জনসাধারণের ভোগান্তির লকডাউন!
যদি প্রশ্ন করি বাংলাদেশে লকডাউন বা শাটডাউন কাদের জন্য? উত্তর হচ্ছে— দরিদ্র ও সাধারণ পেশাজীবী মানুষের জন্যে। সোমবার থেকে যে লকডাউনের কথা ছিল, সেই লকডাউন শুরু হওয়ার পর, সার্বিক পরিস্থিতি দেখে যে কেউ এটা বিশ্বাস করবে, দেশে লকডাউন নামের প্রহসনটা শুধু শ্রমজীবী ও চাকরিজীবী মানুষের ভোগান্তি কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। এর আগেও চলমান ‘তথাকথিত লকডাউন’ এ বিষয়টিই প্রমাণ করেছে।
সোমবার থেকে শাটডাউন ঘোষণা দিয়ে শপিংমল, গণপরিবহন, উবার, অটোরিকশাসহ কলকারখানা বন্ধ করে দেওয়া হলো। ট্রেন, লঞ্চ ও দূরপাল্লার বাস আগে থেকেই বন্ধ। ঢাকা শহরে এসব বন্ধ হওয়া মানে বিশাল একটা অংশের রুটি-রুজি বন্ধ হয়ে যাওয়া। আমরা যতই হাসাহাসি করি না কেন— ঝোলাঝুলি করে, হেঁটে, ভ্যানগাড়িতে চেপে বা নৌকায় চড়ে এই মানুষগুলো গ্রামে ফিরে যাবেই। কারণ, ঢাকা তাদের জন্যে শুধু আয়-রুজির শহর, বসবাসের নয়। তাই হাজারো শ্রমজীবী মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে ছুটতে শুরু করল।
ঢাকার চাকরিজীবীরা দেখলেন সোমবারের পরিবর্তে শাটডাউন বৃহস্পতিবার নিয়ে যাওয়া হলো। কিন্তু, রোববার রাতে দেওয়া আরেক বিবৃতিতে বলা হলো, সোমবার থেকে সারাদেশে রিকশা ছাড়া সব গণপরিবহন এবং মার্কেট, শপিংমল ও পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ থাকবে। সর্বনিম্ন লোকবল দিয়ে অফিস চালাতে হবে। এই সর্বনিম্নটা বিচার করেন কে? প্রায় সব অফিসই খোলা। অফিস খোলা থাকলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আসতে বাধ্য। ব্যাংক-বীমা শতভাগ খোলা। বিজিএমইএ গার্মেন্টস খোলা রেখেছে, রাখবে। বেসরকারি লাভজনক প্রতিষ্ঠান খোলা। অথচ গণপরিবহন বন্ধ। তাহলে অফিস-যাত্রীরা কি উড়ে উড়ে অফিস যাবেন? এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে বা কার দাওয়া উচিত?
সোমবার যারা কাজের উদ্দেশ্যে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য রাস্তায় বের হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে স্পষ্টতই দুটি বিভাজন ছিল। খুব ছোট এক ভাগ মানে ব্যক্তিগত গাড়ির মালিক যারা, তারা অনায়াসে বাস-অটোরিকশাবিহীন ফাঁকা রাস্তায় দ্রুত অফিসে পৌঁছেছেন। অনেক মোটরসাইকেলের মালিকও সেই সুবিধাটা পেয়েছেন।
কিন্তু, মহাবিপদে পড়েছেন অসংখ্য ব্যক্তিগত গাড়িবিহীন অফিস-যাত্রী। রিকশাচালকরা ছিলেন রাস্তার রাজা, ফলে রিকশা ভাড়া হয়েছে দ্বিগুণ, তিনগুণ। প্রতিটা নিউজ চ্যানেল ও সংবাদপত্রে অফিস-যাত্রীদের এই ভোগান্তি নিয়ে খবর প্রকাশিত হচ্ছে এবং হবে। যেমন: সাবরিনা সুমি মিরপুর ১০ নম্বর থেকে যাবেন ফার্মগেটে। এক ঘণ্টা অপেক্ষার পরে কোনো পরিবহন না পেয়ে রিকশায় করে যাত্রা করেন। ক্ষোভ প্রকাশ করে সুমি বলেন, ‘লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে, অথচ অফিস খোলা আছে। চাকরি বাঁচাতে অফিসে তো যেতেই হবে। চাকরি চলে গেলে পরিবার নিয়ে বিপদে পড়তে হবে। যত কষ্টই হোক, আমাদের মতো কর্মচারীদের অফিস করতেই হবে।’ এ অবস্থা শুধু সুমির নয়, লাখো কর্মজীবীর।
গণপরিবহন বন্ধ রেখে অফিস খুলে রাখার ফলাফল যে কতটা ভোগান্তিময় ও ভয়াবহ হতে পারে, এ বিষয়ে তো আমাদের অভিজ্ঞতা আছেই। করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে এরকম সমন্বয়হীন সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েই চলেছে। কিন্তু, কেন? কেন ব্যক্তিগত গাড়িতে চেপে যাওয়া যাত্রীরা লকডাউনের বিধি-নিষেধের মধ্যে পড়বেন না? অন্যদিকে কেন গণপরিবহনে চলাচলকারী অফিস বা কারখানা যাত্রীরা হেঁটে, ভ্যানগাড়িতে বা অতিরিক্ত ভাড়া গুণে কর্মস্থলে পৌঁছাতে বাধ্য হবেন? এক সরকারের দুমুখো নীতি কেন? সরকার কি আপামর জনসাধারণের নাকি শুধু নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর?
আমি নিজে যখন একটি ব্যক্তিগত গাড়িতে চেপে অফিস থেকে বাসায় ফিরছিলাম, তখন রাস্তাজুড়ে গাড়ির বহর এত বেশি ছিল যে রীতিমতো ব্যক্তিগত গাড়ির মাধ্যমে সৃষ্ট যানজট তৈরি হয়েছিল। আর রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল অগণিত মানুষ, যারা ঠিক কীভাবে বাড়ি ফিরবেন, তা জানেন না। তাদের মধ্যে নারী যাত্রীদের ভোগান্তি আরও বেশি। আমার নিজের কাছেই লজ্জা লাগছিল এই অগণিত বিপদে পড়া মানুষের সামনে দিয়ে গাড়িতে করে আসতে।
এই যে লকডাউন বা শাটডাউন— এ নিয়ে তামাশা করতে করতে বিষয়টাকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন আমাদের নীতি-নির্ধারকরা, যা নিয়ে এখন শুধু ট্রল হয়, হাসাহাসিই হয়। আর যে বিধি-নিষেধ নিয়ে হাসাহাসি হয়, তা মানার বা মানানোর চেষ্টা করারও কোনো মানে হয় না। আমি নিশ্চিত যে বিশ্বের যতগুলো দেশে করোনার সংক্রমণ হওয়ার পর লকডাউন ঘোষণা হয়েছে, এর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই এরকম প্রহসনমূলক লকডাউন হয়েছে। যে লকডাউনের আওতায় শুধু শ্রমজীবী মানুষ এবং মধ্যবিত্তরা ঝামেলা ও অভাবের মধ্যে পড়েছেন এবং পড়বেন।
এই এক লকডাউনকে ঘিরে করোনা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি না হলেও হাসাহাসি হচ্ছে যথেষ্ট। কত ধরনের নাম আমরা পেয়েছি লকডাউন, কঠোর লকডাউন, সীমিত পরিসরে লকডাউন, সর্বাত্মক লকডাউন, মানবিক লকডাউন, ঢিলেঢালা লকডাউন, বিধি-নিষেধ, সীমিত পরিসরে বিধি-নিষেধ, কঠোর বিধি-নিষেধ, সর্বাত্মক বিধি-নিষেধ, হটজোন, রেড জোন, ইয়েলো জোন, হটস্পট, রেডস্পট, স্বাস্থ্যবিধি, সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি, শাটডাউন, কঠোর শাটডাউন, সম্পূর্ণ শাটডাউন।
এবারেরটা কি সত্যি ‘কঠোর’ ভ্যারিয়েন্টের লকডাউন? লোকে বলছে, করোনাভাইরাসের চাইতে আমাদের লকডাউনের ভ্যারিয়েন্টই নাকি বেশি। লকডাউনের এত নাম কি অন্য কোনো দেশে হয়েছে নাকি হতে পারে? আমাদের নীতি-নির্ধারকরা কি জানেন না যে, বিশ্বে কোন দেশে কীভাবে লকডাউন দেওয়া হয়েছে এবং পরে দফায় দফায় তা তুলেও নেওয়া হয়েছে?
মানুষের কষ্ট হবে, খেটে খাওয়া মানুষ অভাবে থাকবে, এই কথা ভেবে সরকার যে তরিকার লকডাউন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে এই শ্রেণির মানুষের কষ্ট বেড়েছে, কমেনি। জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি ১৪ দিনের সম্পূর্ণ ‘শাটডাউন’ দেওয়ার যে সুপারিশ করেছিল, তা সরকার অতীতেও মানতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে বলে মনে হচ্ছে না। মাঝখান থেকে জনদুর্ভোগ আর ট্রলের পরিমাণ বাড়বে।
সত্যি সত্যিই যদি সরকার কঠোর লকডাউন দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চান, তাহলে তাদের অবরুদ্ধ ১৪ দিন বা ২০ দিনের জন্যে শহরের, বিশেষ করে ঢাকার খেটে খাওয়া মানুষের খাদ্যের সংস্থান করতে হবে। ওয়ার্ডভিত্তিক খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। নয়তো সবাইকে ছেড়ে দিন, যে যেভাবে পারে বাঁচুক। তবে, আর্থিক ও মানবিক বিপর্যয় এড়াতে ছোট-বড় সব ব্যবসায়ী, অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবী এবং নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী শুরু থেকেই লকডাউনের বিপক্ষে। তারা লকডাউনের পরিবর্তে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের শর্তে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার পক্ষে। জানি না সরকার কী করবে।
খুব সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে আমরা বুঝতে পারি, একটি দেশের সরকার যখন কোনো প্রজ্ঞাপন দেয়, তখন তা মিটিং করে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমেই হয়। কাজেই বারবার এভাবে প্রজ্ঞাপন দেওয়া এবং একদিন বাদেই সেই প্রজ্ঞাপন বা সিদ্ধান্ত বাতিল করা কি সরকারের চূড়ান্ত সমন্বয়হীনতা প্রমাণ করে না?
সংক্রমণ ও মৃত্যুর আশঙ্কাজনক ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে এক সপ্তাহের জন্যে ঘোষিত এবারের লকডাউন সর্বোচ্চ কঠোরতার দাবি রাখলেও বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আগামী ১ জুলাই থেকে কী হবে, তাও জানি না। এবারও অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে গ্রামের দিকে ছুটেছেন বা ছুটতে বাধ্য হচ্ছেন। সামনে কোরবানির ঈদ। কোরবানির বাজারে গরু, ছাগল আসবে, মানুষও কিনতে যাবে। কীভাবে কী হবে, তা এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়।
আমাদের দেশে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, লকডাউন ঘোষণা করার দায়িত্ব সরকারের, কিন্তু, মানানোর দায়িত্ব কার, সেটা কেউ জানে না। তুরস্কে করোনাকালে ৪৮ ঘণ্টার জন্যে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে নোটিশ দিয়ে করোনাভাইরাস ঠেকাতে লকডাউন ঘোষণা করার জেরে দলে-দলে মানুষ প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে বাড়ির বাইরে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছিল, ঠিক আমাদের মতোই। এই পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করেছেন তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেমান সয়লু। সে দেশের ৩১টি রাজ্যে লকডাউন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে তিনি পদত্যাগ করেন।
টুইটারে এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘আমার অভিজ্ঞতা বলছে— এ ধরনের পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, এর দায়-দায়িত্ব আমার কাঁধে এসে পড়বে। এই কারফিউ দেওয়ার ফল নেতিবাচক হলে এবং মহামারিটি ছড়িয়ে পড়লে তার দায় আমার কাঁধে চেপে আমার সব সম্মান বিলীন হয়ে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি সম্মানের সঙ্গে যে দায়িত্ব পালন করছিলাম, সেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যাচ্ছি। সৃষ্টিকর্তা আমাদের জাতিকে রক্ষা করুক।’
ভয় পাবেন না, আমাদের দেশে এরকম কোনো নজির নেই, নজির সৃষ্টিও হবে না। এখানে সব দায়িত্ব সাধারণ জনগণের।
শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments