ফিরে দেখা-২০২১: যা কিছু আলোচনায়

২০২০ সালের শুরুতে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে মানুষের জীবন। ক্ষুদ্র ভাইরাসের কাছে মানুষের দিশাহারা অবস্থা, অসহায় আত্মসমর্পণ, আতঙ্ক ও মৃত্যু দেখে বাংলাদেশ। এরপর ২০২১ সালে নতুন আশা নিয়ে নতুন বছর শুরু করে মানুষ। মহামারির ঘোর কাটতে না কাটতে শেষ হয় বছরের প্রথম মাস। ফেব্রুয়ারিতে আবারও চেনা ছকে ফিরতে থাকে দেশের মানুষ। এরপর বছরজুড়ে ঘটতে থাকে একটার পর একটা ঘটন-অঘটন। ২০২১ সালের কয়েকটি আলোচিত ঘটনা নিয়ে এই প্রতিবেদন।

কারাগারে মুশতাকের মৃত্যু

লেখক মুশতাক আহমেদ ও কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে ২০২০ সালের মে মাসে শুরুতে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠে। এরপর ৫ মে তাদের বিরুদ্ধে 'ফেসবুকে করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানো, জাতির জনকের প্রতিকৃতি, জাতীয় সংগীত এবং জাতীয় পতাকা অবমাননার' অভিযোগ এনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে রমনা থানায় হস্তান্তর করা হয়।

পরদিন ঢাকার আদালতে হাজির করলে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন মহানগর হাকিম বেগম মাহমুদা বেগম। ২৪ অগাস্ট তাকে গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ৬ বার জামিনের জন্য আবেদন করলেও তা প্রত্যাখ্যাত হয়।

গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে আটক থাকা অবস্থাতেই ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মারা যান ৫৩ বছর বয়সী মুশতাক আহমেদ। মুশতাককে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ করেন একইসঙ্গে কারাগারে থাকা কার্টুনিস্ট কিশোর।

মুশতাকের মৃত্যুতে দেশজুড়ে শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমেও সরকারের সমালোচনা করে সংবাদ প্রকাশিত হয়। মুশতাকের মৃত্যুতে সংবাদ প্রকাশিত হয় দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, ভারতীয় দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, হিন্দুস্তান টাইমস, টাইমস অব ইন্ডিয়া, দ্য প্রিন্ট, স্ক্রল ও জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেসহ বহু গণমাধ্যমে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পাশাপাশি উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দেয় অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো–অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টভুক্ত (ওইসিডি) ১৩ দেশ। মুশতাকের মৃত্যুতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জানান দেশের মানবাধিকার সংগঠন ও বিভিন্ন পেশার মানুষ।

কার্টুনিস্ট কিশোর আটক ও নির্যাতনে 'কান ফাটানো'র অভিযোগ

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ১০ মাস কারাগারে থাকার পর ৪ মার্চ জামিনে মুক্তি পান কার্টুনিস্ট আহমেদ কিশোর।

জামিনে মুক্ত হয়ে ১০ মার্চ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করেন কিশোর। মামলার আবেদনে তিনি অভিযোগ করেন, 'গত বছরের ৫ মে রমনা থানার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। কিন্তু তারও ৩ দিন আগে ২ মে সন্ধ্যা পৌঁনে ৬টার দিকে সাধারণ পোশাকের ১৬ থেকে ১৭ জন লোক কাকরাইলের বাসা থেকে তাকে 'জোর করে হাতকড়া ও মুখে মুখোশ পরিয়ে অজ্ঞাত এক নির্জন জায়গায়' নিয়ে যায়।

সেখানে ২ মে থেকে ৪ মে তার ওপর 'শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার' চালানো হয় বলে অভিযোগ করে কিশোর বলেছেন, তার কানে 'প্রচণ্ড জোরে থাপ্পড় মারা হয়', কিছু সময়ের জন্য বোধশক্তিহীন হয়ে পড়েন তিনি। পরে তিনি বুঝতে পারেন, কান দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। 'স্টিলের পাত বসানো' লাঠি দিয়ে তাকে 'পেটানো' হয়। যন্ত্রণা ও ব্যথায় তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন।

মামলার আর্জিতে তিনি আরও বলেন, 'পরে তিনি নিজেকে র‌্যাব কার্যালয়ে দেখতে পান। সেখানে তার সঙ্গে লেখক মুশতাক আহমেদের দেখা হয়। মুশতাকের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারেন, মুশতাককে "বৈদ্যুতিক শক" দেওয়া হয়ছে।'

গত ৬ জুন কিশোর তাকে নির্যাতনের বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আঘাত করে আমার কান ফাটিয়ে দেওয়া হয়। ওই কানে বিশেষ ধরনের একটি যন্ত্র বসানো হয়েছে। পায়ের ব্যথায় এখনো ঠিক মতো হাঁটতে পারি না। চোখে একটি অপারেশন হয়েছে। ...শুধু নির্যাতন-আঘাতের চিহ্ন নয়, দানবীয় আঘাতের যন্ত্রণা নিয়েই বেঁচে আছি।'

কিশোরের শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি বলে আদালতকে জানায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ৩ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড।

কিশোরের মুক্তি দাবি করে বিবৃতি দেয় কার্টুনশিল্পীদের অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন কার্টুনিস্টস রাইটস নেটওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনাল (সিআরএনআই)। বিবৃতিতে তারা কিশোরের স্বাস্থ্যের অবনতি, তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও নির্যাতনের অভিযোগের বিষয় তুলে ধরে। পাশাপাশি কিশোরের মুক্তির দাবিতে বিবৃতি দেন বেশ বহু শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, শিক্ষার্থী, অ্যাক্টিভিস্ট, গবেষক, রাজনৈতিক কর্মী, স্বেচ্ছাসেবী, উন্নয়নকর্মী ও চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ।

গুলশানে কলেজশিক্ষার্থী হত্যা মামলা

২৬ এপ্রিল রাতে রাজধানীর গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে গলায় ওড়না প্যাঁচানো অবস্থায় ২১ বছর বয়সী কলেজশিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

সেই রাতেই আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ এনে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা করেন ওই শিক্ষার্থীর বড় বোন।

সেখানে বলা হয়, 'বিয়ের প্রলোভন' দেখিয়ে সায়েম সোবহান আনভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন ওই কলেজশিক্ষার্থীর সঙ্গে। তবে সেই অভিযোগের বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কখনো কথা বলেননি বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি।

এরপর কলেজশিক্ষার্থীর মৃত্যুর সঙ্গে আনভীরের কোনো 'সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি' জানিয়ে গত ১৯ জুলাই আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় পুলিশ।

পুলিশের ওই প্রতিবেদনে অনাস্থা (নারাজি) জানিয়ে কলেজশিক্ষার্থীর বোন অন্য কেনো সংস্থার মাধ্যমে মামলাটি তদন্তের আবেদন করেছিলেন। তা খারিজ করে ঢাকার মহানগর হাকিম রাজেশ চৌধুরী গত ১৮ অগাস্ট চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে সায়েম সোবহান আনভীরকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেন।

এরপর ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ এর বিচারক মাফরোজা পারভীনের আদালতে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীর, তার স্ত্রী ও বাবা-মাসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যা মামলা দায়ের করেন ওই শিক্ষার্থীর বোন।

মামলার বাদী জানান, 'মামলায় সায়েম সোবহান আনভীর, তার স্ত্রী সাবরিনা, বাবা আহমেদ আকবর সোবহান, মা আফরোজা, শারমীন, সাইফা রহমান মীম, ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও ইব্রাহীম আহমেদ রিপনকে আসামি করা হয়েছে।'

সেপ্টেম্বরে আনভীর হাইকোর্টে আগাম জামিন করলে আবেদনে সাড়া দেননি আদালত।

আদালতের নথি অনুসারে, তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পিবিআই এখন পর্যন্ত পঞ্চম বারের মতো সময় নিয়েও প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি।

গত ৮ ডিসেম্বর একই আদালত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য ২৮ ডিসেম্বর তারিখ নির্ধারণ করে আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত না হওয়ায় ওই দিন মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পিবিআইয়ের পরিদর্শক গোলাম মোক্তার আশরাফুদ্দিন আদালতে সময় চেয়ে আবেদন করেন। সেই অনুযায়ী ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বেগম ইয়াসমিন আরা তদন্ত কর্মকর্তাকে আগামী ১৬ জানুয়ারির মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আদেশ দেন।

সচিবালয়ে রোজিনা ইসলামকে নিপীড়ন

পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য ১৭ মে সচিবালয়ের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গেলে প্রথম আলোর জেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে সেখানে একটি কক্ষে আটকে রাখা হয় এবং তার মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। এক পর্যায়ে সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ৫ ঘণ্টার বেশি সময় তাকে সেখানে আটকে রাখার পর শাহবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।

পরে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করা হয়।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উপসচিব শিব্বির আহমেদ ওসমানী বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় এবং অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ও ৫ ধারায় অভিযোগ আনা হয়।

মামলার এজাহারে রোজিনা ইসলাম চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে 'অপ্রকাশযোগ্য চুক্তি'র নথি চুরি করেছেন বলে উল্লেখ করা হলেও তার কাছে থেকে জব্দ করা জিনিসের তালিকায় এ ধরনের নথির কথা উল্লেখ ছিল না।

ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসীমের আদালতে হাজির করে রোজিনা ইসলামের ৫ দিনের রিমান্ড চান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসিম তার রিমান্ড নাকচ করে রোজিনাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন, মানববন্ধন ও বিবৃতি দেয় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি। সংবাদ প্রকাশিত হয় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।

৬ দিন পর ২৩ মে বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে কাশিমপুর মহিলা কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান রোজিনা ইসলাম।

পরীমনি ঝড়

বছরজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন চিত্রনায়িকা পরীমনি। ১৩ জুন বিকেলে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডি থেকে প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য চেয়ে একটা স্ট্যাটাস দেন তিনি। ওই রাতেই বনানীর বাসায় সংবাদ সম্মেলন করেন পরীমনি। সেখানে তিনি বোট ক্লাবে তার সঙ্গে ঘটা বিষয়গুলো গণমাধ্যমের সামনে আনেন। নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও তুহিন সিদ্দিকী অমির বিরুদ্ধে ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ করেন। পরদিন পরীমনি সাভার থানায় নাসির ইউ মাহমুদ ও অমিসহ মোট ৬ জনের নামে এই বিষয়ে মামলা দায়ের করেন।

এরপর ৪ আগস্ট পরীমনির বনানীর বাসায় অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করে র‌্যাব। অভিযান চালাকালে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে ফেসবুকে লাইভে আসেন পরীমনি। থানা পুলিশ ও ডিবি কর্মকর্তা এবং পরিচিতজনদের কাছে ফোন করে তাকে বাঁচানোর আহ্বান জানান। ৫ আগস্ট পরীমনির বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়। পরে তাকে আদালতে হাজির করা হয়। পরীমনিকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে আবেদন করে পুলিশ। এর মধ্যে ৭ আগস্ট এফডিসিতে সংবাদ সম্মেলন করে পরীমনির সদস্য পদ স্থগিতের কথা জানায় চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি। ৪ দিনের রিমান্ড শেষে ১০ আগস্ট আরও ২ দিনের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হয় তাকে।

জামিন আবেদন নাকচ করে ১৩ আগস্ট তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। পরীমনিকে রাখা হয় গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগারে। ১৯ আগস্ট পরীমনিকে তৃতীয় দফায় এক দিনের জন্য রিমান্ডে নেয় সিআইডি। ২২ আগস্ট পরীমনির পক্ষে তার আইনজীবীরা ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিন আবেদন করেন। পরে ৩১ আগস্ট তার জামিন হয়। ২৭ দিন কারাগারে থাকার পর ১ সেপ্টেম্বর কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পান পরীমনি।

পরীমনি জামিন পেলেও তাকে নিয়ে চলতে থাকে আলোচনা। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর মেহেদী দিয়ে হাতে লেখা বার্তা, আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে তার হাতের লেখা আলোচনার জন্ম দেয়। ২৪ অক্টোবর নিজের জন্মদিনে ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেলে জন্মদিন উদযাপন অনুষ্ঠানে লুঙ্গি পরা নিয়ে বিতর্ক হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

বছরের শেষ প্রান্তে এসে ৩০ দিনের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে অশ্লীল ছবি ও ভিডিও সরাতে আইনি নোটিশ পাঠানো হয় পরীমনিকে।

পরীমনিকে গ্রেপ্তারের পর সর্বস্তরে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে লেখক, কবি, রাজনীতিবিদ, অভিনয়শিল্পী, কণ্ঠশিল্পী খেলোয়াড়সহ সব শ্রেণির মানুষ এতে অংশ নেন। শুধু বাংলাদেশের গণমাধ্যমেই নয়, ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়া, বিবিসি, সংবাদ প্রতিদিন, আনন্দবাজার, জিনিউজ, হিন্দুস্তান টাইমস, আউটলুক ইন্ডিয়াসহ অনেক পত্রিকা পরীমনির সংবাদ গুরুত্ব সহকারে নিয়মিত প্রকাশ করে।

গোজামিলে ভরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের 'আকুল আবেদন'

'করোনার ভয়াবহতা ঠেকাতে বিধিনিষেধ আন্তরিক ও কঠোরভাবে পালনের আকুল আবেদন' জানিয়ে ৯ জুলাই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।

বিজ্ঞাপনে প্রতিষ্ঠান দুটি বিভিন্ন অভিযোগের জবাবে জানায়, করোনা মোকাবিলায় সে সময় পর্যন্ত তারা ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে চিকিৎসা সেবা দিয়েছে।

বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়, প্রতি ডোজ টিকা কিনতে তাদের ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার টাকা করে। প্রতিটি করোনা টেস্টের জন্য তাদের ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার টাকা করে। করোনা রোগীদের চিকিৎসায় প্রতিদিন ২০ হাজার টাকা হিসেবে ১০ দিনে প্রতি রোগীর জন্য ব্যয় ২ লাখ টাকা। এই খাতে তখন পর্যন্ত ব্যয় দেখানো হয় ২ হাজার কোটি টাকা।

সারা দেশে ১০০টি অক্সিজেন সেন্ট্রাল লাইন স্থাপনে ব্যয় দেখানো হয় ৩৫০ কোটি টাকা। ৯৭টি ল্যাব স্থাপনের জন্য ব্যয় দেখানো হয় ৩০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া, করোনা চিকিৎসা খাতে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও হোটেল ভাড়া খাতে ব্যয়ের পরিমাণ দেখানো হয় ২৩৩ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে সংসদ অধিবেশনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সমালোচনা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অথর্ব, বরাদ্দ অর্থ খরচের দক্ষতা ও সামর্থ্য তাদের নেই, দুর্নীতিতে ঠাসা—এসব অভিযোগের পাশাপাশি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর 'লজ্জা' নিয়েও কথা উঠে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী একাধিকবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলেছিলেন, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা প্রতি ডোজ টিকার দাম ৫ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪২৫ টাকা।

সেরামের টিকা বাদ দিলে সরকারি হিসাবে আরও সাড়ে ৩১ লাখ ৫০ হাজার টিকা কেনা হয়। সেখানে প্রতি ডোজের দাম দেখানো হয় ৮ হাজার ৭২২ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ডোজ ১০২ মার্কিন ডলার।

বিজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রতিদিন একজন করোনা রোগীর জন্য গড়ে ২০ হাজার টাকা খরচ করেছে সরকার। একজন রোগীকে গড়ে ১০ দিন হাসপাতালে থাকতে হয় এবং রোগী প্রতি ২ লাখ টাকা করে খরচ করে সরকার।

এ ছাড়া, আরটি পিসিআর পরীক্ষার ল্যাব স্থাপন, করোনা টেস্টসহ অন্যান্য খাতেও ব্যাপক ব্যয় দেখানো হয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ওই বিজ্ঞাপনের পক্ষে সাফাই গেয়ে বক্তব্যও দিয়েছিলেন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা

করোনা মহামারি শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়ে সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। এরপর ২০২১ সালের শুরু থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আবারও খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফেব্রুয়ারিতে সরকার ঘোষণা দেয় ৩০ মার্চ থেকে পর্যায়ক্রমে সব স্কুল ও কলেজ খুলে দেওয়া হবে। আবারও কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ বাড়লে সময় পিছিয়ে ২৩ মে থেকে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। পরে সংক্রমণের হার আরও বাড়তে থাকলে ৩১ জুলাই পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার।

এরপর ৫ সেপ্টেম্বর বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার চূড়ান্ত তারিখ ঘোষণা করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান শুরুর ঘোষণা দেন। তিনি জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার শুরুতে ২০২১ ও ২০২২ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে ৬ দিন ক্লাস হবে। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও একাদশ শ্রেণির ক্লাস হবে সপ্তাহে একদিন। স্কুল-কলেজ খুললেও অনলাইন ক্লাসও অব্যাহত থাকবে। টেলিভিশনেও প্রচার হবে ক্লাস।

শিক্ষার্থীদের হাফ পাসের দাবিতে আন্দোলন

সরকার ৪ নভেম্বর থেকে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১৫ টাকা করে বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। তারই ধারাবাহিকতায় গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা দেয় পরিবহন মালিক সংগঠনগুলো। বাসের ভাড়া বাড়ানোর পর থেকে শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া নেওয়া বন্ধ করে দেন পরিবহন মালিকরা।

এরপর 'ঠিকানা' পরিবহনের বাসে হাফ ভাড়া দেওয়া নিয়ে চালকের সহকারীর বিরুদ্ধে বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠে। তার প্রতিবাদে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। পরে ২১ নভেম্বর ওই বাসের চালক ও সহকারী আটক করা হয়।

তার আগে গণপরিবহনে অর্ধেক ভাড়া কার্যকর ও ধর্ষণের হুমকি প্রদানকারী বাসচালকের সহকারীকে গ্রেপ্তার, নারীদের জন্য অবাধ ও নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিতের দাবিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন রাজধানীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।

অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে চলা আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে সরকারের আশ্বাসে আন্দোলন স্থগিত করেন শিক্ষার্থীরা।

সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীর মৃত্যু, আবারও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) গাড়ির ধাক্কায় গত ২৪ নভেম্বর নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান নিহতের ঘটনার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আবারও রাস্তায় নামেন বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের জন্য রাস্তায় নেমেছিলেন। তখন কর্তৃপক্ষ নিরাপদ সড়কের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ২ বছরেরও বেশি সময়ে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি।

২০২১ সালের নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলা আন্দোলনে অংশ নেন রাজধানীর নটরডেম কলেজ, সরকারি বিজ্ঞান কলেজ ও হলিক্রস কলেজসহ অন্তত ১০টি কলেজ এবং স্কুলের শিক্ষার্থীরা।

এরপর ২৯ নভেম্বর রাজধানীর রামপুরায় অনাবিল পরিবহনের বাসচাপায় মাইনুদ্দীন ইসলাম দুর্জয় নামে আরও এক স্কুল শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তীব্র হয়।

সড়ক দুর্ঘটনার বিচার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে ১ ডিসেম্বর রাজধানীর রামপুরা ব্রিজের ওপর অবস্থান নিয়ে ১১ দফা দাবি উত্থাপন করেন বিভিন্ন স্কুল-কলেজের কয়েকশ শিক্ষার্থী।

তাদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দাবি হলো নাঈম ও মাইনুদ্দিন হত্যার বিচার, তাদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান, গুলিস্তান ও রামপুরা ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় পথচারী পারাপারের জন্য ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ, সারা দেশে সব গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ পাস সরকারি প্রজ্ঞাপন দিয়ে নিশ্চিত করা, ফিটনেস ও লাইসেন্সবিহীন গাড়ি এবং লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া, গাড়ি ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে বিআরটিএ'র দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।

Comments

The Daily Star  | English

Disrupting office work: Govt employees can be punished within 8 days

The interim government has moved to amend the Government Service Act-2018 to allow swift disciplinary action against its employees who will be found guilty of disrupting official activities.

7h ago