গুরু পাপে লঘু ‘ক্ষমা’ চেয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক

আইন অমান্য করে ব্যাংকের পরিচালক এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে নজিরবিহীন পরিমাণ ঋণ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ক্ষমা চেয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড।

গত ১২ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পাঠানো চিঠিতে ন্যাশনাল ব্যাংক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, 'এ ধরণের অন্যায় ভবিষ্যতে আর হবে না।'

ব্যাংকিং আইনের গুরুতর লঙ্ঘন করে ন্যাশনাল ব্যাংক তাদের ২ পরিচালক রিক হক সিকদার ও রন হক সিকদার এবং তাদের পরিবারের সদস্যসহ মোট ১১ জনকে ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে ১৩ দশমিক ৬৩ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ১১৮ কোটি টাকা) খরচ করার সুবিধা দেয়।

একইসঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংক তাদের কার্ড বিভাগকে সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে পরিচালনা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে যেন তাদের কার্ড সেবা বন্ধ করে না দেওয়া হয়।

গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংককে একটি কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠিয়ে ব্যাখ্যা করতে বলে, কেন তাদের কার্ড সেবা বন্ধ অথবা স্থগিত করা হবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন অনুযায়ী একজন বাংলাদেশি নাগরিক তার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে দেশের বাইরে বছরে ১২ হাজার ডলারের বেশি খরচ করতে পারবেন না। অর্থাৎ উল্লেখিত ব্যক্তিদের ৪ বছরে মোট ৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার বা প্রায় ৫ কোটি ৬৬ লাখ করে খরচের সুবিধা পাওয়ার কথা।

১১ জনের মধ্যে ৯ জনই ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের পরিবারের সদস্য। বাকি ২ জন সিকদার গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তা। গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে এসব তথ্য উন্মোচিত হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, জয়নুলের নির্দেশে ন্যাশনাল ব্যাংক উল্লেখিত ১১ ব্যক্তিকে আইন অমান্য করার সুযোগ দেয়। উল্লেখ্য, জয়নুল হক সিকদার গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি মারা যান।

বাংলাদেশ ব্যাংক গত মাসে ১১ জন গ্রাহকের ঋণ সংক্রান্ত তথ্য গোপনের অভিযোগে ন্যাশনাল ব্যাংককে ৫৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠানো চিঠিতে ন্যাশনাল ব্যাংক উল্লেখ করে, তারা ইতোমধ্যে ১১ ব্যক্তির ক্রেডিট কার্ড সেবা বন্ধ করে দিয়েছে।

এ পর্যন্ত ন্যাশনাল ব্যাংক প্রায় ৯০ হাজার ক্রেডিট ও ১ লাখ ডেবিট কার্ড তাদের গ্রাহকদের মধ্যে বিতরণ করেছে।

ব্যাংকটির ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকদের মোট অপরিশোধিত ঋণের পরিমাণ ১২৫ থেকে ১৩০ কোটি টাকার মধ্যে।

ন্যাশনাল ব্যাংক একইসঙ্গে দিলকুশা ও পশ্চিম ধানমন্ডি শাখার অনুমোদিত ডিলারশিপ লাইসেন্স বাতিল না করার অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে জানা গেছে, জেড এইচ সিকদার মহিলা মেডিকেল কলেজের একটি বৈদেশিক মুদ্রা অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করতো ন্যাশনাল ব্যাংক। এটি আইনের লঙ্ঘন।

এই অ্যাকাউন্টটি ন্যাশনাল ব্যাংকের দিলকুশা শাখায় খোলা হয়েছিল, যেটি পরে ২০১৮ সালের বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন নির্দেশনা লঙ্ঘন করে পশ্চিম ধানমন্ডি শাখায় স্থানান্তর করা হয়।

চিঠিতে বলা হয়, '২টি শাখার লাইসেন্স বাতিল করা হলে ন্যাশনাল ব্যাংক বেশ ঝামেলায় পড়ে যাবে' এবং পরবর্তীতে গণমাধ্যমে 'নেতিবাচক প্রচারণা'য় ব্যাংকটি তারল্য সংকটের মুখে পড়বে।

কেন ১১ ব্যক্তিকে আইন লঙ্ঘন করতে দেওয়া হয়েছে তা জানতে চাওয়া হলে ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মেহমুদ হোসেন বলেন, তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারবেন না। কারণ তিনি মাত্র ২ মাস আগে ব্যাংকটিতে যোগ দিয়েছেন।

তিনি জানান, অতীতের ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, এই ক্ষমা প্রার্থনা গ্রহণযোগ্য নয়। ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী ন্যাশনাল ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক চিঠি নিরীক্ষা করে উপযুক্ত উদ্যোগ নেবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, সিকদার পরিবার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আগে ন্যাশনাল ব্যাংক একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ছিল।

তিনি আরও জানান, ২০০৯ সালের পর থেকে জয়নুল হক সিকদার ও তার পরিবারের সদস্যরা ব্যাংকের বোর্ডে তাদের প্রভাব বাড়াতে থাকেন এবং প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ধরনের অসাধু প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়াতে শুরু করে।

জয়নুল ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে টানা ১২ বছর কাজ করেছেন। বর্তমানে তার স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। এ ছাড়াও, তাদের সন্তান রিক, রন ও পারভীন হক সিকদার ১২ সদস্যের বোর্ড অব ডিরেক্টর্সের সদস্য।

ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে নীতিমালার বড় ধরনের লঙ্ঘন চিহ্নিত হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছরের এপ্রিলে ন্যাশনাল ব্যাংককে তাদের পূর্ব অনুমতি ছাড়া কোনো ধরনের ঋণ না দেওয়ার নির্দেশ দেয়।

ব্যাংকটি গত বছরের ডিসেম্বরে তাদের সেবা পরিচালনার অনুমতি পায়।

ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ গত বছরের সেপ্টেম্বরে ৪ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা ছিল, যেটি ২০২০ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ১২০ শতাংশ বেশি। ২০০৯ সালে ব্যাংকটির নন-পারফর্মিং ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৮৮ কোটি টাকা। গত বছরে ব্যাংকটির লাভও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায়।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

1h ago