সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, সহিংসতা ও বর্বরতার শেষ কোথায়?

রংপুরের পীরগঞ্জে জেলে পল্লীতে ঘর-বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় প্রায় ২৫টি বাড়ি ও দোকান পুড়ে গেছে। ছবি: সংগৃহীত

সাতচল্লিশে দেশভাগের মর্মন্তুদ বেদনা নিয়ে লেখা উর্দুভাষী ঔপন্যাসিক কৃষণ চন্দরের দাঙ্গার গল্প 'পেশোয়ার এক্সপ্রেস'র ভূমিকায় উর্দু কবি আলি সরদার জাফরি লিখেছিলেন, 'ভারত ও পাকিস্তানে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এই আগুনের লেলিহান শিখায় মানুষ, ঘরবাড়ি আর পাঠাগারের পাশাপাশি আমাদের জীবন, স্বাধীনতা, সভ্যতা এবং কৃষ্টি পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কয়েক মাসের ব্যবধানে এর তীব্রতা কিছুটা কমলেও এখনো সম্পূর্ণ কমেনি। ছাইয়ের নিচে আগুন এখনো চাপা পড়ে আছে, যা একটু ফুঁ দিলেই আবার জ্বলে উঠতে পারে। এই ছাইয়ে বাতাস দেওয়ার লোকেরও অভাব নেই।'

ভারত বিভক্তির ২৪ বছর পর দ্বিজাতি তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করে জন্ম হয় সেক্যুলার স্বাধীন বাংলাদেশের। অত্যন্ত আধুনিক, প্রগতিশীল, সাম্য, সমতা, সকলের জন্য ন্যায়বিচার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার রাষ্ট্রদর্শন নিয়ে যাত্রা শুরু করে দেশটি। পঁচাত্তরে সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়েই শুরু হয় বাংলাদেশের উল্টো পথে যাত্রা, যা আজও থামেনি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও কিছু মানুষ সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি রাষ্ট্রদর্শন ও চিন্তা-চেতনা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। ক্লান্তিহীন সমাজে ঘৃণার চাষবাস করছে। তারাই বারবার ধর্মের দোহাই দিয়ে নিপীড়ন করেছে চিরকালের চেনা প্রতিবেশী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে, খুন করেছে, নির্বাসন দিয়েছে প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পীকে। অপমান অপদস্থ করেছে বাংলার সহজিয়া মরমিয়া আউল বাউলকে। এ যেন এক ছাই চাপা সাম্প্রদায়িক ঘৃণার আগুন। ঠুনকো অজুহাত পেলেই জ্বলে ওঠে। জ্বালিয়ে দিতে উদ্ধত হয় চিরচেনা সম্প্রীতির সমাজ।

এমনই এক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার আগুনে গত রোববার রাতে পুড়িয়ে দেওয়া হলো রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া, বটতলা ও হাতীবান্ধা গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়ি-ঘর। রাতের আঁধারে চলে লুটপাট ও নৈরাজ্য। দুর্গা পূজায় কুমিল্লার এক মণ্ডপে দুর্বৃত্তের রাখা পবিত্র কুরআন অবমাননার জের ধরে ঘটে এ ঘটনা। কুমিল্লা ছাড়াও চাঁদপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ দেশের নানান জায়গায় মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী দল ও মানুষ এসব ঘটনায় অফলাইন ও অনলাইনে প্রতিনিয়ত উসকানি ও ইন্ধন দিয়েছে।

ধর্মের নামে দেশে এ রকম অর্গানাইজড ক্রাইম এই প্রথম নয়। আগেও ঘটেছে কক্সবাজারের রামুতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে, সুনামগঞ্জের শাল্লায়। কিন্তু কোথাও এদের বিচার হয়নি। উল্টো সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর মামলার চার্জশিটভুক্ত ৩ আসামি ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পায়। এই যে অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়া, এটাই তাদের পরবর্তী অপরাধে সাহস যোগায়। শাল্লার ঘটনায় আমরা দেখলাম উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিবাদকারী যুবক ঝুমন দাস হেফাজত নেতা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে লেখায় আটক হয়ে দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও সহজে জামিন পাননি। কিন্তু অপরাধে সম্পৃক্ত স্বাধীন মেম্বাররা অনায়াসে ছাড় পেয়ে গেছেন। অথচ দেশজুড়ে হেফাজতি তাণ্ডবের জেরে মামুনুল হকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রই মামলা করে আটক করে রেখেছে।

সংখ্যাগরিষ্ঠের চোখ দিয়ে দেখলে সংখ্যালঘুর মন বোঝা যায় না। বিপরীত দিক থেকে ভাবলেই কিছুটা আন্দাজ করা যায়। যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ তারা যদি ভাবতেন যে তাদের ঈদ আনন্দের সময় শহরজুড়ে, পাড়াজুড়ে পাহারা দিচ্ছে পুলিশ, বিজিবি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিছু ধর্মোন্মাদ মানুষ একটা হুজুগ তুলে যেকোনো সময় হামলা করতে পারে। কেমন লাগতো তখন? সশস্ত্র পাহারা দিয়ে হয়তো সাময়িক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়, কিন্তু আনন্দের স্বতঃস্ফূর্ত পরিবেশ তৈরি করা যায় না।

ভয় ও শঙ্কামুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি। সব মানুষের রাষ্ট্র বানাতে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই মিলে আমরা সংগ্রাম করলাম, এক নদী রক্ত পেরিয়ে স্বাধীনতার দেখা পেলাম—কিন্তু ৫০ বছরেও সেই কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র পেলাম না। এখনো সংখ্যালঘু পরিচয়ে মানুষকে বাঁচতে হয়। এরচেয়ে বড় দুঃখের কিছু হয় না। রাশি রাশি অবকাঠামোগত উন্নয়নের চেয়ে মানবিক মানুষ, পরমত সহিষ্ণু মানুষ, স্বদেশ ও সংস্কৃতি-চেতনায় উদ্ভাসিত মানুষ তৈরি করা খুব জরুরি। না হলে যে পঙ্গপাল সৃষ্টি হবে তারা সোনার ফসল সব ধ্বংস করে দেবে। এ দেশে অতীতেও নানান সময় ধর্মীয় ইস্যুকে ঘোলা জলে মাছ শিকারের মতো রাজনীতি করার মোক্ষম হাতিয়ার করা হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। ততদিন হবে যতদিন পর্যন্ত না মানুষ শিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি চিন্তা চেতনায়ও যৌক্তিক আচরণ করার মতো বোধ-বুদ্ধির অধিকারী হবে।

অসাম্প্রদায়িক লেখক কৃষণ চন্দর তার আলোচিত 'গাদ্দার' উপন্যাসের এক জায়গায় দেশত্যাগী হাহাকার জাগানিয়া বর্ণনায় বলছেন, 'হায়! কেমন করে বলব ও দেশ আমার নয়, যে দেশের মাটির প্রতিটি কণা আমার হৃদয়ে হীরার কুঁচির মতো দীপ্তি ছড়াচ্ছে। কেমন করে বলব এই আমার দেশ যেখানে আমার সমগ্র অনুভূতি অচেনা আগন্তুকের মত। ইরাবতীর এপারে ওপারে তো আমি কোনো পার্থক্য দেখতে পাচ্ছি না। দুই তীরে শবের সারি। মধ্যে নদীর নীল স্রোত বইছে।' ভারত বিভক্তির ৭০ বছর পরও যেন কাউকে এভাবে আর দুঃখ করতে না হয়। ভারত, পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ হোক সীমান্তের এপারে বা ওপারে তেমন পার্থক্য থাকে না। ভাষা এক, নদীর স্রোত, বায়ু প্রবাহ অভিন্ন থাকে। তবু মানুষ এ অঞ্চলে বিভক্ত ধর্ম-পরিচয়ে, কাঁটাতারে। এটাই আমাদের পুরনো গভীর ক্ষত। যা থেকে ক্ষণে ক্ষণে রক্ত ঝরে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে, নিবিড় পরিচর্যায় এ গভীর ক্ষত দ্রুত সারানো জরুরি।

লেখক: কবি ও গবেষক

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Salehuddin urges all to work together to overcome challenges of economy

'We are in the midst of all sorts of challenges,' says the finance adviser

2h ago