কাগুজে মুনাফা দিয়ে ব্যাংকের চমক

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শিথিল নীতিমালার কারণে ২০২১ সালে ব্যাংকগুলো উচ্চ পরিচালন মুনাফা অর্জন করেছে। এই নীতিমালার কারণে অপরিশোধিত কিস্তির সুদকে লাভের খাতায় দেখানোর সুযোগ পেয়েছে ব্যাংকগুলো।

২২টি ব্যাংকের ২০২১ সালের পরিচালন মুনাফা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একটি বাদে বাকি সব ব্যাংক এর আগের বছরের তুলনায় বেশি মুনাফা করেছে।

বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শিথিল নীতি ব্যাংকগুলোতে বেশি মুনাফা করতে সহযোগিতা করলেও এটি সামগ্রিকভাবে এই খাতের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। বরং এতে দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়বে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুসারে, গত বছর ঋণগ্রহীতারা তাদের সবগুলো কিস্তির মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ পরিশোধ করলে ব্যাংকগুলো তাদের খেলাপি হিসেবে বিবেচনা করতে পারবে না।

এর বিপরীতে অপরিশোধিত বাকি ৮৫ শতাংশ কিস্তির সুদ ব্যাংকের মুনাফা হিসেবে স্থানান্তর করার অনুমতি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা আদতে পরিশোধই করা হয়নি। এই প্রক্রিয়া ব্যাংকগুলোর মুনাফার অঙ্ক বাড়াতে সহযোগিতা করেছে।

সবগুলো ব্যাংকের ভেতর ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড বিদায়ী বছরে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এর আগের বছরে ব্যাংকটির মুনাফা ছিল ২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা।

পরিচালন মুনাফায় সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক, যা ১৪৪ শতাংশ বেড়ে ৭৭৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

আইএফআইসি ব্যাংকের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ মো. মহিউদ্দীন জানান, এই ব্যাংকটি খুচরা ঋণ থেকেও উল্লেখযোগ্য আয় করেছে।

তিনি বলেন, 'আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি।'

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদের ভাষ্য, ব্যাংকগুলোর উচ্চ মুনাফা স্পষ্টতই এই ইঙ্গিত দেয় যে, তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে।

তিনি বলেন, 'কিন্তু এটি প্রকৃত মুনাফা নয়। কারণ একটি গাণিতিক পদ্ধদিতে তারা এই মুনাফা দেখিয়েছেন। এই পদ্ধতি ব্যাংক খাতের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। বরং এটি ব্যাংক খাতের মৌলিক ভিত্তিগুলোতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।'

সাবেক এই গভর্নরের মতে, এর ফলে ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালকরা বেশি মুনাফা (রিটার্ন) পাবেন। কিন্তু আমানতকারীদের জন্য তেমন কিছুই থাকবে না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বিদায়ী বছরে ব্যাংকগুলোর শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালকদের ভালো পরিমাণ লভ্যাংশ পাওয়ার কথা, যা শেষ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে দুর্বল করে তুলবে।

মুনাফার একটি বড় অংশ ঋণগ্রহীতাদের কিস্তির টাকা থেকে আসেনি। ২০২২ সালে এই তহবিল পাওয়া যাবে ধরে ব্যাংকগুলো মুনাফা হিসাব করেছে। 

ব্যাংকগুলো নেট মুনাফার ওপর ভিত্তি করে লভ্যাংশ প্রদান করে, যার বেশিরভাগই পরিচালন মুনাফা থেকে আসে। কিন্তু এবার অনেক ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা না হওয়ায় নগদ অর্থ দিয়ে এই ব্যবধান ঘোচাতে হবে, যার বেশিরভাগ আসবে আমানতকারীদের কাছ থেকে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকগুলোর উচ্চ পরিচালন মুনাফা কেবল একটি মোটা অঙ্ক, যেটাকে 'আইওয়াশ' বলা চলে।

তার বক্তব্য, এতে ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত অবস্থা আড়ালে চলে গেছে। কারণ বেশিরভাগ ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শিথিল নীতিমালার সুযোগ নিয়ে এই মুনাফা করেছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক এই কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, মুনাফা দেখাতে ব্যবহৃত হওয়া অনেক ঋণ এ বছর খেলাপিতে চলে যেতে পারে। তিনি বলেন, 'সুতরাং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ব্যাংকগুলোকে তাদের নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) ও মূলধনের ভিত্তি উন্নত করতে বাধ্য করা।'

শিথিল নীতিমালার অধীনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় ১ শতাংশের সঙ্গে অতিরিক্ত ২ শতাংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে বলেছে।

আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, শিথিলতার মেয়াদ আর বাড়ানো উচিত নয়। কারণ করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সৃষ্ট ব্যবসায়িক মন্দার জন্য এর মধ্যে ব্যংকগুলোর শক্তি কমে গেছে।

একইসঙ্গে শিথিল নীতি অভ্যাসগত খেলাপিদেরও প্রণোদিত করেছে। কারণ নিয়ম করে ঋণের অর্থ পরিশোধের বদলে তারা অল্প কিস্তি দিয়ে খেলাপি হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের বক্তব্য, মুনাফা পরিমাপের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর সতর্ক হওয়া উচিত। কারণ করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক ধরণ ওমিক্রন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।

তিনি বলেন, 'মুনাফা পরিমাপের বদলে ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা সঞ্চিতির ভিত্তি শক্তিশালী করার দিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ আমরা জানি না যে সামনে কী আছে।'

ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরানুল হক বিদায়ী বছরের উচ্চ মুনাফার জন্য তার ব্যাংকের খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার কর্মসূচি ভূমিকা উল্লেখ করেন। এর বাইরে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসার মাধ্যমে ব্যাংকটি বড় অঙ্কের মুনাফা করেছে বলে জানান তিনি।

বিদায়ী বছরে ঢাকা ব্যাংক ৭২৩ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এর আগের বছরের তুলনায় যা ৩৯ শতাংশ বেশি।

সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল হোসেন জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতির জন্য ২০২১ সালে সাউথইস্ট ব্যাংক তার আগের বছরের তুলনায় কম খেলাপি ঋণের মুখোমুখি হয়েছে।

এ ছাড়া ব্যাংকটি বৈদেশিক মুদ্রা সম্পর্কিত ব্যবসা থেকেও ভালো আয় করেছে। ২০২১ সালে সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ১ হাজার ১৬ কোটি টাকা। এর আগের বছরের তুলনায় যা ২৫ শতাংশ বেশি।

অবশ্য ন্যাশনাল ব্যাংকের মুনাফা ৯২০ কোটি টাকা থেকে কমে ২৩৮ কোটি টাকা হয়েছে। ২২ ব্যাংকের মধ্যে যা একমাত্র ব্যতিক্রম।

ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মেহমুদ হোসেনের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছর ব্যাংকটির ক্ষেত্রে নতুন ঋণ বিতরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় মুনাফা কমে গেছে।

তিনি বলেন, 'এ ছাড়া খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা স্থিতিশীল রাখতে যা আমাদের আরও নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে বাধ্য করেছে।'

অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ

Comments

The Daily Star  | English

Holding polls not our sole responsibility: Nahid

The ICT adviser says ‘revolutionary’ interim govt to hold elections in due time

1h ago