ববিধ ভাবের বন্ধনের মধ্যে শুচিতম বন্ধন বলেও গণ্য করা হয়।

ভাতৃ ও মাতৃ প্রেমের সম্পূর্ণ বিপরীত হলো মধুর প্রেম। মধুর প্রেমে থাকে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে পূর্ণ সাযুজ্য ও মিলন লাভের অদম্য বাসনা। এই প্রেমের প্রকৃতি হলো একমুখী, বহুমকী নয়। আবার বিভিন্ন ধরনের প্রেমের মধ্যে এটি সবচেয়ে বেশি ছলনাময়ও।

ভালোবাসা একটি সদগুণ কিন্তু নিজেকে ভালোবাসা একটি গর্হিত কাজ হিসেবেও অনেকে দেখেন।তাদের  ধারণা, মানুষ যে পরিমাণে আত্মপ্রেমী, সেই পরিমাণে পর বিদ্বেষী। আত্মপ্র্রেম ও স্বার্থপরতা একই জিনিস। ফ্রয়েডও আত্মপ্রেমকে মনঃসমীক্ষার ভাষায় বলেছেন, স্বকামীতা ও আত্মপ্রেম একই জিনিস। মানুষের মনের বিকাশের প্রথম বা আদিমতম পর্ব স্বকামীতা। যে ব্যক্তি পরবর্তী জীবনে স্বকামী হয়, সেই ব্যক্তি ভালোবাসতে পারে না।

প্রেমের ধর্মীয় রূপের নাম ঈশ্বর প্রেম। মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ঈশ্বর প্রেমও একই ধরনের প্রেম। মনুষ্যপ্রেমের যত রকমের রূপ ও বৈশিষ্ট্য আছে, ঈশ্বর প্রেমেরও তত রকমের রূপ ও বৈশিষ্ট্য আছে।

প্রেম ও সংঘাতের বিষয়ে এরিক ফ্রম বলেছেন, একটি মুড় ধারণা আছে যে—প্রেমের সম্পর্কে কখনো কোনো সংঘাত ঘটতে পারে না। মানুষ যেমন ভেবে থাকে জীবনে দুঃখ ও বিষাদের ভাগ একেবারেই থাকা উচিত নয়, তেমনি তাদের বিশ্বাস, বিবাদও অনুচিত। তারা এ ধরনের যুক্তির সমর্থন পায় মূলত দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাগুলো দেখে। তারা দেখে প্রেমবদ্ধ অবস্থায় যে কলহ হয় তার পরিণতি ধ্বংসাত্মক।

প্রেম ও সংঘাত: 

এরিক মনে বলেছেন, একটি মূঢ় ধারণা আছে, প্রেমের সম্বন্ধে কখনো কোনো দ্বন্দ্ব বা সংঘাত থাকা উচিত নয়। মানুষ যেমন মনে করে জীবনে দুঃখ ও বিষাদের পরিমাণ একেবারেই থাকা উচিতনয়, তেমনই আরেকটি ধারনা প্রেমের সম্পর্কে দ্বন্দ্ব না থাকা। জীবনের কতগুলো ঘটনা থেকে তারা তাদের যুক্তির সমর্থন পায়। আর সেগুলো হলো, তারা দেখেছে, প্রেমে আবদ্ধ অবস্থায় যে কলহ-বিবাদ হয় তার পরিণতি অনেক সময় ধ্বংসাত্মক হতে।

তিনি বলেছেন, দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে বিশ্বাসের অনুশীলন শুরু হয়। তাই প্রথম স্তরে লক্ষ্য রাখতে হবে কখন ও কী অবস্থায় এই বিশ্বাস হারাতে শুরু করে। প্রেম বিশ্বাসের বস্তু, এটি বিশ্বাসে মেলে। যে ব্যক্তির বিশ্বাস যত ছোট, তার প্রেম তত ছোট। 

সবশেষে এরিক মনে করেন, প্রেম যেহেতু একটা কলা, তাই এর সাধনার ব্যাপারটিও খুব সহজ নয়। একমাত্র চর্চার মাধ্যমেই কোনো কলা শেখা যায়। তবে, যে কোনো কলা শেখার জন্য প্রথমে শৃঙ্খলাবোধ দরকার। অনেকে মনে করেন, কী করে ভালোবাসা যায়, তার কৌশল শেখা যায়। এরূপ ধারণাকারীদের ভাগ্যে হতাশা অনিবার্য। প্রেম বা ভালোবাসা একটি নিতান্ত ব্যক্তিগত অনুভব; প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই অনুভবের জন্ম ব্যক্তির অন্তঃস্থল থেকে এর স্পর্শ এবং স্বাদ ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব।

 

 

Comments

The Daily Star  | English

Disrupting office work: Govt employees can be punished within 8 days

The interim government has moved to amend the Government Service Act-2018 to allow swift disciplinary action against its employees who will be found guilty of disrupting official activities.

7h ago