বুস্টার হিসেবে কোন টিকা বেশি কার্যকর
করোনাভাইরাসের এযাবৎ কালের সবচেয়ে বেশি সংক্রামক ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন এরই মধ্যে পৃথিবীর ৯৫টি দেশে ছড়িয়ে পরেছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় এই ভ্যারিয়েন্টটির সূত্রপাত হলেও এর মূল কেন্দ্রস্থল এখন যুক্তরাজ্য। ইউরোপের অন্যান্য দেশেও ওমিক্রন ছড়িয়ে পরছে ত্বরিত গতিতে। ওমিক্রনের হাত থেকে রক্ষা পেতে যুক্তরাজ্যে সবাইকেই করোনা টিকার তৃতীয় ডোজ বা বুস্টার ডোজ দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে দেশটির ৫৩ শতাংশ মানুষকে টিকার তৃতীয় ডোজ দেওয়া হয়ে গেছে।
এখন কথা হচ্ছে, বুস্টার ডোজ কি আমাদেরকে ওমিক্রনের হাত থেকে রক্ষা করবে?
ইউকে সিকিউরিটি এজেন্সির প্রাথমিক গবেষণা মতে ৬ মাস আগে যারা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার ২টি ডোজ নিয়েছেন, ওমিক্রন সংক্রমণের বিরুদ্ধে তাদের সুরক্ষা প্রায় শূন্য শতাংশ এবং ফাইজারের ২ ডোজ টিকার ক্ষেত্রে এ সংখ্যাটি ৩৫ শতাংশের কিছুটা বেশি। তবে যারা অ্যাস্ট্রাজেনেকা বা ফাইজার টিকার তৃতীয় ডোজ বা বুস্টার ডোজ নিয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে ওমিক্রনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ। অর্থাৎ ওমিক্রনের হাত থেকে রক্ষা পেতে ঝুঁকিপূর্ণ সবাইকে টিকার বুস্টার ডোজ নেওয়া অতি জরুরি।
যুক্তরাজ্যে এখন পর্যন্ত ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার মানুষ। এর মধ্যে মারাত্মক অবস্থা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৯৫ জন এবং মারা গেছেন ১৮ জন (২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত)। হাসপাতালে ভর্তি ১৯৫ জনের ৮০ শতাংশই করোনার কোনো টিকাই নেননি। ওমিক্রনসহ অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে টিকার গুরুত্ব অপরিসীম। এ কারণেই মহামারির নতুন ঢেউকে সামনে রেখে বুস্টার ডোজ দেওয়ার তোড়জোড় চলছে সব দেশেই।
বুস্টার ডোজ দেওয়ার ক্ষেত্রে তৃতীয় ডোজটি কোন টিকা দিয়ে দেওয়া হবে তা সঠিকভাবে নির্বাচন করা অত্যাবশ্যকীয়। কারণ টিকাভেদে রিঅ্যাকশন এবং ইমিউন রেসপন্স আলাদা হয়। এ ছাড়া মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ বা হেটারোলোগাস টিকা প্রদানে কম্প্যাটিবিলিটি ইস্যু তো রয়েছেই।
বাংলাদেশে বুস্টার ডোজ দেওয়া শুরু হয়েছে। আমাদের দেশে বর্তমানে মজুদ রয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা (কোভিশিল্ড), ফাইজার, মডার্না এবং সিনোফার্মের টিকা। দেশে বেশিরভাগ মানুষকে প্রাথমিক ২টি ডোজ দেওয়া হয়েছে কোভিশিল্ড বা অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং সিনোফার্মের টিকা দিয়ে। এখন তৃতীয় ডোজ কোনটি দেওয়া হবে? অ্যাস্ট্রাজেনেকা নাকি সিনোফার্ম বা ফাইজার?
তৃতীয় বা বুস্টার ডোজে কোন টিকা দিলে সংক্রমণ রোধে বেশি সহায়ক হবে তা দেখার জন্য যুক্তরাজ্যে সম্প্রতি একটি মাল্টিসেন্টার ফেইজ-২ ট্রায়াল হয়েছে। এই ট্রায়ালে মোট ৭টি টিকা পরীক্ষা করা হয়েছে। মূলত দেখা হয়েছে যাদেরকে অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রাথমিক ২ ডোজ অথবা ফাইজারের প্রাথমিক ২ ডোজ দেওয়া হয়েছিল, তাদেরকে কোন টিকা দিয়ে বুস্টার ডোজ দিলে কেমন ইমিউন রেসপন্স এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়। গত ১৬ ডিসেম্বর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই গবেষণার ফলটি প্রকাশিত হয়েছে বিখ্যাত জার্নাল ল্যানসেটে।
এতে দেখা যায়, যারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার ২টি প্রাথমিক ডোজ পেয়েছিলেন তাদেরকে অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৃতীয় ডোজ দিলে এন্টিবডি টাইটার বাড়ে ৩ গুন, ভাইরাস নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি বাড়ে আড়াইগুণ এবং টি-সেল রেসপন্সের কোনো বৃদ্ধিই হয় না। অন্যদিকে, তৃতীয় ডোজটি যদি দেওয়া হয় ফাইজার দিয়ে, তাহলে এন্টিবডি টাইটার বাড়ে ২৪ গুন, ভাইরাস নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি বাড়ে ২৫ গুন এবং টি-সেল রেসপন্সের বৃদ্ধি হয় ৩ থেকে ৪ গুন। তৃতীয় ডোজ মডার্নার টিকা দিলে ফলাফল ফাইজারের টিকার মতোই পাওয়া যায়। আর যখন তৃতীয় ডোজটি দেওয়া হয় নোভাভ্যাক্স দিয়ে তখন এন্টিবডি টাইটার এবং নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি বাড়ে ৬ থেকে ৮ গুন এবং টি-সেল রেসপন্স বাড়ে প্রায় ৪ গুন। তৃতীয় ডোজ জনসন অ্যান্ড জনসনের অ্যাড-২৬ দিলে উভয় এন্টিবডি টাইটার বাড়ে প্রায় ৬ গুন এবং টি-সেল রেসপন্স বাড়ে প্রায় ৩ গুন। ভ্যালনেভা নামক ফ্রান্সের একটি কিল্ড টিকা দিয়ে তৃতীয় ডোজ দিলে এন্টিবডি ও নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি টাইটার বাড়ে দ্বিগুণ। তবে টি-সেল রেসপন্সের বৃদ্ধি ঘটে খুবই সামান্য। এই টিকাটি অনেকটা চীনের সিনোফার্ম টিকার মতোই।
অন্যদিকে, যাদেরকে ফাইজারের প্রাথমিক ২ ডোজ দেওয়া হয়েছিল তাদেরকে অ্যাস্ট্রাজেনেকা দিয়ে তৃতীয় ডোজ দিলে এন্টিবডি টাইটার এবং নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি বৃদ্ধি প্রায় ৫ গুন এবং টি-সেল রেসপন্স বাড়ে প্রায় ৩ গুন। আর এই গ্রুপকে যদি তৃতীয় ডোজ দেওয়া হয় ফাইজার টিকা দিয়ে তাহলে এন্টিবডি টাইটার এবং নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি বৃদ্ধি প্রায় ৬ থেকে ৮ গুন এবং টি-সেল রেসপন্স বাড়ে প্রায় ৩ গুন। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে তৃতীয় ডোজের কার্যকারিতা অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং ফাইজারের বেলায় প্রায় সমান। আর মডার্নার টিকা দিয়ে তৃতীয় ডোজ দিলে এন্টিবডি টাইটার এবং টি-সেল রেসপন্স বাড়ে যথাক্রমে ১১ গুন এবং ৪ গুন। নোভাভ্যাক্সের ক্ষেত্রে এন্টিবডি টাইটার এবং টি-সেল রেসপন্স বৃদ্ধি পায় যথাক্রমে ৩ থেকে ৪ গুণ এবং দেড়গুণ। তবে তৃতীয় ডোজ হিসেবে ভ্যালনেভা এ ক্ষেত্রে অনেকটাই অকার্যকর।
একটি টিকা কতটুকু কার্যকর হবে তা নির্ভর করে টিকা দেওয়ার পরে তা শরীরে কতটুকু নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি এবং টি-সেল রেসপন্স তৈরি করে তার উপর। হেটারোলোগাস বুস্টারের ক্ষেত্রে টিকার যে কম্বিনেশন বেশি ইমিউনোজেনিক রেসপন্স তৈরি করবে সেই কম্বিনেশনই প্রয়োগ করা উত্তম। উপরের ট্রায়াল রেজাল্ট থেকে যা দেখা যায় তার সারমর্ম নিম্নরূপ:
১. অ্যাস্ট্রাজেনেকার ২ ডোজ টিকার পরে বুস্টার ডোজ হিসেবে সবচেয়ে বে< কার্যকর ফাইজার বা মডার্না। নোভাভ্যাক্স ও জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকাও বেশ কার্যকর। তবে, এ ক্ষেত্রে তৃতীয় ডোজ হিসেবে অ্যাস্ট্রাজেনেকা বা ভ্যালনেভার টিকা খুবই কম কার্যকর। সুতরাং যারা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ২ ডোজ টিকা নিয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা বুস্টার হিসেবে না দেওয়াই ভালো। যুক্তরাজ্যে এভাবেই বুস্টার ডোজ দেওয়া হচ্ছে।
২. ফাইজারের ২ ডোজ টিকার পরে বুস্টার ডোজ হিসেবে অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার, মডার্না, নোভাভ্যাক্স এবং জনসন অ্যান্ড জনসন টিকার সবগুলোই কার্যকর। তবে, এ ক্ষেত্রে বুস্টার ডোজ হিসেবে ভ্যালনেভার টিকা একেবারেই অকার্যকর।
বাংলাদেশে সিনোফার্মের টিকা দেওয়া হচ্ছে ব্যাপকভাবে। সিনোফার্ম এবং ভ্যালনেভার টিকা একই প্রকৃতির। তাই উপরের ট্রায়ালের উপর ভিত্তি করে অনেকটাই বলা যায়, যেসব ক্ষেত্রে প্রাথমিক ২ ডোজ দেওয়া হয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা বা ফাইজারের টিকা দিয়ে, সেসব ক্ষেত্রে বুস্টার ডোজের বেলায় সিনোফার্মের টিকা না ব্যবহার করাই উত্তম। কারণ এই কম্বিনেশন কাজ নাও করতে পারে। যেমনটি হয়েছে ভ্যালনেভার বেলায়। তবে, যেসব ক্ষেত্রে প্রাথমিক ২ ডোজ দেওয়া হয়েছে সিনোফার্ম দিয়ে, সেসব ক্ষেত্রে তৃতীয় ডোজ হিসেবে সিনোফার্মের টিকা ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রথাগতভাবে এই পদ্ধতি কাজ করার কথা। এ ছাড়াও সিনোফার্মের প্রাথমিক ডোজের সঙ্গে হেটারোলোগাস ডোজ হিসেবে এমআরএনএ টিকা যেমন ফাইজার বা মডার্না ব্যবহার করা যেতে পারে।
উপরের ইমিউনোজেনিক রেসপন্সের তথ্যগুলো নেওয়া হয়েছে তৃতীয় ডোজের ২৮ দিন পরে। তবে ট্রায়াল রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, বুস্টার ডোজ দেওয়ার এক সপ্তাহ পর থেকেই শরীরে এন্টিবডি টাইটার এবং টি-সেল রেসপন্স বৃদ্ধি পায় দ্রুত হারে। অর্থাৎ তৃতীয় ডোজের এক সপ্তাহ পর থেকেই ইমিউন বুস্ট-আপ হয় এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কত দিন পর বুস্টার ডোজ নিতে হবে?
যুক্তরাজ্যের এক গবেষণা অনুযায়ী, দ্বিতীয় ডোজের ৬ মাস পর ওমিক্রণ সংক্রমণের বিরুদ্ধে আর কোনো প্রতিরোধ থাকে না। দ্বিতীয় ডোজের মেয়াদ ৬ মাস হয়ে গেলেই তাকে বুস্টার ডোজ নিতে হবে। বিশেষ করে যাদের বয়স ষাটোর্ধ অথবা যারা বিভিন্ন রকম রোগে ভুগছেন, যাদের ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে বা যারা অতিরিক্ত মোটা, তাদের জন্য বুস্টার ডোজ অত্যন্ত জরুরি। দ্বিতীয় ডোজের ৩ থেকে ৬ মাসের ভেতরেই বুস্টার নেওয়ার উপযুক্ত সময়।
সঠিক সময় সঠিক টিকা কোভিড থেকে জীবন বাঁচাচ্ছে। তবে এই মহামারি সময়টিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং সঠিক ভাবে মাস্ক ব্যবহার করার কোনো বিকল্প নেই।
ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম: এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি, সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments