‘সবকিছু ছেড়ে একদিন বিদায় নিতে হবে- খারাপ লাগে’

রামেন্দু মজুমদার

বাংলাদেশের মঞ্চ নাটককে যারা সমৃদ্ধ করেছেন খ্যাতিমান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার তাদের অন্যতম। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন 'থিয়েটার'র মতো নামি নাট্যদল।

মঞ্চ নাটক আন্দোলনের একজন পথিকৃৎ রামেন্দু মজুমদার দেশের যেকোনো গণ-আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। মঞ্চ নাট্য নির্দেশক হিসেবেও তার সুখ্যাতি রয়েছে।

তিনি ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) সভাপতি হয়েছিলেন দুই বার, যা তাকে বিশ্ব দরবারে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তিনি বর্তমানে আইটিআই'র অনারারি প্রেসিডেন্ট।

রামেন্দু মজুমদার শিল্পকলায় অবদানের জন্য পেয়েছেন একুশে পদক। আজ ৯ আগস্ট এই গুণী নাট্যজনের ৮০তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন তার নাটক-সমাজ ও রাজনৈতিক ভাবনার কথা।

নাটক তো সমাজ-রাজনীতির কথা বলে। পঞ্চাশ বছর বয়সী বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতি এগোলো না পেছালো? আপনার বিশ্লেষণ কী?

রামেন্দু মজুমদার: সমাজ এগিয়েছে। রাজনীতিও এগিয়েছে। পৃথিবীতে কোনো কিছু স্থবির হয়ে নেই। বাংলাদেশও স্থবির হয়ে নেই। প্রশ্ন হচ্ছে কোন দিকে এগোলো তা দেখা দরকার। সঠিক পথে এগোলো কিনা? বৈষয়িকভাবে অনেক এগিয়েছি আমরা। কিন্তু, আমরা নৈতিকতা আনতে পারিনি। আমাদের শুভবুদ্ধির উদয় যদি হতো তাহলে আরও অনেক দূর যাওয়া যেত। সারাদেশে সংস্কৃতিচর্চা যদি বেশি করে হতো, নীতিবোধ তৈরি হতো তাহলে সমাজ আরও বেশি করে সঠিক পথে এগিয়ে যেত। নতুন প্রজন্ম আরও বেশি উপকৃত হতো।

আমরা যেন স্বার্থপর না হই। অন্যের কথা যেন বেশি করে ভাবি। মানুষের কথা ভাবি। সমাজের শক্তিকে আরও জাগিয়ে তুলতে হবে। সবকিছুর জন্যে সরকারের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। কোভিডের সময়ে দেখা গেছে মানুষকে সহযোগিতা করার জন্য মানুষ এগিয়ে এসেছে প্রবলভাবে। এটা ধরে রাখতে হবে। তাহলে আরও সুন্দর হবে সবকিছু।

আমাদের সময় ভালো ছিল, এখন আর কিছু হয় না এই ভালোর ব্যাখ্যা কী?

রামেন্দু মজুমদার: আমাদের সময় ভালো ছিল, এখন আর কিছু হয় না— এই কথাটি আমি বিশ্বাস করি না। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। আমি যখন পেছনে ফিরে তাকাই দেখি আমাদের সময়ে কাজ করে অনেক আনন্দ ছিল। আবার দুঃখ যে ছিল না তা কিন্তু নয়। প্রযুক্তির পরিবর্তন হয়েছে। অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। ভালো কাজ এখনো হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে চলতে হবে সবাইকে। সময়ের সঙ্গে অনেক কিছুর পরিবর্তনও হবে।

আমাদের মঞ্চ নাটকের যে ঐতিহ্য, গৌরব তা কি অনেকটাই ম্লান হয়ে গেল? এর কারণ কী শুধুই বদলে যাওয়া বাস্তবতা না আপনাদেরও দায় আছে?

রামেন্দু মজুমদার: না, মঞ্চ নাটকের ঐতিহ্য ও গৌরব ম্লান হয়নি। ১৯৭০, ১৯৮০ ও ১৯৯০ এর দশকে আমাদের মঞ্চ নাটকের দল কম ছিল। যার ফলে ভালো ভালো প্রযোজনা বেশি হত। চোখে পড়ত। এখন দল বেড়েছে। ভালো নাটক হচ্ছে না তা নয়। অনেক ভালো নাটক হচ্ছে। দর্শকদের চোখে হয়ত পড়ছে না।

এক্ষেত্রে বড় সংকটটা কী? দর্শকদের চোখে পড়ছে না কেন?

রামেন্দু মজুমদার: হল সংকট একটি বড় সমস্যা। দর্শক যেভাবে বেড়েছে সেভাবে মঞ্চ নাটকের হল বাড়েনি। ঢাকা শহর এখন কতো বড় হয়েছে! উওরা, গুলশান, বনানী, মিরপুর, ধানমন্ডি, পুরনো ঢাকায় হল দরকার। নাটকের দলগুলো অনেক বেশি অভিনয় করার সুযোগ পাচ্ছে না। যদি পেত তাহলে দর্শকদের চোখে পড়ত। এ জন্য মনে হতে পারে মঞ্চ নাটকের ঐতিহ্য ম্লান হয়ে গেল। আসলে তা নয়। হল সংখ্যা বাড়াতে হবে। মূল দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। এ নিয়ে দৃশ্যমান উদ্যোগ তো দেখি না।

আমাদের নাটক, ওয়েব সিরিজ মাঝে-মধ্যেই আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। কেউ বলেন নাটক ভালো হচ্ছে না, কেউ বলেন কিছু ওয়েব সিরিজ সমাজে ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

রামেন্দু মজুমদার: এসবের চূড়ান্ত বিচার করবেন দর্শক। তারা যদি পছন্দ না করেন তাহলে কাজটি হারিয়ে যাবে। দর্শক পছন্দ করলে কাজটি মনে গেঁথে থাকবে। দায়িত্বশীল আচরণ চাই, যারা বানাবেন তাদের কাছ থেকে। সেন্সরশিপ রেখে কাজ করা যাবে না। এখন প্রযুক্তির যুগ। অনেক কাজ হবেই। কিন্তু, দায়িত্বশীল হতে হবে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকেও দায়িত্বশীল হতে হবে।

আমাদের চলচ্চিত্র কি শেষই হয়ে গেল?

রামেন্দু মজুমদার: না। সংকটটা হলো সিনেমা হলে সব দর্শক যাচ্ছেন না এবং সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কারণটা কী? আমার মতে, প্রথম কারণ হচ্ছে— হলের পরিবেশ সেভাবে নেই। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে— আমি ঘরে বসেই যদি সিনেমা দেখতে পারি তাহলে পয়সা খরচ করে হলে যাব কেন? আগে বছরে ১০০টা সিনেমা হতো। এর বেশিও হতো। এখন অনেক কমে গেছে। কথা হচ্ছে এখন ছবির দর্শক কারা?

তাদের রুচির উন্নতির জন্য ছবি বানান কি? কেউ আছেন শ্রমজীবীদের জন্যে ছবি বানান। আজব কাহিনী জুড়ে দেন। নির্মাতারা তাদের ছবি বানান দর্শক রুচি অনুযায়ী। প্যারালাল সিনেমা কিন্তু নাম করেছে। তাদের সিনেমা ভালো হচ্ছে। কিন্তু সেভাবে দেখাবার জায়গা নেই। এটা একটা বড় সংকট।

এই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় কী?

রামেন্দু মজুমদার: হল সংখ্যা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া, সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। এককভাবে কিছু হবে না।

আপনার কাছে জন্মদিনের তাৎপর্য কী?

রামেন্দু মজুমদার: (হাসি) আমার জীবনের ৮০ বছর পূর্ণ হলো। ৮১ বছরে পা দেব। এটা যখন মনে করি তখন ভাবি একটা দীর্ঘ জীবন আমি কাটিয়েছি। কিন্তু, মানুষের বাঁচার সাধ তো মেটে না। জীবন তো একটাই। জীবনের প্রতি মায়া, প্রিয়জনদের প্রতি মায়া, পৃথিবীর প্রতি মায়া জন্ম নেয় প্রতিনিয়ত। সবকিছু ছেড়ে যাওয়ার এক ধরনের কষ্ট কাজ করে এই সময়ে এসে। এ কথাও সত্যি যে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে গেছি।

জীবনের তাৎপর্য যদি বলি— পেছনে ফিরে তাকালে অনেক সময় মনে হয় আবার যদি নতুন করে জীবন পেতাম, আবার যদি জীবন নতুন করে ফিরে আসত তাহলে আরও বেশি বেশি অর্থবহ কাজ করতাম। জীবনকে অর্থবহ করে তুলতাম আরও বেশি।

জন্মদিনে এসে পেছনে তাকান, না সামনের পরিকল্পনা করেন?

রামেন্দু মজুমদার: সামনে তাকাই অবশ্যই। কাজের মধ্যে নিজেকে কিভাবে জড়াব সেটাই ভাবি। কাজ করার কথা ভাবি। মানুষের কথা ভাবি। আমার জীবনের ব্রত মানুষের কল্যাণ। নিজে একা না সবাইকে নিয়ে ভালো থাকব, সবার জন্য কাজ করব— এটাই আমার জীবনের ব্রত। সেভাবেই আমি সামনে তাকাই। আমার সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করি।

মৃত্যু শব্দটি কী মাথায় আসে, চিন্তার কারণ হয়?

রামেন্দু মজুমদার: ইদানিং আসে। আগেও মাঝে মাঝে আসত। বিশেষ করে কোভিড আসার পর রাতে ঘুমানোর আগে মনে হতো আবার সকাল দেখতে পাব তো? এখন একটু কমেছে। কিন্তু, মাথায় আসে। খারাপ লাগে মৃত্যুর কথা মনে হলে। সবকিছু ছেড়ে একদিন বিদায় নিতে হবে— খারাপ তো লাগবেই।

মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশ যেভাবে চলার কথা ছিল সেভাবে চলল না, আপনারও কি তাই মনে হয়?

রামেন্দু মজুমদার: তা তো বটেই। আমাদের প্রধান আকাঙ্ক্ষা ছিল সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না। ধর্মনিরপেক্ষতার আলোকে সংবিধানে যা আছে তা মেনে চলা হবে। বৈষয়িক উন্নতি হয়েছে আমাদের কিন্তু নৈতিক দিক থেকে অবক্ষয় হয়েছে। নীতিবোধ হারিয়ে ফেলেছি। এর জন্য সমাজ যেমন দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী রাজনৈতিক দলগুলো। নীতির বালাই নেই। সমাজে ধর্মান্ধতা তৈরি হয়েছে।

সাম্প্রদায়িকতা তৈরি হয়েছে। ধর্ম-ভিত্তিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশে প্রত্যাশা করি না।

Comments

The Daily Star  | English

5 Edn institutions: Academic life of 40,000 in disarray

Academic activities in five major educational institutions in Dhaka remain suspended for the past week amid multiple incidents of clashes, affecting at least 40,000 students.

3h ago