সৈয়দ শামসুল হকের খোঁজে

'আমারে যেদিন তুমি ডাক দিলা তোমার ভাষায়

মনে হইল এ কোন পাখির দ্যাশে গিয়া পড়লাম,

এ কোন নদীর বুকে এতগুলা নায়ের বাদাম,

এত যে অচিন বৃক্ষ এতদিন আছিল কোথায়?'

কথাগুলো লেগেছিল পরানের গহিন ভিতরে। যিনি লিখেছিলেন, তিনি সৈয়দ শামসুল হক- থেকে গেলেন মরমের মন্দিরে। তারুণ্যের প্রথম প্রহরে দুর্দান্ত এই আবেগের কাছে পরাস্ত না হয়ে পারা যায়নি। এক টানে পড়া শেষ হয়ে গিয়েছিল 'পরানের গহীন ভিতরে' বইটি। স্মৃতির ভেতর ঢুকে পড়েছিল অনেক অনেক উড়ন্ত লাইন।

তারপর পড়েছিলাম 'বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা'। অমিত্রাক্ষর ছন্দের এক সমকালীন প্রয়োগ দেখতে পেয়েছিলাম। চোখে ধাঁধা লাগিয়েছিল 'গেরিলা' কবিতাটি। এক পঙক্তিতেও যে কবিতা লেখা যেতে পারে তাও জেনেছিলাম সৈয়দ হকের কল্যাণে। করুণ কঠোর অথচ আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল 'খেলারাম খেলে যা' উপন্যাসের বাবরকে। পুরনো বইয়ের স্তূপ ঘেঁটে একদিন হাতে তুলে নিয়েছিলাম সৈয়দ হকের একটি কাব্য উপন্যাস। দৈনিক সংবাদের পাতায় 'হৃৎকলমের টানে' এঁকে দিয়েছিলেন চিন্তার বিভিন্ন অনুষঙ্গ। লেখালেখির শুরুর দিনগুলোতে এভাবেই আমাদের প্রাত্যহিকতার সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। কিন্তু তার সব লেখাই কি ভালো লেগেছিল?

দ্বিধার কুয়াশা ঝেড়ে বলতে পারি, ভালো লাগেনি। 'পরানের গহিন ভিতরে'র কবিতাগুলো বাদে সৈয়দ হকের খুব কম কবিতাই স্পর্শ করেছে মনের অতল। তবে ভালো লেগেছিল বেশ কিছু গান। নজর কেড়েছিল কিছু উপন্যাস। ভালো লেগেছিল কিছু গল্প। সৈয়দ হকের গল্পগুলোতেও ছিল নতুন অভিজ্ঞতা আবিষ্কারের আনন্দ। কোনো কোনো বইয়ের মাঝপথে এসে ঘুচে গেছে পড়ার স্পৃহা। 'বিম্বিত কবিতাগুলো' নামে অনুবাদ কবিতার একটি ধারাবাহিক লেখা ছাপা হয়েছিল দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে। ভালো লেগেছিল অনুবাদ। খুব স্পর্শ করেছিল 'নুরুল দীনের সারাজীবন', 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়'। 'কথা সামান্যই' বইয়ের অসামান্য কথাগুলো ভাবনার খোরাক জুগিয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী, সৈয়দ হকের বিরাট রচনাবলী থেকে আমি বেছে নিতে পেরেছিলাম কিছু কবিতা, কয়েকটি উপন্যাস, কাব্যনাট্য, ব্যক্তিক কিছু গদ্য। আমার কাছে অসম্ভব মনে হয়েছিল সমস্ত রচনার পাঠ। যেমন এক জীবনে অসম্ভব ঠেকে রবীন্দ্রনাথ কিংবা বুদ্ধদেব বসুর সমগ্র রচনার আস্বাদন।

ব্যর্থতার এই বোধ মেনে নিয়েই সৈয়দ হকের লেখার কাছে আমি যাই। চোখ রাখি তার লেখালেখির পৃথিবীতে। ভালো লাগা কিংবা মন্দ লাগার তরঙ্গ পেরিয়ে স্থির হয়ে ভাবি, কেন পড়লাম? কেন পড়ছি? বাংলাদেশের সাহিত্যে সৈয়দ হকের মৌলিকত্ব কী? প্রশ্নগুলো সাদাসিধা। তবে জবাবগুলো মোটেও সরল মনে হয় না। মূলত সাহিত্য বিষয়ক সাংস্কৃতিক অভ্যাসের প্রেক্ষাপটে জবাবগুলো খুঁজতে হয়। ভেবে নেই, আধুনিকতাবাদীদের সিলসিলায় সৈয়দ হক এক বাংলাদেশি সংস্করণ। বিশ শতকের প্রথম তিন-চার দশক জুড়ে ইউরোপের বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যে আধার, আধেয়, ভাষা ও শৈলি ঘিরে যেসব অনুশীলন চলেছিল তার সঙ্গে সৈয়দ হকের যোগ আদি ও অন্তের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে জুড়ে থাকে তার নাম। কেননা এদের প্রত্যেকে বিরামহীনভাবে লিখে গেছেন নানা স্বাদের লেখা। এতে করে বাংলা সাহিত্যের বিস্তৃত ভাণ্ডারে যুক্ত হয়েছে নতুন উপাদান।

মনে পড়ে হুমায়ুন আজাদ একবার বলেছিলেন, সৈয়দ হক বাংলাদেশের সব চেয়ে আঙ্গিক সচেতন লেখক। আজাদ বাড়তি কিছু বলেননি। সৈয়দ হকের ক্ষেত্রে এই অভিধা শতভাগ সত্য বলেই ধরে নেওয়া যায়। মাহমুদুল হক অবশ্য প্রশংসা করেছেন সৈয়দ হকের কবিতার। সাহিত্যের নানা আঙ্গিকে বিচরণ করেছেন সৈয়দ হক, সাহিত্যের বন্দরে নামিয়ে দিয়েছেন অভিনব শস্য। প্রকৃতপক্ষে তিনি নেমেছিলেন আঙ্গিক ও আধুনিকতার খোঁজে, আঙ্গিক দিয়ে পৌঁছুতে চেয়েছিলেন আধুনিকতায়। তা না হলে গ্রিক পুরাণের একটি গল্পরেখাকে কী করে বাঁধলেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক 'নিষিদ্ধ লোবানে'র কাহিনী কাঠামোতে?

সৈয়দ হকের আঙ্গিক সচেতনতার তাত্ত্বিক নিদর্শন 'মার্জিনে মন্তব্য'। এ বইয়ে সাহিত্যের আঙ্গিক বিষয়ে অনেকগুলো আলাপ তুলেছিলেন তিনি। বইটির লক্ষ্যই ছিল সাহিত্যের গঠন কৌশল সম্পর্কে ধারণা দেওয়া। যারা প্রথম লিখতে আসেন, তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই বই। দীর্ঘ ভূমিকায় সৈয়দ হক আঙ্গিকের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও বৈচিত্র্য সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা হাজির করেছেন। একটি অংশে বলেছেন, 'লেখার জন্য মহৎ বিষয় পথে পড়ে পাওয়া যায়। লেখাটি মহৎ হয়ে ওঠে, কিম্বা যোগ্যই একটি লেখা, সে কেবল আঙ্গিকের কারণে'। আরেকটি অংশে বলেছেন, 'আঙ্গিকটাই আমাদের মনে রচনা করে বক্তব্যের জগত, বক্তব্যের বিভা, বক্তব্যের সংকেত'। বোঝা যাচ্ছে সৈয়দ হক আঙ্গিক-মুখ্য লেখক, যিনি মনে করেন সংকেতের পর সংকেত যোগে তৈরি হয় সাহিত্য।

'গল্পের কলকব্জা' ও 'কবিতার কিমিয়া' নামে বিভক্ত দুটো অংশে বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে শিল্প ও শিল্পীর সম্পর্ক, সাহিত্যের ভাষা, গল্পের সংলাপ, লেখকের বিবরণ, গল্প-উপন্যাসের স্বতন্ত্রতা, কবিতার লক্ষ্য, ভাষা, ছন্দ, সংবাদ তথ্য ও কবিতার সম্পর্ক ইত্যাদি। এ বইয়ে খুলে গেছে লেখালেখির বিশাল একটি জগত। লেখা কীভাবে লেখা হয়ে ওঠে- এই প্রশ্নের নানা মাত্রিক জবাব পাওয়া যায় 'মার্জিনে মন্তব্য' বইটিতে। খুব দামি একটি কথা বলেছেন সৈয়দ হক, তা হলো- 'আঙ্গিক, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্তব্য নয়, এটি অর্জনের ব্যাপার'। কিন্তু এই অর্জন 'কেবল আঙ্গিকচর্চার পথে সম্ভব নয়'। তাহলে কোন পথে অর্জিত হবে? সৈয়দ হকের ভাষ্যে, অবধারিতভাবে তাকাতে হবে জীবন ও অভিজ্ঞতায়। আর তা-ই তৈরি করে দেবে 'দৃষ্টিভঙ্গির নিজস্বতা'।

স্বভাব কবিত্বের এই দেশে আঙ্গিকের পরিচর্যা ও বিচিত্রতাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এই দিক থেকে সৈয়দ হক ভিন্ন বাস্তবতাকেই হাজির করেছেন। সৃষ্টিশীল সাহিত্য রচনার কলাকৌশল নিয়ে বাংলা ভাষায় বইয়ের সংখ্যা খুবই কম। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর 'কবিতার ক্লাস' একটি ক্লাসিক বই হিসেবে আজও পড়া হয়ে থাকে। কিন্তু গদ্যপদ্য মিলিয়ে সৈয়দ হকের বইটি বিশেষভাবে মনে রাখার মতো উপহার। অথচ বাঙালি কবি-লেখকের পাঠ অভিজ্ঞতার বিবরণে এ বইয়ের নাম-ডাক তেমন একটা শোনা যায় না।

প্রশ্ন হলো- আঙ্গিকের অভিনবত্ব অনুসন্ধানের সাংস্কৃতিক রাজনীতি কি সৈয়দ হক বুঝতে পেরেছিলেন? সচেতন ছিলেন আঙ্গিকের রাজনীতি সম্পর্কে? যেমন বুঝতে পেরেছিলেন এইমে সেজায়ার, ডেরেক ওয়ালকট কিংবা নগুগি ওয়াথিওঙ্গো। সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও নন্দনতাত্ত্বিকভাবে তারাও তো আধুনিকতার সন্তান। ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতায় আঙ্গিককে তারা আত্তীকৃত করেছেন নিজেদের ইতিহাস ও প্রতিরোধী চৈতন্য দ্বারা রূপান্তরিত করে। এইমে সেজায়ারের কবিতায় পরাবাস্তবতাবাদ যেমন হয়ে উঠেছিল শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে উচ্চারিত কাব্যভাষা। পরাবাস্তবতাবাদের অযুক্তি, স্বপ্ন, কল্পনা, বাস্তব-অবাস্তবের সীমানা লঙ্ঘন সেজায়ারকে এই বোধ দিয়েছিল যে, আমাদের ইতিহাসও বিচূর্ণীকৃত, নরম-কোমল সৌন্দর্যের চাদরে মোড়ানো নয় আমাদের বাস্তবতা, আমরা দাস, আমরা কালো, ভেঙে পড়েছে আমাদের সংস্কৃতির সেতু। সৈয়দ হক এমন করে ভাবেননি।

তিরিশ-চল্লিশের দশকে শুদ্ধ সাহিত্যের যে আধুনিকতাবাদী ধরন গড়ে উঠেছিল, সৈয়দ হক মূলত সেই ছক থেকে উদ্ভূত। এ কারণে ইউরোপ প্রভাবিত আঙ্গিক ও আধুনিকতার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সমালোচনা সৈয়দ হকের লেখায় অনুপস্থিত। অনেক ক্ষেত্রে পশ্চিমের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য সৈয়দ হকের নন্দনতাত্ত্বিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যেমন: কাব্যনাট্য সংগ্রহের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, এলিয়ট তার 'করোটি ক্রয়' করে নিয়েছে। মূলত টিএস এলিয়টের কাব্যনাটক দ্বারা আলোড়িত হয়েছিলেন তিনি। 'করোটি ক্রয়ে'র উৎপ্রেক্ষাটি বাঙালির ঔপনিবেশিক দাসত্বের ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেয়। উনিশ শতকের সাংস্কৃতিক অভ্যাসে একইরকম আলোড়ন তুলেছিলেন শেকসপিয়র। এরপর ধীরে ধীরে বাংলা সাহিত্যের পশ্চিমীকরণ ঘটেছিল। তিরিশের দশকে তাড়িত করলেন এলিয়ট, পঞ্চাশের দশকে বিহ্বল করলেন বোদলেয়ার। এসবের ধারাবাহিকতায় ঘটেছে সৈয়দ শামসুল হকের বিস্তার।

একবার এক সেমিনারে বসেছিলাম। এসেছেন সৈয়দ হক। বক্তৃতা করছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সাহিত্য নিয়ে। ভরাট গলায় টেনে টেনে কথা বলছেন। বক্তৃতা শেষে শ্রোতাদের ভেতর থেকে একজন দাঁড়িয়ে মন্তব্য ও প্রশ্ন করলেন, 'ওয়ালীউল্লাহ তো আঙ্গিকগত দিক থেকে পাশ্চাত্য দ্বারা প্রভাবিত... এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?' সৈয়দ হক পাল্টা প্রশ্ন করলেন, 'এতে কি বাংলা সাহিত্য ক্ষীণ হয়েছে?' পিনপতন নীরবতা পড়ে গেলো সেমিনার কক্ষটিতে। প্রশ্নকর্তা দ্বিধান্বিত, খানিকটা ভড়কে গেলেন। তিনি হয়ত বলতে পারতেন, ধরে নিলাম বাংলা সাহিত্যে এতে করে বিশাল বপুই হয়েছে, কিন্তু ইউরোপ আর আমেরিকাই কেন বাঙালির অনিবার্য আরাধ্য? কেন আফ্রিকা নয়, আরব অঞ্চল নয়, রাশিয়া নয়, জাপান কিংবা চিন নয়?

সৈয়দ হক খুব গভীরে গেলেন না। সব সভ্যতা ও সংস্কৃতি থেকে উপাদান ও উপকরণ গ্রহণের যে ভাববাদী কথা বলা হয়ে থাকে তারই বিস্তার ঘটালেন। কিন্তু কোনো সংস্কৃতি থেকে কেন গ্রহণ করব আর করব না, পরিগ্রহণের মনস্তত্ত্ব কী, তার জবাব পাওয়া গেলো না তার বক্তব্য থেকে। তা না পাওয়া যাক, সৈয়দ হক বাংলাদেশের সাহিত্যে উত্তরসূরি তরুণদের কারও কারও মধ্যে টেকনিকের সচেতনতা বইয়ে দিতে পেরেছেন, সাহিত্যের ইতিহাসে এটি কম বড় কথা নয়। নন্দনতাত্ত্বিক কলাকৌশলের সচেতনতাই তাকে নিয়ে গিয়েছিল বিচিত্র আঙ্গিকে, আর তাই 'সব্যসাচী' অভিধাটি তাকেই মানায়।

সুমন সাজ্জাদ: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English

Private investment sinks to five-year low

Private investment as a percentage of the gross domestic product has slumped to its lowest level in five years, stoking fears over waning business confidence and a slowdown in job creation.

10h ago