করোনা টিকার ক্ষেত্রেও কি ট্রান্সজেন্ডাররা বঞ্চিত

trans_vaccination.jpg

করোনা পরীক্ষা এবং টিকা নিতে গিয়ে ট্রান্সউইম্যান ও কক্সবাজারভিত্তিক উন্নয়নকর্মী তানিশা ইয়াসমিন চৈতীর যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা বিভীষিকাময়। চৈতীর বায়োলজিক্যাল লিঙ্গ পুরুষ। জাতীয় পরিচয়পত্রে তার নাম মামুন মোল্লা। সরকার ২০১৩ সালে তৃতীয় লিঙ্গকে স্বীকৃতি দেওয়ার অনেক আগেই এ নামে নিবন্ধিত হন তিনি। পরে তার ভেতরে নারী লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হতে থাকে। আর সেই কারণেই পদে পদে সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাকে।

করোনার টিকার জন্য নিবন্ধন করে গত মাসে টেকনাফ উপজেলা কমপ্লেক্সে টিকার প্রথম ডোজ নিতে যান চৈতী। এরপর কার্ড জমা দিয়ে নারীদের সারিতে দাঁড়ান। অন্য নারীরা যখন তার উপস্থিতিতে অস্বস্তি প্রকাশ করছিলেন তখনই তিনি বুঝে যান, তার জন্য অপ্রীতিকর কিছু অপেক্ষা করছে।

চৈতী বলেন, 'এক পর্যায়ে আমি এক কর্মীকে ''মামুন মোল্লা'' নাম ডাকতে শুনলাম। আমার কার্ড নেওয়ার জন্য তার কাছে গেলাম। তিনি আমার নারীসুলভ চেহারা দেখে খুবই বিস্মিত হলেন এবং এটাকে একটা "স্পেশাল কেইস" হিসেবে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে বাধ্য করলেন।'

চৈতী শিক্ষিত। কক্সবাজারের ৫০০ জনেরও বেশি লিঙ্গ বৈচিত্র্যপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্য ও মনো-সামাজিক পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন তিনি।

টিকাদান কর্মকর্তাকে চৈতী বোঝানোর চেষ্টা করেন, তিনি একজন ট্রান্সউইম্যান। কিন্তু ওই কর্মী ট্রান্সজেন্ডার শব্দটির সঙ্গেই পরিচিত ছিলেন না।

'পরে আমি তাকে বলি, আমি হিজড়া গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এরপর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমার টিকা নেওয়ার অনুমতি আছে কি না? লাইনের অন্য লোকজন আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিলেন, যেন আমি মানুষ নই এবং আমার টিকা নেওয়ার কোনো অধিকার নেই', বলেন চৈতী।

এ পর্যায়ের ভোগান্তি শেষে চৈতী যখন নারীদের জন্য নির্ধারিত স্থানে টিকা নিতে যান, সেখানেও তাকে একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।

চৈতী বলেন, এক পর্যায়ে ওই স্বাস্থ্যকর্মীকে ডেকে আনতে হয়। তিনি গিয়ে পুরো বিষয়টি ওই নারী টিকাকর্মীর কাছে ব্যাখ্যা করেন। এরপ আমার প্রথম ডোজের টিকা নেওয়া সম্ভব হয়।

চৈতির আশঙ্কা, তার মতো একজন শিক্ষিত ট্রান্সউইম্যানকেই যদি এমন অপমানজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তবে সাধারণ হিজড়া অপমান ও ঝামেলার ভয়ে টিকাই নেবেন না।

এ আশঙ্কা যে সত্যি, তা টেকনাফের ট্রান্সজেন্ডারদের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। টেকনাফ উপজেলার যে ১০০ ট্রান্সজেন্ডারের সঙ্গে চৈতী কাজ করেন, তাদের মধ্যে শুধু একজন টিকা নিয়েছেন। আরেকজন টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন কেবল।

দেশে এখন পর্যন্ত ঠিক কত জন ট্রান্স মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে, তা জানা কঠিন। কারণ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিদিনের আপডেটে শুধু টিকা নেওয়া নারী-পুরুষের হিসাব দেওয়া হয়। টিকা পাওয়া ট্রান্সজেন্ডারদের সংখ্যার কোনো হিসাবই সেখানে থাকে না।

টিকাদান প্রক্রিয়া নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার রাজধানীর বেশ কয়েকজন ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছে। তাদের বেশিরভাগই জানিয়েছেন, অন্যদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা শুনে তারা টিকা নেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

তেমনই একজন ট্রান্সউইম্যান সামিউল আলম শাম্মী। তিনি একজন উদ্যোক্তা ও ট্রান্স অধিকারকর্মী। শাম্মী জানান, তিনি টিকা নেননি। কারণ টিকা নিতে যাওয়ার পর তার 'গুরু'র সঙ্গে কী আচরণ করা হয়েছে, তা তিনি দেখেছেন।

কয়েকজন ট্রান্সজেন্ডার এটাও দাবি করেছেন যে, নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত না হওয়ায় তাদের গোষ্ঠীর অনেকে করোনা পরীক্ষা করতে বা টিকা নিতে পারেননি। তাদের অনেকেই অশিক্ষিত এবং অনেকের স্মার্ট ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা নেই।

হিজড়া গোষ্ঠীর আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো, কৈশোর বয়স থেকে ভাসমান জীবন-যাপন করার কারণে তাদের অনেকেরই জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। কিন্তু টিকার জন্য অনলাইনে নিবন্ধনের জন্য এটি বাধ্যতামূলক।

কয়েকজন হিজড়া অভিযোগ করেছেন, গণটিকাদান কর্মসূচির সময় তাদের টিকা নিতে দেওয়া হয়নি। শুধু টিকাই নয়, করোনা পরীক্ষা করাতে গিয়েও বিড়ম্বনায় পড়েছেন ট্রান্সজেন্ডার গোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষ।

চৈতী তার অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, 'গত বছরের সেপ্টেম্বরে রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে কোভিড পরীক্ষা করাতে গিয়েও একই অবস্থার শিকার হই আমি। সেখানে কিছু পরিচিত মানুষ আমাকে সাহায্য করেন। আমি এমন অনেককেই চিনি যাদের কোভিডের সব উপসর্গই ছিল। শুধুমাত্র ঝামেলার ভয়ে তারা পরীক্ষা করাতে যাননি।'

তিনি আরও বলেন, 'কোভিডের উপসর্গ নিয়ে ঢাকায় কয়েকজন ট্রান্সজেন্ডার সদস্য মারা গেছেন। কিন্তু ঝামেলার ভয়ে "গুরুরা" কাউকে এসব তথ্য জানাননি।'

লিঙ্গ বৈচিত্র্যপূর্ণ জনগোষ্ঠীর অধিকারের জন্য কাজ করে এমন একটি সংগঠন বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি। এ সংগঠনের অ্যাডভোকেসি ম্যানেজার ড. মশিউর রহমান জানিয়েছেন, তারাও করোনা পরীক্ষা ও টিকা নেওয়ার সময় হয়রানি ও অপমানের অনেক অভিযোগ পেয়েছেন।

তিনি বলেন, 'আমরা বিভিন্ন জেলায় স্বেচ্ছাসেবীর মাধ্যমে ট্রান্সজেন্ডার ও টিকাকর্মী দুই পক্ষকেই সংবেদনশীল করার চেষ্টা করছি। কিছু অগ্রগতি লক্ষ্য করছি। তবে, লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় গোষ্ঠীর বেশির ভাগ সদস্য এখনো টিকা থেকে বঞ্চিত।'

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ডা. রোবেদ আমিন জানান, তারা এখনো এমন কোনো অভিযোগ পাননি।

তিনি বলেন, 'সরকার ইতোমধ্যেই তাদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু তাদের গ্রহণ করার ক্ষেত্রে যে সামাজিক চ্যালেঞ্জ, সেগুলো আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তারা তাদের পছন্দের লিঙ্গ (অর্থাৎ পুরুষ বা নারী) অনুযায়ী টিকা নেবেন। যদি তারা টিকা থেকে বঞ্চিত হন, আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখবো।'

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. আইনুন নাহারের মতে, সরকার স্বীকৃতি দিলেও ট্রান্সজেন্ডারদের আগে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।

তিনি বলেন, 'প্রতিটি কেন্দ্রে অবশ্যই একটি অভিযোগ বাকশো থাকতে হবে, যাতে কেউ অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়লে অভিযোগ করতে পারেন।'

সংক্ষেপিত: ইংরেজিতে পুরো প্রতিবেদনটি পড়তে ক্লিক করুন Vaccination Drive: Are transgender people left out?

অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম

Comments

The Daily Star  | English

$14b lost to capital flight a year during AL years

Bangladesh has lost around $14 billion a year on average to capital flight during the Awami League’s 15-year tenure, according to the draft report of the committee preparing a white paper on the economy.

10h ago