ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২০২১: হেফাজতের তাণ্ডব, পানিপথে যুদ্ধ, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মারামারি

ব্রাহ্মণবাড়িয়া- শুধু দেশেই নয়, এ বছর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও আলোচিত-সমালোচিত জেলা। এ জেলায় বহু ইতিবাচক দিক থাকলেও বছরজুড়ে সংবাদের শিরোনাম হয় মূলত নেতিবাচক ঘটনার জন্য।

২০২১ সালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠে এসেছে জেলার হেফাজতের তাণ্ডব ও ধ্বংসলীলা। ওই ঘটনায় ১৫ জনের প্রাণহানি ঘটে। টানা ৭ মাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন অচল থাকে।

চলতি বছরে 'পানিপথে যুদ্ধ' এই জেলার বহুল আলোচিত এক ঘটনা। বিজয়নগরে নৌকাডুবিতে ২২ জন নিহতের ঘটনাও গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া, সড়ক দুর্ঘটনাসহ নানা ঘটনায় অপমৃত্যু, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মধ্যে মারামারির ঘটনাও আলোচনায় ছিল।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বছরজুড়ে আলোচিত-সমালোচিত নানা ঘটনা নিয়ে এই আয়োজন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতের তাণ্ডব। ছবি: স্টার

হেফাজতের তাণ্ডব

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলতি বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হেফাজতের তাণ্ডব। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে জেলায় গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত তাণ্ডব চালায় হেফাজতে ইসলামের কর্মী-সমর্থক ও বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। সরকারি-বেসরকারি অন্তত ৫৮ স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন তারা।

ধ্বংসলীলা চালানোর পাশাপাশি অগ্নিসংযোগ করা হয় পুলিশ সুপারের কার্যালয়, ২টি মন্দির, সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন, ভূমি অফিস, জেলা পরিষদ কার্যালয়, পৌরসভা কার্যালয়, পৌর মিলনায়তন, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন ও জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারে।

হামলার শিকার হয়েছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাব। আক্রান্ত হয়েছিলেন কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী।

আগুনে পুড়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনের সিগন্যাল সিস্টেম, কন্ট্রোল প্যানেলসহ আসবাবপত্র ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র।

হামলার ঘটনা ঘটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকারের বাড়ি, অফিস ও তার শ্বশুরের বসতবাড়িতেও। একই সময়ে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বাড়িতে হামলা চালিয়ে আসবাবপত্র ও ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

সদর থানা ভবন, পুলিশের কার্যালয় এমনকি ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে চলাচলকারী আন্তঃনগর ট্রেনেও হামলা হয়।

নাশকতার পর যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদের রূপ নিয়েছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর। ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন ছিল সর্বত্র। চারদিকে ছিল পোড়া গন্ধ। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত মোট ৫৬টি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানায় ৪৯টি, আশুগঞ্জ থানায় ৪টি, সরাইল থানায় ২টি ও আখাউড়া রেলওয়ে থানায় একটি মামলা হয়। এজাহারে ৪১৪ জনের নাম ও অজ্ঞাতনামা আরও ৩৯ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনে আগুন দেয় মাদ্রাসা ছাত্ররা। ছবি: স্টার

রেলস্টেশন অচল ৭ মাস

হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা রেলস্টেশনে পেট্রোল-ডিজেল দিয়ে প্রথমে স্টেশনের কন্ট্রোল প্যানেলে আগুন দেন। এরপর তারা স্টেশনের টিকিট কাউন্টার, প্রধান বুকিং সহকারীর কক্ষ, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বিশ্রামাগারসহ ৭টি কক্ষে আগুন লাগিয়ে দেন।

যাত্রীদের বসার চেয়ারসহ সব আসবাবপত্র ভাঙচুর করে সেগুলো প্লাটফর্মের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

রেলস্টেশন ও রেলগেট এলাকায় অবস্থান নিয়ে পাটাতন ফেলে রেললাইন অবরোধ এবং রেললাইনের পাশে স্তূপ করে রাখা কাঠের স্লিপার লাইনের ওপরে এনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

স্টেশনের সিগন্যাল সিস্টেম পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পরদিন ২৭ মার্চ থেকে এই স্টেশনে সব ট্রেনের যাত্রাবিরতি স্থগিত করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

এরপর থেকে সীমাহীন কষ্টে ভোগে জেলাবাসী। বাধ্য হয়ে সড়কপথে যাতায়াতের পাশাপাশি অন্য দূরবর্তী রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে উঠতে হয় তাদের।

নাশকতার পর 'বি' ক্লাসের মর্যাদার এই স্টেশন 'ডি' ক্লাসে পরিণত হয়। দীর্ঘ প্রায় ৭ মাস বন্ধ থাকার পর নতুন করে মেরামত শেষে গত ১৪ নভেম্বর থেকে পুরোপুরি সচল হয় স্টেশনটি।

পানিপথে দুই গ্রামবাসীর মধ্যে টেটাযুদ্ধ। ছবি: স্টার

পানিপথে যুদ্ধ

গত ২১ আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে ২ গ্রামবাসীর মধ্যে মাঝ নদীতে নৌকা নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচিত হয়।

পাকশিমুল ইউনিয়নের পরমানন্দপুর ও ফতেহপুর গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে এ সংঘর্ষ ঘটে। সেসময় গ্রামের মধ্যবর্তী কড়াগাঙ এলাকায় উভয় গ্রামের লোকজন নৌকায় করে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন।

সংঘর্ষের সময় গ্রামগুলোয় থাকা নারী ও শিশুদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপকভাবে আলোচিত-সমালোচিত হয়।

ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মারামারিতে আহত নওয়াব মিয়া। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্ব গণমাধ্যমে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মারামারি

গত ৬ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার সাদেকপুর ইউনিয়নের দামচাইল বাজারে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মধ্যে ২ দফা মারামারি হয়। ওই ঘটনায় ৪ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ সংবাদ দেশের গণমাধ্যমের পাশাপাশি বিবিসি, সিএনএন, রয়টার্স, এএফপিসহ নানা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে স্থান পায়।

এ ছাড়াও, এই সংঘর্ষের সংবাদ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে আর্জেন্টিনার একমাত্র ইংরেজি সংবাদমাধ্যম। সেখানকার 'বুয়েনস আইরেস টাইমস' ওই সংবাদ তাদের অনলাইনের ক্রীড়া বিভাগে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে।

সংবাদে বলা হয়, বাংলাদেশে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ফুটবল ম্যাচ নিয়ে উন্মাদনা নতুন কিছু নয়। ফুটবল পাগল এ জাতি দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ২ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মুখোমুখি হলে ২ ভাগে ভাগ হয়ে পড়ে। এএফপি'র বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার মধ্যে কোন দেশ ভালো খেলে, ২ জনের মধ্যে তা নিয়ে তর্কে হাতাহাতি হয়। তাদের সঙ্গে যোগ দেন আরও কিছু ভক্ত। পরে বাজারে একা পেয়ে ৪ জনকে পিটিয়ে আহত করা হয়।

কোপা আমেরিকার ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয় ব্রাজিলের মারাকানা স্টেডিয়ামে, যেখান থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দূরত্ব প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার। অথচ ওই দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কর্মরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে থাকতে হয় সতর্ক অবস্থানে। জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে মাইকিং করার পাশাপাশি ফাইনাল খেলার দিনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েনের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে।

লইসকা বিলে শতাধিক যাত্রী নিয়ে নৌকাডুবির ঘটনায় নিহত হন ২২ জন। ছবি: স্টার

বিজয়নগরে নৌকাডুবিতে নিহত ২২

গত ২৭ আগস্ট বিয়োগান্তক এক ঘটনা ঘটে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে। উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের লইসকা বিলে শতাধিক যাত্রীবোঝাই ইঞ্জিনচালিত নৌকার সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে আসা ২টি বালুবোঝাই বাল্কহেডের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ওই ঘটনায় ২২ জনের মৃত্যু হয়, যাদের মধ্যে ছিল ৯ শিশু।

বিজয়নগরের চম্পকনগর বাজার ঘাট থেকে ১০০'র বেশি যাত্রী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের আনন্দবাজার ঘাটে যাচ্ছিল নৌকাটি। লইসকা বিলের দেওদুনায় বাল্কহেডের সঙ্গে সংঘর্ষে নৌকাটি উল্টে যায়। সেসময় নৌকার ছাদে থাকা বেশিরভাগ পুরুষ সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হলেও নৌকার ভেতরে থাকা নারী ও শিশুরা ডুবে মারা যান।

নৌকাটিতে স্বাভাবিকের তুলনায় অতিরিক্ত যাত্রী ছিল। ২২ জনের প্রাণহানির ঘটনায় ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তাদের মধ্যে ৫ জন কারাগারে আছেন।

নাটঘর ইউনিয়নের কুড়িঘর গ্রামে দুর্বৃত্তদের গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন এরশাদুলের সহযোগী বাদল। পরে ঢাকায় নেওয়ার পথে গুলিবিদ্ধ এরশাদুল মারা যান। ছবি: স্টার

নবীনগরে জোড়া খুন

গত ১৭ ডিসেম্বর রাতে জেলার নবীনগর উপজেলার নাটঘর ইউনিয়নের কুড়িঘর গ্রামে গুলিতে খুন হন ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী এরশাদুল হক ও তাকে বহনকারী মোটরসাইকেলচালক বাদল সরকার।

এ ঘটনায় অপর ২ চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ ১৫ জনকে আসামি করে নবীনগর থানায় মামলা করেন নিহতের ভাই মো. আখতারুজ্জামান।

পুলিশ ওই ঘটনায় জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি আশরাফুল ইসলাম রাব্বিসহ ২ জনকে গ্রেপ্তার করে।

গ্রেপ্তারের পর পুলিশ ও আদালতের কাছে হত্যার ঘটনা স্বীকার করে বিস্তারিত জবানবন্দি দেন রাব্বি।

এই জোড়া খুনের ঘটনা জেলাজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। প্রত্যন্ত গ্রামে পিস্তলের ব্যবহারে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

আগামী ৩১ জানুয়ারি ওই ইউনিয়নে নির্বাচন হবে। জোড়া খুন ও এ ঘটনার সঙ্গে ২ চেয়ারম্যান প্রার্থী জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

Comments

The Daily Star  | English

‘Salma was killed by tenant, not her son’

Salma was killed by her “drug peddler” tenant, not by her 19-year-old son, said police yesterday contradicting Rab’s claim.

4h ago