মদনমোহন অন্নছত্র ট্রাস্ট: বিনামূল্যে খাবার মেলে যেখানে
গুলিস্তান এলাকার হকারের হাঁকডাক পেরুতেই নবাবপুর রোড। সেখানেও নানা পণ্য কিনতে ভিড় জমান হাজারও মানুষ। গমগমে শব্দের মধ্যে নীরবতা নেমে আসে শ্রীশ্রী রাধাশ্যাম জিউ ঠাকুর বিগ্রহ মন্দির প্রাঙ্গণে। এর উঠানে গত ৯৭ বছর ধরে দরিদ্র মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিনিময়ে কোনো টাকা নেওয়া হয় না।
রোববার সকাল ৯টা। হালকা শীত নেমে আসা শহরে কুয়াশা ঢাকা পথ পেরিয়ে নবাবপুর রোডে প্রবেশ। তখনও বেশিরভাগ দোকানের ঝাঁপি খোলেনি। নবাবপুর রোডের ২ পাশের হার্ডওয়্যারের দোকানগুলোর ভেতরের সরু গলিটি এসে থেমেছে মন্দিরের দরজায়। ভেতরে ঢুকতেই নজরে আসে একদল সারিবদ্ধ মানুষ। মন্দির প্রাঙ্গণের সংকীর্ণ করিডোরের ২ পাশে থালা হাতে বসে আছেন নানা বয়সের জনা পঞ্চাশেক নারী-পুরুষ। একপাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় আরও প্রায় ৩০ জন।
বসে থাকা মানুষের ক্ষুধা নিবারণে ৩টি বড় লোহার বালতি হাতে কয়েকজন বেরিয়ে এলেন। এসেই বসে থাকা মানুষের থালায় তুলে দিলেন ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, ৫ রকমের সবজির তরকারি আর ডাল। ঝটপট খেয়ে উঠে গেল এক দল। তাদের জায়গায় বসলেন অপেক্ষমানরা। অনেকেই সঙ্গে নিয়ে আসা বাক্সে ভরে নিলেন খাবার।
খেতে আসা মালেক মিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি এখানে গত ২০ বছর ধরে খাই। খাবারের স্বাদও ভালো, তাদের ব্যবহারও ভালো।'
গত ৯৭ বছর ধরে এভাবেই অভুক্ত মানুষের ক্ষুধা নিবারণের কাজ করে আসছে মদনমোহন অন্নছত্র ট্রাস্ট।
১৯২৪ সালে ঢাকায় খাদ্যাভাবের সময় নবাবপুরের স্থানীয় জমিদার মদনমোহন পালের ৩ ছেলে রজনীকান্ত পাল, মুরলীমোহন পাল আর প্রিয়নাথ পাল ক্ষুধার্ত মানুষের জন্যে তাদের বাবার নামে একটি অন্নছত্র খুললেন। সেসময় প্রতিদিন দুপুরবেলা ১২৫ জনকে বিনামূল্যে খাওয়ানোর ভার নেন তারা। এরপর গত ৯৭ বছর ধরে এ ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন তাদের উত্তরাধিকারীরা।
১২৫ জন দিয়ে অন্নছত্র শুরু হলেও এখন রোজ সকালে ২০০ থেকে ২৫০ জনের খাবার রান্না করা হয়। আগে সকাল ১১টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত খাওয়ানো হতো। তবে করোনা সংক্রমণ এড়াতে এখন সকাল ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত খাওয়ানো হয়। কারণ এরপর নবাবপুর রোডের দোকানগুলো খুলে যায়। সেইসঙ্গে ভিড়ও বাড়ে।
ট্রাস্ট শুরুর বিষয়ে মদনমোহন অন্নছত্র ট্রাস্টের ব্যবস্থাপক পরিমল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '১৯২৪ সালে ঢাকায় খাদ্যাভাব দেখা দিলে মদনমোহন পালের ছেলেরা ট্রাস্ট গঠন করে ক্ষুধার্ত মানুষদের খাওয়ানোর কার্যক্রম শুরু করেন। এরপর থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে এখানে খাওয়ানো হয়। ক্ষুধার্ত অবস্থায় যিনি আসবেন, তিনিই খেতে পাবেন।'
ট্রাস্টের খরচ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'মদনমোহন পালের ছেলেরা নিজেদের বাবার নামে মদনমোহন পাল অন্নছত্র ট্রাস্ট এস্টেট গঠন করার পর কিছু জায়গা লিখে দেন ট্রাস্টের নামে। সেখানে এখন ৬টা মার্কেট। এ মার্কেটের জমিদারি ভাড়ার টাকা দিয়ে ট্রাস্ট চলছে।'
এক যুগ ধরে মদনমোহন অন্নছত্র ট্রাস্টের হয়ে পাচকদলের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন স্বপন চক্রবর্তী।
ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'এখানে প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ জনের রান্না করা হয়। ৪০ কেজি চাল, ৬০ কেজি সবজি আর ১০ কেজি ডাল রান্না করি। অন্নছত্রের শুরু থেকে এ ৩ পদই রান্না হয়ে আসছে। তবে ডালের ক্ষেত্রে কোনো দিন মুগ, কোনো দিন ছোলা বা মটর ডাল রান্না করা হয়।'
তিনি জানান, মাসের ২ একাদশী (চাঁদের একাদশ দিন) আর জন্মাষ্টমী বাদে সারা বছর এখানে খাবার বিতরণ করা হয়। তবে নির্ধারিত সময়ের পর কেউ এলে তাকেও ফেরানো হয় না।
'আমাদের এখানকার স্টাফদের জন্য খাবার রান্না করা হয়ে থাকে। সেই খাবারও অতিথিদের দিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তারা নতুন করে রেঁধে খান', তিনি বলেন।
এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ট্রাস্টের উইলে বলা আছে, কাউকে ফেরানো হবে না।'
মদনমোহন পাল অন্নছত্র ট্রাস্টের বর্তমান প্রধান নির্বাহী দীপক কুমার পাল। সহকারী নির্বাহী তপন কুমার পাল। আর নির্বাহী সদস্য হিসেবে আছেন মিন্টু রঞ্জন পাল। মদনমোহনের বংশধর তারা।
Comments