বিশ্বে প্রথম বইয়ের নামে সড়ক
কলকাতা শহর নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। ঐতিহ্যের সঙ্গে ট্রাম, রসগোল্লা আর মিষ্টি দই! বিষয়গুলো নিয়ে অলিতে গলিতে ছড়িয়ে আছে নস্টালজিয়া, আছে ইতিহাস। কিন্তু বই নিয়ে এমন দুর্লভ গল্প খুব মানুষই জানেন। একটি বইয়ের নামে রাস্তা! ভাবা যায়?
হ্যাঁ, বইয়ের নামেই রাস্তা! উত্তর কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলের কাঁটাপুকুর এলেই চোখে পড়বে 'বিশ্বকোষ লেন'। এতো বই থাকতে এই নাম কেন? তা নিয়েই আমাদের আলাপ। ওই রাস্তাতেই অবস্থিত নগেন্দ্রনাথ বসুর বাড়ি। তার সঙ্গে বিশ্বকোষ নামটি জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে।
নগেন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬৬ সালের ৬ জুলাই ভারতের মাহেশে। সেখান থেকে তার পূর্বপুরুষরা বাগবাজারে চলে আসেন। আমৃত্যু এই বাড়িতেই থেকেছেন নগেন্দ্রনাথ। পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী হলেও, মূলত ঐতিহাসিক হিসেবেই তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। তার সংগ্রহে ছিল অসংখ্য পুঁথি, পুরোনো পাণ্ডুলিপি। সদস্য ছিলেন এশিয়াটিক সোসাইটির। তিনি শুধু হিন্দিতে প্রথম বিশ্বকোষের লেখকই নন, পাশাপাশি তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদও ছিলেন। 'প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব' উপাধিতেও ভূষিত হয়েছিলেন তিনি।
প্রত্নতত্ত্বে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য এই প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণবের কাজকে সম্মান জানিয়ে ১৯১৫ সালের ১৭ মার্চ কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন তার বাড়ির সামনের রাস্তার নাম দেয় 'বিশ্বকোষ লেন'। আর এটিই সম্ভবত পৃথিবীতে প্রথম বইয়ের নামে কোনো রাস্তা।
প্রথম জীবনে নগেন্দ্রনাথ বসু কবিতা ও উপন্যাস লিখতেন। মাসিক পত্রিকা তপস্বিনী ও ভারতের সম্পাদনাও করেন তিনি। তিনি ভারতের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে বাংলা, সংস্কৃত ও উড়িয়া ভাষার প্রাচীন পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেন এবং পাথর ও তামার প্লেটে সেগুলো অঙ্কন করে রাখেন। তার সংগৃহীত এসব প্রাচীন পুঁথি ও পাণ্ডুলিপির নিয়েই ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পাঠদান শুরু হয়।
এবার একটু পেছনে ফিরে দেখি। ১৮৮৭ সালে বর্ধমান জেলার সাহিত্যিক রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও চব্বিশ পরগনার ব্যঙ্গকৌতুক রসের স্রষ্টা ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের যৌথ উদ্যোগে বাংলা বিশ্বকোষের প্রথম পর্ব সম্পাদনা করেন। পরের বছরই বিশ্বকোষের দায়িত্ব চলে আসে নগেন্দ্রনাথ বসুর হাতে। পরবর্তীতে ১৯১১ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরে নগেন্দ্রনাথ বসু বিশ্বকোষের ২২টি পর্ব প্রকাশ করেন। পরে ২৩ তম ও ২৪তম পর্ব প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯১৬ ও ১৯৩১ সালে।
এটি বাংলার প্রথম এনসাইক্লোপিডিয়া। শুধু বাংলা নয়, ভারতের যে কোনো ভাষায় এ ধরনের উদ্যোগ এটাই প্রথম। প্রায় ১৭ হাজার পৃষ্ঠার মোট ২৪টি খণ্ডে বিশ্বকোষের এই সংকলন করা হয়। ১৯৩৩ সালে আবারও তিনি বিশ্বকোষের কাজ শুরু করেন। তবে এর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মারা যান।
নগেন্দ্রনাথবসু'র বাড়ি যেখানে ছিল তার সামনের রাস্তাটির নামকরণ 'বিশ্বকোষ লেন' করা হয়। এমন উদাহরণ বিশ্বে আরও একটি দেখা গেছে। ২০১৩ সালে ইংল্যান্ডে নীল রিচার্ড ম্যাক্কিনন গেইম্যানের লেখা 'দ্য ওশান অ্যাট দ্য এন্ড অফ দ্য লেন' বইয়ের নামে একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছিল।
কৃতজ্ঞতা-কলকাতার বইপোকা ও তিলোত্তমাসম্ভব; কলকাতা: একটি সাংস্কৃতিক ইতিহাস।
Comments