আমরা কি হট্টিটি বা উটপাখির নীতিতে বিশ্বাসী?
পত্রিকায় লেখা হয়, টেলিভিশনে দেখানো হয় কেন?
মানুষকে জানানোর জন্য।
কোনো একটি ঘটনা ঘটে গেছে, কিন্তু পত্রিকা তা লিখল না, টেলিভিশন তা দেখাল না। তাহলে কি মানুষ ঘটনাটি জানল না?
সরকার বা সংবাদ মাধ্যম কেউই সম্ভবত তা উপলব্ধি করতে পারছে না। আমরা ভুলে যাচ্ছি এটা ২০২১ সাল। থ্রিজি, ফোরজি বন্ধ করার প্রযুক্তি যেমন সরকারের হাতে আছে, তেমনি আরও বহু উপায় আছে তা উপেক্ষা করে সংবাদটি জানার বা ছড়িয়ে দেওয়ার।
এই লেখাটি লেখার সময়ও ভাবছি দুদিন আগে কুমিল্লায় যে ঘটনার সূত্রপাত, তা লিখব কি না! নির্বোধ না হলে এমনটা ভাবছি কেন? এখন লিখলে সেই তথ্যে মানুষ জানবে, বিষয়টি মোটেই তেমন নয়। সাংবাদিক লিখবেন তারপর মানুষ জানবেন, সেই অবস্থানে পৃথিবী নেই। এই লেখায় ঘটনাটি লেখা বা না লেখা দিয়ে কিছুই যায় আসে না।
সেই ঘটনা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে, সবাই জেনে গেছে। জেনে যে গেছে, সেই তথ্যও অজানা নয়। তারপরও ভাবছি লিখব কি না। আমরা চিন্তা-চেতনায় পিছিয়ে থাকা কোনো জগতে বাস করছি?
এসব ক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি প্রকাশ না করার পক্ষে কিছু যুক্তি সামনে আনা হয়। প্রথম যুক্তি, ঘটনাটি জানাজানি হলে দেশের অন্যত্র এর প্রভাব পড়তে পারে। মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে অরাজকতা তৈরি করতে পারে। জান-মাল ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঠেকাতে ঘটনা প্রকাশ না করার পক্ষে অবস্থান নেওয়া হয়।
সত্য না হলেও দৃষ্টিনন্দন ছোট্ট হট্টিটি পাখি নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। আকাশে যখন মেঘের গর্জন হয়, হট্টিটি পাখি তখন আকাশের দিকে দু পা তুলে দেয়। আকাশ ভেঙে পড়লে পা দিয়ে সে ঠেকাবে। উটপাখি নাকি মাটিতে মুখ গুঁজে মনে করে, সে যেহেতু কিছু দেখছে না, অন্যরাও কিছু দেখছে না। ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রকাশ না করার ক্ষেত্রে হট্টিটি বা উটপাখির গল্পের মিল পাওয়া যায়। কিন্তু তার কোনো ইতিবাচক প্রতিফলন সমাজ জীবনে পড়ে না। এই যে সংবাদ প্রকাশ না করা, এটা মূলত সরকারি ইচ্ছার প্রতিফলন। সরকার হট্টিটি বা উটপাখির গল্পে বিশ্বাস করে। 'সংবাদ প্রকাশ হয়নি মানে কোথাও কিছু ঘটেনি' পরিতৃপ্তি নিয়ে সাফল্যের দাবি করা যায়। সরকারি ইচ্ছার প্রতিফলনই গণমাধ্যমে প্রতিফলিত হতে দেখা যাচ্ছে। গণমাধ্যমের ভেতরে ভয় কাজ করে যে, একটি ঘটনার প্রভাবে যদি সারা দেশে একই রকম ঘটনা ঘটে, তবে সরকার দায় চাপাতে পারে গণমাধ্যমের উপর। সরকার বলতে পারে, আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করে সব কিছু ভণ্ডুল করে দিলো। গণমাধ্যম এই দায় নিতে চায় না। ফলে সংবাদ প্রকাশ থেকে বিরত থাকে।পাঠককে জানানো যে সংবাদ মাধ্যমের দায়িত্ব, তা পালন করে না বা ভুলে যায়।
এর ফলে কী ঘটে? মানুষ যে ঘটনা জেনে যায়, তা তো আগেই বলেছি। বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের জানার অন্যতম উৎস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে জানা সংবাদটি কখনো আংশিক, কখনো রংচং লাগানো বা বিকৃত বা বিভ্রান্তিকরভাবে জানে। সংবাদটি সত্য কি না, কতটা সত্য— তা নিয়ে অনেকের ভেতরেই সংশয়-সন্দেহ থাকে। তখন তারা মূলধারার টেলিভিশনের পর্দা বা গণমাধ্যমের অনলাইন সংস্করণের দিকে তাকিয়ে থাকেন প্রকৃত সত্য জানার জন্যে। সেখানে যদি সংবাদটি খুঁজে না পান, তখন পাঠক-দর্শক বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সংবাদের ছবি-অডিও-ভিডিও'র পুরোটা যদি সত্য নাও হয়ে থাকে, তবুও বিশ্বাস করে নেন। এই বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু বিশ্বাস বা প্রশ্ন মনে আসে। সেগুলোও এক সময় বিশ্বাসে পরিণত হয়। এই বিশ্বাসের প্রথম দায় পড়ে সরকারের উপর। আস্থা এবং বিশ্বাস চলে যায় গণমাধ্যমের ওপর থেকে।
মানুষ বিশ্বাস করে নেয়, সরকার গণমাধ্যমকে সত্য প্রকাশ করতে দেয় না। গণমাধ্যমের সাহস নেই। তারা সত্য প্রকাশ করতে ভয় পায়।
একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ সংবাদটি জানার একমাত্র মাধ্যম হয়ে ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এর ফলে অতিরঞ্জন-গুঞ্জন-গুজব বৃদ্ধি পায়। কোথাও হয়তো একটি ঢিল পড়েছে, সংবাদটি ছড়িয়ে পড়ে ভাঙচুর হয়েছে। একজন আহত হলে ছড়িয়ে পড়ে মারা গেছেন। একজন মারা গেলে তা হয়ে যায় বহুজন…।
এই অতিরঞ্জন, গুঞ্জন বা গুজব ঠেকানোর একমাত্র উপায় সঠিক ও সত্য তথ্য মানুষকে জানানো। সেই কাজটি করতে পারে শুধুমাত্র মূলধারার সংবাদ মাধ্যম। সরকার তার অবস্থান থেকে প্রকৃত ও সত্য তথ্য এবং বক্তব্য দিয়ে গণমাধ্যমকে সহায়তা করতে পারে। প্রকৃত ঘটনা মানুষকে জানানো হলে, সরকারি ব্যবস্থা মানুষকে আশ্বস্ত করতে পারলে নৈরাজ্য সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার পরিবর্তে প্রশমিত হতে পারে। নৈরাজ্য বাড়ে গুজব-গুঞ্জন-অতিরঞ্জনে, সত্য প্রকাশে নয়। কুমিল্লার ঘটনা প্রকাশ না করলেও নোয়াখালী, সিলেট, চট্টগ্রাম, চাঁদপুরে ঘটনা কিন্তু ঠিকই ঘটেছে।
সরকার এবং সংখ্যগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠী নিয়ে দুটি কথা বলে লেখাটা শেষ করি।
সরকার অতীতের মতো এবারও বলেছে 'সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলাকারী কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।'
কুমিল্লা ঘটনার পরে সরকারি এই ভাষ্যের আগের দিন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, 'ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু্দের ঘর-বাড়ি ও মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর মামলার চার্জশিটভুক্ত ৩ আসামি ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। এই ৩ জন উপজেলার হরিপুর, পূর্বভাগ ও সদর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী।' (দ্য ডেইলি স্টার, ১৩ অক্টোবর ২০২১)
সরকারি ভাষ্যের কোনো প্রতিফলন অতীতের কোনো ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। সুনামগঞ্জ বা চট্টগ্রামের বৌদ্ধ পল্লী, কোনো ক্ষেত্রেই নয়।
বিপরীত চিত্র যে দেখা গেছে সর্বত্র, তারই ছোট্ট একটি প্রমাণ নাসিরনগরের এই মনোনয়ন। যদিও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর ৩ জনের থেকে ২ জনের মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও সরকারের অবস্থান জনমানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে বলে মনে হয় না।
কুমিল্লার ঘটনাটি সামনে আসার পর তাৎক্ষণিক প্রশাসনিক উদ্যোগ জোরালো ছিল না। এর প্রভাব দেশের অন্যত্র পড়তে পারে, সরকার তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ২২ জেলায় বিজিবি মোতায়েন করা হলেও শুক্রবার জুমার নামাজের পর মিছিল এবং হামলা হতে পারে, তা প্রতিরোধের যথেষ্ট ব্যবস্থা সরকারি উদ্যোগে দৃশ্যমান ছিল না। ফলে হামলা ঠেকানো যায়নি।
এ দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীর মানুষ আমরা। নিজেদের ধর্ম পালন করে সংখ্যায় যারা কম, যারা দুর্বল তাদের ওপর হামলা করেছি। তাদের ধর্মস্থানে ভাঙচুর করেছি। ইসলাম ধর্মের কোনো বাণী এমন কর্ম সমর্থন করে না। কুমিল্লায় পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের অবমাননা করা হয়েছে, তথ্য এটুকুই। সেই অবমাননা কে করল, কারা করল—তা না জেনেই হামলা! বিশেষ কোনো মহলের পরিকল্পনায় আপনাদেরকে দিয়ে খারাপ কিছু করানোর চক্রান্ত কি না, তা-ও জানা-বোঝার চেষ্টা করলেন না। সংখ্যায় বেশি হয়ে সংখ্যায় কমের ওপর হামলায় তো কোনো বাহাদুরি থাকার কথা নয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্ম-উৎসবের আনন্দকে আতঙ্ক ও বিষাদময় করে তুলেছি। সংখ্যাগুরু মানুষ হিসেবে আমাদের যে দায়িত্ব, তা কি পালন করলাম? সরকার কি তার দায়িত্ব পালন করল? সংবাদ মাধ্যম পালন করল? উটপাখি বা হট্টিটি পাখির নীতিতে সমাধান মিলবে?
s.mortoza@gmail.com
Comments