ভ্যাকসিনের চাহিদা মেটাতে আমাদের স্বয়ংসম্পন্ন হতে হবে: ফেরদৌসী কাদরী

ড. ফেরদৌসী কাদরী

এশিয়ার নোবেল হিসেবে খ্যাত র‌্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী বলেছেন, কোভিড-১৯সহ ভবিষ্যতে জনস্বাস্থ্যের যেকোনো ধরনের জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশকে যত দ্রুত সম্ভব ভ্যাকসিন উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পন্ন হতে হবে।

গত সপ্তাহে দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই বিজ্ঞানী বলেন, 'আমরা এখন কোভিড-১৯ নিয়ে কথা বলছি। যদিও আমরা জানি (ভবিষ্যতে) অনেক রোগ দেখা দেবে। যেহেতু আমরা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছি, সেহেতু আমরা কম দামে ভ্যাকসিন পাব না। সুতরাং আমাদের স্বয়ংসম্পন্ন হতে হবে।'

ড. ফেরদৌসীর মতে, গত ৬ মাসে স্থানীয়ভাবে ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু বিদ্যমান ভ্যাকসিন উৎপাদন পরিকাঠামোর উন্নয়নের পাশাপাশি নতুন কিছু গড়তে সরকারের অনেক কিছু করার আছে।

ড. ফেরদৌসী আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) ইমেরিটাস সায়েন্টিস্ট এবং সংস্থাটির মিউকোসাল ইমিউনোলজি অ্যান্ড ভ্যাকসিনোলজি ইউনিটের প্রধান।

তিনি ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিকাবিষয়ক বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ছিলেন।

টিকার উন্নয়নের ফেরদৌসী কাদরীর নিবেদিত ভূমিকার জন্য তাকে এ বছর র‌্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার দেওয়া হয়। বিশেষ করে কলেরার টিকা। যা বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে।

আগামী ২৮ নভেম্বর ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় র‌্যামন ম্যাগসেসে সেন্টারে তার হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে এই পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে।

সাক্ষাৎকারে ড. ফেরদৌসী টিকা উৎপাদনে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর ভূমিকা, ভবিষ্যতের মহামারি ও এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির বিষয়েও আলোকপাত করেন।

তার ভাষ্য, গত ৬ মাসের অগ্রগতি সত্ত্বেও তার আগে দরকারি উদ্যোগগুলো নেওয়া হয়নি। বিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা যার জন্য পরামর্শ দিয়ে আসছেন।

তিনি বলেন, 'আমি মনে করি এখন উদ্যোগ আছে। যদিও সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত।'

বিশিষ্ট এই বিজ্ঞানীর মতে, যদি বেসরকারি কোম্পানিগুলো ১০ বছর, এমনকি ৫ বছর আগেও এগিয়ে আসত, তাহলে কোভিড-১৯ মহামারির সময় জাতি উপকৃত হতো।

তিনি বলেন, 'ভ্যাকসিন তৈরির বিষয়টি ব্যয়বহুল। এর পরিকাঠামো তৈরির বিষয়টি ব্যয়সাপেক্ষ। তারপরও আমি বলতে পারি, আমরা যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পূর্বযোগ্যতা পূরণ করতে পারি, তাহলে এটার জন্য বেসরকারি কোম্পানিগুলো আগ্রহী হবে।'

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পূর্বযোগ্যতা এমন একটি শর্ত, যার ফলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য, বিশেষ করে টিকা, আন্তর্জাতিক বাজারে ঢোকার সুযোগ পায়। যেহেতু ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পূর্বযোগ্যতা অর্জন করেনি, সেহেতু স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ভ্যাকসিন এখন পর্যন্ত বাইরে পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই।

অবশ্য বাংলাদেশের এই পূর্বযোগ্যতা অর্জনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে জানিয়ে ড. ফেরদৌসী জানান, তিনি এ ব্যাপারে আশাবাদী।

তিনি বলেন, 'বৈশ্বিক ভ্যাকসিনের বাজার অনেক বড়। কিন্তু এখন মাত্র ২টি স্থানীয় কোম্পানি দেশে ব্যবহারের জন্য ভ্যাকসিন উৎপাদন করছে। বাংলাদেশ একবার পূর্বযোগ্যতা অর্জন করতে পারলে স্থানীয় কোম্পানিগুলো ভ্যাকসিন বিশ্ববাজারে রপ্তানি করতে পারবে।'

কোভিড-১৯ প্রসঙ্গে আলাপচারিতায় ড. ফেরদৌসী বলেন, 'আমরা কখনো ভাবিনি যে মহামারি এতটা প্রলম্বিত হবে। আমরা এখনো বলতে পারি না যে, মহামারি শেষ হয়ে গেছে। আমাদের আরও অন্তত ৬ মাস বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে হবে।'

কোভিড-১৯ এর পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য নিয়ে অন্যান্য জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার হুমকি রয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, `জনস্বাস্থ্যে জরুরি অবস্থা তৈরি করার ক্ষমতা রাখে এমন কিছু উদীয়মান ও পুরনো রোগ আছে।'

এই বিজ্ঞানীর মতে, উদীয়মান রোগগুলোর মধ্যে আছে নিপাহ, এইচআইভি-এইডস, যক্ষ্মা, এইচআইভি ও যক্ষ্মার যৌথ সংক্রমণ, ম্যালেরিয়া এবং ডিপথেরিয়া। আর প্রাণী থেকে মানবদেহে ছড়ানো (জুনোটিক) রোগগুলোর মধ্যে আছে হান্তা ভাইরাস ও ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস।

অন্যদিকে পুনরায় উদ্ভূত রোগ, যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ার পরেও আবার ফিরে আসে হয়, সেগুলোর মধ্যে আছে ম্যালেরিয়া, কলেরা, হুপিংকাশি, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও গনোরিয়া।

বিজ্ঞানীরা কীভাবে ভবিষ্যৎ মহামারির পূর্বাভাস দিচ্ছেন, জানতে চাইলে ফেরদৌসী কাদরী বলেন, 'বিভিন্ন রোগজীবাণুর বিস্তার নিয়ে গবেষণাই এ জন্য যথেষ্ট। উদ্বেগজনকভাবে জলবায়ু পরিবর্তন ও দ্রুত নগরায়ণের কারণে বিশ্বব্যাপী পুরনো ও নতুন সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে শুরু করেছে।

উদাহরণ হিসেবে তিনি জানান, কলেরা একটি পুরনো রোগ। যা বিশ্বজুড়ে বাড়ছে। এ ছাড়া অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধকে কেন্দ্র করে আরও একটি উদীয়মান জনস্বাস্থ্য সমস্যার কথা উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, 'সাধারণ ব্যাকটেরিয়া পুরোপুরি ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠতে পারে। এটা ভয়ানক। বিশ্বজুড়ে সবাই এটা নিয়ে চিন্তিত। ওষুধ যেহেতু কার্যকারিতা হারাচ্ছে, সেহেতু এই সংকটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভ্যাকসিন প্রধান হাতিয়ার হবে।'

বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর এমন অন্তত ১৫টি ভ্যাকসিন আছে বলে জানান তিনি।

'সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গ আসলে প্রথমেই ভ্যাকসিনের কথা আসবে। চিকিৎসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রতিরোধ তার চেয়ে জরুরি। যদি আমরা সবাইকে প্রধান প্রধান রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু-প্রতিরোধী ভ্যাকসিন দিতে পারি, তাহলে সেটা অনেক ভালো হবে।'

যেকোনো ধরনের টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এর অবকাঠামো প্রসঙ্গে ড. ফেরদৌসীর বক্তব্য, 'আমাদের একটা শক্তিশালী ব্যবস্থা আছে। সেইসঙ্গে আমাদের জনসংখ্যাও অনেক বেশি। ভ্যাকসিন সংগ্রহের ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে। কারণ কিছু ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো তাদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ভ্যাকসিন মজুত করেছে। তাই স্বয়ংসম্পন্ন হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।'

গত সপ্তাহে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি জানায়, ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য গোপালগঞ্জে একটি প্ল্যান্ট স্থাপনে বছরখানেক লাগবে। আগে বলা হয়েছিল যে, ৬ থেকে ৯ মাস সময় লাগবে।

তরুণ গবেষকদের জন্য তার পরামর্শ কী হবে, জানতে চাইলে ফেরদৌসী কাদরী বলেন, 'একজন গবেষক হওয়ার জন্য দৃঢ় একাগ্রতার পাশাপাশি সারা জীবনের অঙ্গীকার প্রয়োজন। যদিও তরুণ গবেষকদের জন্য আমাদের উদাহরণ তৈরি করতে হবে।

চিকিৎসা গবেষণার পাশাপাশি আধুনিক অবকাঠামো তৈরির কাজে আরও বেশি বিনিয়োগের জন্য সরকারি ও বেসরকারি খাতের ভূমিকা আছে জানিয়ে এই প্রথিতযশা বিজ্ঞানী আরও বলেন, 'আমি মনে করি না যে, আমাদের তরুণ বিজ্ঞানীদের অনেক টাকার চাহিদা আছে। তাদের কেবল গবেষণার জন্য একটি যথার্থ পরিবেশ দরকার।'

প্রতিবেদনটি অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

3h ago