পা ছাড়া বাবা আর হাত-পা ছাড়া সন্তানের গল্প
যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার নাগরিক মুঞ্জির আল-নাজ্জাল এক বোমা বিস্ফোরণে পা হারান। তারপর ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তুরস্ক সীমান্তের একটি শরণার্থী ক্যাম্পে। লড়াই করছেন নিজের সঙ্গে, জীবনের সঙ্গে। কিন্তু, নিজের পা হারানো নিয়ে মোটেও চিন্তিত নন তিনি। তার যত চিন্তা ৫ বছরের ছেলে মুস্তাফার ভবিষ্যৎ নিয়ে। কারণ, সিরিয়ায় যুদ্ধের সময় নির্গত স্নায়ু গ্যাসের কারণে জন্মগত রোগে হাত-পা ছাড়াই জন্মগ্রহণ করেছে মুস্তাফা।
পা ছাড়া বাবা আর হাত-পা ছাড়া সন্তানের এই গল্প ক্যামেরার ক্লিকে সারাবিশ্বের কাছে তুলে ধরেছেন তুরস্কের আলোকচিত্রী মেহমেত আসলান। মেহমেতের সেই ছবিটি এ বছর হাজার হাজার ছবিকে পিছেন ফেলে সিয়েনা আন্তর্জাতিক ফটো অ্যাওয়ার্ডসের সেরা ছবি নির্বাচিত হয়েছে।
ছবিতে দেখা গেছে, মুঞ্জির ক্রাচ ব্যবহার করে নিজের ভারসাম্য বজায় রেখে ছেলেকে দু'হাত দিয়ে শূন্যে ধরে রেখেছেন। এসময় বাবা-ছেলে দু'জনেই হাসছেন। সিরিয়ার ইদলিবের একটি বাজার দিয়ে যাওয়ার সময় বোমা বিস্ফোরণে মুঞ্জির ডান পা হারান। বাবা ও ছেলের এই সুন্দর মুহূর্তে চিকিৎসাসেবার অভাবকেও তুলে ধরা হয়েছে।
আলোকচিত্রী মেহমেত আসলান ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, এই ছবির মাধ্যমে বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেছি। আমি শরণার্থী শিশু ও তার বাবার জীবনযুদ্ধকে সবার সামনে তুলে ধরেছি। আশাকরি সবাই শরণার্থীদের প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পারবে। সবাই শিশুটিকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে।
তিনি আরও বলেন, আমি সিরিয়া সীমান্তের কাছে দক্ষিণ তুরস্কে এই পরিবারের সঙ্গে দেখা করি। সেখানে একটি দোকানে তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মুঞ্জির আল-নাজ্জাল। তারা আমার সঙ্গে দেখা করেন এবং সাহায্য চান। তারা জানান, মুস্তাফার চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু, সেই চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল, যা তাদের জন্য বহন করা সম্ভব নয়। এজন্য দরকারি বিশেষ কৃত্রিম জিনিসগুলোও তারা তুরস্কে খুঁজে পাচ্ছেন না।
মুঞ্জির আল-নাজ্জাল বলেন, আমি একবার নয় বারবার একটি হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটে গিয়েছি। এমন কোনো শহর নেই যেখানে আমি খোঁজ নেইনি। কিন্তু, এখানের কোথাও আমরা কৃত্রিম যন্ত্রগুলো খুঁজে পাইনি।
জন্মগত রোগ টেট্রা-অ্যামেলিয়া নিয়ে জন্ম নেওয়া ৫ বছর বয়সী মুস্তাফা তখন কার্পেটে গড়াগড়ি করছিল ও হাসছিল। আর তার ছোট বোন তাকে তাকে বারবার একটি সোফায় বসিয়ে দিচ্ছিল। এসময় মুস্তাফার বাবা বলেন, এভাবেই তার সময় কাটে। কিন্তু, সে খুবই স্মার্ট।
সিরিয়ার ইদলিব থেকে পালিয়ে আসার পর তার পরিবার ৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে দাতব্য প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে চলছে। ভিড়ে ঠাসা সেই শরণার্থী ক্যাম্পটি উত্তর সিরিয়ার সীমান্ত বরাবর বসে আছে। গত এক দশকের সংঘাতে লাখ লাখ সিরিয়ার নাগরিক তুরস্ক এবং এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশে প্রবেশ করেছে।
ফটোগ্রাফার আসলানের বিশ্বাস- এই ছবিটি শরণার্থীদের বিরুদ্ধে সমালোচনা কিংবা প্রতিক্রিয়া কমাতে সাহায্য করবে। কারণ বিরোধীরা সবসময় শরণার্থীদের অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য তাদের দায়ী করে আসছে।
মুস্তাফার মা জয়নব বলেন, শুনেছি ছবিটি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা বছরের পর বছর ধরে চেষ্টা করেছি মুস্তাফাকে আরও ভালো জীবন দেওয়ার। চেষ্টা করেছি আমাদের কেউ সাহায্য করুক। এখন যদি সেটা হয় তাহলেই আমরা খুশি।
এই পুরষ্কারের অন্যতম বিচারক ফটোসাংবাদিক ব্রিটা জাচিনস্ক বলেন, আমি আমার জীবনে অনেক ছবি তুলেছি। অনেক দৃশ্য সামনে থেকে দেখেছি। অনেক কষ্ট প্রত্যক্ষ করেছি। তাই মানসিকভাবে আমি যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্তু, এই ছবিটি আমাকে আলোড়িত করেছে। এখানে শুধু একটি পরিবার নয় যেন সব শরণার্থীদের কষ্টের ভয়াবহতা উঠে এসেছে। একইসঙ্গে, বাবা-সন্তানের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত ফুটে উঠেছে। যে আনন্দ শুধুই বাবা ও সন্তানের। ছবিটি দেখলে চারপাশের কোনোকিছুই গুরুত্ব পাবে না। মনে হবে পৃথিবী স্থির আর অনুভবে ফুটে উঠবে বাবা ও সন্তানের ভালোবাসা এবং আনন্দ।
সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট, ভাইস, ইন্ডিয়া টাইমস, বিজনেস ইনসাইডার
Comments