‘বিদ্রোহী’ কবিতার নন্দনতাত্ত্বিক রাজনীতি

যেকোনো বড় কবি তার স্ব-ভাষার কবিতার ইতিহাসে কিছু না কিছু নতুনত্ব নিয়ে আসেন। কারও কারও নতুনত্ব গভীর অভিনিবেশ দিয়ে বুঝতে হয়। আবার কারও কারও নতুনত্ব কোনো মনোযোগ ছাড়াই টের পাওয়া যায়। ভাতের হাঁড়ি অতিতাপে যেমন একসময় সশব্দে বলকাতে থাকে, তেমনি কোনো কোনো কবির কবিতা মনোযোগ ছাড়াই মাথার মধ্যে বলকানি তোলে। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা বাংলা কবিতায় তাই-ই ছিল। তার কবিতা আধুনিক বাংলা কবিতার একশ বছরের ইতিহাসের মসৃণ পথচলাকে আমূল বদলে দিয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে বাংলা কবিতার পঠন-পাঠন-শ্রুতির ভূগোলে নজরুল এবং জসীমউদ্দীনই বোধ করি সবচেয়ে বেশি অস্বস্তি তৈরি করেছিলেন। কারণ, তারা বাংলা কবিতার বাঁধা পথে চলেননি; বরং নতুন পথের দিশা দিয়েছিলেন।

ইংরেজ উপনিবেশের ঔরসে যে আধুনিক বাংলা কবিতার ধারা তৈরি হয়েছিল, সেই ধারার উৎপাদক এবং ভোক্তা দুটোই ছিল ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি শ্রেণি। নজরুল বিত্তগত দিক থেকে, এমনকি যাপনের দিক থেকেও এই শ্রেণির বাইরের লোক ছিলেন। বিত্তের দিক থেকে তিনি ছিলেন প্রায় 'সর্বহারা' শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। আর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা তার কমই ছিল। ওই বিত্তগত কারণে স্থিরভাবে তিনি খুব একটা পড়াশুনা করতে পারেননি। নজরুল জীবনীকার গোলাম মুরশিদ তার বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত: নজরুল-জীবনীতে জানাচ্ছেন, স্থিরভাবে তিনি মাত্র তিন বছর পড়াশুনা করতে পেরেছিলেন; অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণি। এর আগে বোধ করি পেট চালাতে মসজিদ ও গোরস্তানের দেখভালের কাজ করতেন। কিছু পরে তিনি লেটোর দলে ছিলেন। পেটের দায়ে কাজ করেছেন রুটির দোকানে। রেলওয়ের এক গার্ডের খাবার আনা-নেওয়া ও তার ফাইফরমায়েশ খাটার কাজও করেছেন। এই বেসিক নিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে আনুষ্ঠানিক লেখালেখি শুরু করেন। ফলে, ঔপনিবেশিক একটা রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে যে প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে একজন মানুষের মন উপনিবেশিত হয়ে ওঠে সেই স্থিরতা ও সুযোগ কোনোটাই নজরুলের ছিল না। তাই, তার সাহিত্য ওই একশ বছর ধরে 'বাঙালি ইংরেজের' পৌরহিত্যে গড়ে ওঠা সাহিত্যের ঘেরটোপ থেকে আলাদা হয়ে পড়েছে। এতদিন কবিতা ছিল সৌখিন ড্রয়িং রুমে, বা পড়ার টেবিলে একান্তে বা 'সখি সনে' গোপনে মিলে পড়ার মতো নরম, অদেখা হৃদয়ের অদৃশ্য ব্যক্তিগত তড়পানির বিষয়। নজরুল এখান থেকে কবিতাকে নিয়ে আসলেন হাটে, মাঠে, রাজপথে, চায়ের স্টলে, তরুণের রাগী চোখের জ্বলতে থাকা মনিতে; বিষের বাঁশিতে, অগ্নির বীণাতে, ভাঙার গানে। ফলে সমকালীন কবিতার ভূগোলে একটা নন্দনতাত্ত্বিক গণ্ডগোল লেগে গেল। ঔপনিবেশিক রুচির সাহিত্যের ভোক্তা ও উৎপাদক মহলে রব উঠল, গেল গেল সব রসাতলে গেল! বাংলা কবিতার ইতিহাসে এই হৈ হৈ রব ওঠানো কবিতার নাম 'বিদ্রোহী'। কবিতাটি রচিত হয় ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে। আর 'বিজলী' পত্রিকায় ছাপা হয় ৬ জানুয়ারি ১৯২২। আজ থেকে ঠিক একশ বছর আগে।

কবিতাটি ছাপা হওয়ার পরের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র বলেছেন, 'বাংলা সাহিত্যে এই শতাব্দীর (বিংশ শতাব্দী) তৃতীয় দশকের গোড়ায় একবার কিন্তু এমনি অকস্মাৎ তুফানের দুরন্ত দোলা লেগেছিল। 

... মনে আছে, বন্ধুবর কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত একটি কাগজ কোথা থেকে কিনে নিয়ে অস্থির উত্তেজনার সঙ্গে আমার ঘরে এসে ঢুকেছিলেন। কাগজটা সামনে মেলে ধরে বলেছিলেন, পড়। অনেক কষ্টে যোগাড় করেছি। রাস্তায় কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে এ কাগজ নিয়ে। ... কবিতার নাম 'বিদ্রোহী'। সেদিন ঘরে বাইরে, মাঠে-ঘাটে রাজপথে সভায় এ কবিতা নীরবে নয়, উচ্চকণ্ঠে শত শত পাঠক পড়েছে। সে উত্তেজনা দেখে মনে হয়েছে যে, কবিতার জ্বলন্ত দীপ্তি এমন তীব্র যে ছাপার অক্ষরই যেন কাগজে আগুন ধরিয়ে দেবে। ... গাইবার গান নয়, চীৎকার করে পড়বার এমন কবিতা এ দেশের তরুণরা যেন এই প্রথম হাতে পেয়েছিল। তাদের উদ্দাম হৃদয়ের অস্থিরতারই এ যেন আশ্চর্য প্রতিধ্বনি।' আর অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত বলেছেন, 'এ কে নতুন কবি? নির্জীব দেশে এ কার বীর্যবাণী? শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, সমগ্র দেশ প্রবল নাড়া খেয়ে জেগে উঠল। এমনটি কোনোদিন শুনিনি, ভাবতেও পারিনি। যেন সমস্ত অনুপাতের বাইরে, যেন সমস্ত অঙ্কপাতেরও অতিরিক্ত... গদগদ বিহ্বলের দেশে এ কে এল উচ্চ- বজ্রনাদ হয়ে। আলস্যে আচ্ছন্ন দেশ আরামের বিছানা ছেড়ে হঠাৎ উদ্দণ্ড মেরুদণ্ডে উঠে দাঁড়াল।'

কিন্তু কবিতাটির কপালে নিন্দা, ব্যঙ্গবিদ্রুপও কম জোটেনি। মুসলমানদের একটি অংশের পক্ষ থেকে নিন্দা-বিদ্রুপ হয়েছে। কেউ কেউ নজরুলকে 'শয়তান', 'নমরুদ' বলে সাব্যস্ত করেছেন। কবি গোলাম মোস্তফা থেকে শুরু করে অনেকে লিখেছেন বেশ কিছু প্যারডি কবিতা ও গদ্য। শনিবারের চিঠি পত্রিকার টানা চার সংখ্যায় এবং পরে বিশেষ 'বিদ্রোহী সংখ্যা'য় কবিতাটির বেশ কিছু প্যারডি বের হয়। এই উভয় প্রকার নিন্দা-মন্দের মূলে ছিল 'বিদ্রোহী' কবিতার অভিনবত্ব। এই অভিনবত্ব যেমন ধর্ম সম্পর্কিত বোধের ব্যাপারে ছিল, তেমনি ছিল কবিতার নন্দনতাত্ত্বিক দিক থেকেও। এই কবিতা ধর্মপ্রাণ সাহিত্যিক মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু নজরুল বরাবরই বলতেন, 'আমি শরিয়তের বাণী বলিনি—আমি কবিতা লিখেছি। ধর্মের বা শাস্ত্রের মাপকাঠি দিয়ে কবিতাকে মাপতে গেলে ভীষণ হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। ধর্মের কড়াকড়ির মধ্যে কবি বা কবিতা বাঁচেও না, জন্মও লাভ করতে পারে না।' অর্থাৎ নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতাটি কবিতার ধর্মীয় ধারায় একটা অস্বস্তি তৈরি করেছিল। আবার একশ বছর ধরে গড়ে ওঠা সাহিত্যের নন্দনতত্ত্ব ও রুচিতেও একটা অস্বস্তি তৈরি করেছিল। সজনীকান্ত দাসের 'ব্যাং' থেকে শুরু করে সমকালে প্রকাশিত প্রতিটি প্যারডি পড়লেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

নজরুলের 'বিদ্রোহী' ও এর সহোদরস্থানীয় কবিতাগুলো যে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে একটা নন্দনতাত্ত্বিক অস্বস্তি তৈরি করেছিল তা কয়েকটি ঘটনার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় নজরুলকে রবীন্দ্রনাথের বসন্ত নাটকটি উৎসর্গের পাশ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে। রবীন্দ্রনাথের পরিবার বা ব্রাহ্মসমাজের বাইরে এই প্রথম তিনি কাউকে বই উৎসর্গ করেন। এতে রবীন্দ্রনাথের চারপাশের কবি-সাহিত্যিক-অনুরাগীদের মধ্যে একটা যেন কেওয়াজ লেগে গেল। রবীন্দ্রনাথ সেটা জানতে পেরে একদিন সবার উপস্থিতিতে বললেন, 'নজরুলকে আমি বসন্ত গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি এবং উৎসর্গ পত্রে তাকে 'কবি' বলে অভিহিত করেছি। জানি তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ এটা অনুমোদন করতে পারনি। আমার বিশ্বাস তোমরা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করেছ।' রবীন্দ্রনাথের একথা শুনে উপস্থিত একজন সাহিত্যিক, যিনি রবীন্দ্র-নন্দনতত্ত্বের ভোক্তা, মন্তব্য করলেন, 'মার মার কাট কাট ও অসির ঝনঝনার মধ্যে রূপ ও রসের প্রলেপটুকু হারিয়ে গেছে।' (জীবন ও সৃজন, রফিকুল ইসলাম)

এই রূপ ও রসের প্রলেপের অভিযোগ এক শ্রেণির কবিতা-ভোক্তা ও সাহিত্যিক বরাবরই করেছেন নজরুলের 'বিদ্রোহী' ও সমগোত্রীয় কবিতার বিরুদ্ধে। কারণ, গণমুখী সাহিত্যকে অনেক আগেই ইউরোপীয় 'উন্নত রুচি', 'সূক্ষ্ম সৌন্দর্যতত্ত্বের' কথা বলে 'বাবু কালচার' ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিয়েছে। ফলে রাজনৈতিকতাস্পৃষ্ট গণমুখী 'বিদ্রোহী' কবিতা প্রথাগত নন্দনের কাছে, বাবু নন্দনের কাছে, 'তারস্বর', 'অসংবদ্ধ', 'এলোমেলো', 'অস্থির', 'উন্মাদনা' বলেই সাব্যস্ত হয়েছে। মোহিতলাল মজুমদার 'সাহিত্যের আদর্শ' প্রবন্ধে খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন, 'আমাদের দেশে খুব বর্তমানকালে এমন একটি প্রবৃত্তি দেখা দিতেছে, যাহাতে সাহিত্যের এই নীতি বা আদর্শ একেবারে উড়িয়া যাইতেছে; অতিশয় অমেধ্য এবং মানবাত্মার পক্ষে গ্লানিকর এই শ্রেণির ভাব ও ভাবুকতা বিদ্রোহের 'রক্তনিশান' উড়াইয়া ভয়ানক আস্ফালন করিতেছে।'  

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কল্লোল, কালি-কলম, প্রগতি পত্রিকা ও কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে শনিবারের চিঠির একটা বিরোধ ছিল। আসলে এই এই বিরোধের একটা বড় অংশজুড়ে আছে নন্দনতাত্ত্বিক বিরোধ। যদিও নজরুল এবং কল্লোল, কালি-কলম ও প্রগতির নন্দন এক ছিল না। কিন্তু নতুন কথা নতুনভাবে বলার দিক থেকে নজরুলের সঙ্গে এইসব পত্রিকার কবি-সাহিত্যিকদের একটা বড় মিল ছিল। এবং তারা নজরুলকে অপ্রথাগতদের শিরোমণি মনে করে যথেষ্ঠ পাত্তা দিতেন। এ কারণে নজরুল কল্লোল-এর অন্যতম লেখক ছিলেন। সজনীকান্ত দাস রবীন্দ্রনাথের কাছে সমকালীন সাহিত্য নিয়ে যত অভিযোগ-নালিশ করেছেন তার মধ্যে ওইসব পত্রিকার সঙ্গে সব সময় নজরুলের কবিতার প্রসঙ্গও থাকত। সজনীকান্তদের ব্যাপক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই রবীন্দ্রনাথ 'সাহিত্যধর্ম' প্রবন্ধে লিখেছিলেন, 'মত্ততার আত্মবিস্মৃতিতে একরকম উল্লাস হয়; কণ্ঠের অক্লান্ত উত্তেজনায় খুব একটা জোরও আছে, মাধুর্যহীন সেই রূঢ়তাকেই যদি শক্তির লক্ষণ বলে মানতে হয়। তবে এই পালোয়ানির মাতামাতিকে বাহাদুরি দিতে হবে সে কথা স্বীকার করি।' রবীন্দ্রনাথের এই খোঁচার মাথায় নজরুল যে আছেন তাতে সন্দেহ নেই। বলা বাহুল্য রবীন্দ্রনাথ, মোহিতলাল, সজনীকান্ত ও অপরাপর কবিদের নন্দনতাত্ত্বিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করেই ওই একই নন্দনতত্ত্বের ভোক্তা-সমর্থক-চর্চাকারী কাজী আবদুল ওদুদ নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, 'বিভিন্ন ভাবের একত্র সমাবেশের সংগতি সুষমা অথবা যৌক্তিকতা বিষয়ে কবি বেশ, উদাসীন হয়েছেন।'

কিন্তু গত একশ বছরে পৃথিবীর জল অনেক গড়িয়েছে। এর মধ্যে বাংলা কবিতা শুধু নয়, বিশ্ব কবিতা পরিবর্তিত হয়েছে। দেশে দেশে জাতীয় সাহিত্যের ধারণা তৈরি হয়েছে। এই ধারণায় নজরুলের গণমুখী ও প্রতিরোধী নন্দনতত্ত্ব আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। মুষ্টিমেয় মানুষের পৃথিবী যেভাবে অধিকাংশ মানুষের পৃথিবীর মধ্যে ঢুকে পড়ছে এবং অধিকাংশের পৃথিবীকে নাই করে দিচ্ছে তাতে কবিতাকে নজরুলীয় নন্দনের কাছে হাত না পেতে উপায় নেই। একারণেই বোধ করি 'বিদ্রোহী' বাংলা কবিতার ক্লাসিক হয়ে উঠেছে এবং আরও বহুকাল আদরণীয় হয়ে রইবে।

কুদরত-ই-হুদা: গবেষক ও সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ। শ্রীনগর সরকারি কলেজ। 

 

Comments

The Daily Star  | English

Matarbari project director sold numerous project supplies

Planning Adviser Prof Wahiduddin Mahmud today said the Matarbari project director had sold numerous project supplies before fleeing following the ouster of the Awami League government on August 5.

1y ago