ব্যবসায় সাফল্য পরিমাপে প্রয়োজন নতুন মাপকাঠি

প্রতীকী ছবি | সংগৃহীত

বছরান্তে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কতটা সফল, তা কীভাবে পরিমাপ করা হয়? অবশ্যই আর্থিক হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে। একটি ব্যবসা কতটা সফল, তা নির্ধারণের প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্যায়িক লেনদেন ও আয়-ব্যয়ের হিসাব। একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে সাধারণত তিন মাস অন্তর একবার করে আয়-ব্যয় হিসাব করা হয় এবং বছর শেষে বার্ষিক হিসাব করা হয়। যার মাধ্যমে সেই প্রতিষ্ঠান কতটা লাভবান হয়েছে এবং কী পরিমাণ লভ্যাংশ শেয়ারহোল্ডারদের মাঝে বিতরণ করা হবে, তা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।

আয় বৃদ্ধি ব্যবসায়ে সাফল্য অর্জনের জন্যে অবশ্যই ইতিবাচক। একইভাবে মুনাফা বৃদ্ধিও ব্যবসায়ের জন্যে ভালো। বিনিয়োগকারীরা প্রত্যাশা করেন, তাদের বিনিয়োগ করা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের আয় ও মুনাফা বাড়বে। তবে, তাদের প্রত্যাশিত আয় ও মুনাফার পরিমাণ থেকে যেকোনো প্রকার বিচ্যুতি ঘটলে ওই প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দরপতন হয়। কাজে শেয়ারের দরপতন রোধের একমাত্র উপায় হলো প্রতিষ্ঠানের মুনাফা বৃদ্ধি। আর সেটি খরচ কমিয়ে বা আয় বাড়িয়ে কিংবা এই দুটির সংমিশ্রণেই হোক না কেন। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির সূচনাকাল থেকে ব্যবসার এই ধারা প্রচলিত। প্রবৃদ্ধি ও মুনাফা অর্জনই হলো সাফল্য পরিমাপের একমাত্র মানদণ্ড।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর বদৌলতে মানুষ এখন সহজেই অনেক তথ্য জানতে পারে। আর বাজারে কোন প্রতিষ্ঠান কতটা সফল, তা জানাটাও অত্যন্ত সহজসাধ্য। আর এর ফলে ব্যবসায় সাফল্য নির্ধারণে পরিমাপক হিসাবে প্রবৃদ্ধি ও মুনাফা অর্জনের বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। তবে, এতে এক বিশাল সমস্যা রয়েছে, যা আমরা কেউ অনুধাবনের চেষ্টা করি না। প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রতি আচ্ছন্নতা আর সাসটেইনেবিলিটি বা টেকসইয়তার মধ্যে সুসংগতি নেই। অর্থাৎ ক্রমাগত প্রবৃদ্ধি অর্জন মানেই হলো ধরণীর ওপর ক্রমাগত চাপ বৃদ্ধি করা। এমনকি আপনি যদি নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও পদ্ধতি ব্যবহার করেন না কেন, ব্যবসার প্রবৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ পৃথিবীর ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।

ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী হিসেবে একজন ব্যবসায়ীকে কেবল তার প্রতিষ্ঠানের প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাপকাঠিতে আপনি কতটা সফল তা নির্ধারণ করা হয়। ধরুন আপনি একটি বিশাল বহুজাতিক কোম্পানি পরিচালনা করছেন। সেখানে আপনি আপনার প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডারদের বললেন, আগামী পাঁচ বছরে প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরিবর্তে সাসটেইনিবিলিটির ওপর বিনিয়োগ করবেন। তাতে কী হবে? আপনার ব্যবসায় শেয়ারদর পতন ঘটবে এবং শেয়ারহোল্ডাররা পাথরে টুকরো ছুড়ে মারার মতো আপনার ব্যবসাকেও ছুড়ে ফেলে দেবে। তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ করপোরেট বিশ্ব ব্যবস্থায় প্রবৃদ্ধিই একমাত্র লক্ষ্য এবং টিকে থাকার একমাত্র উপায়। সব সুবিধা বা সাফল্য তাদেরই, ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি অর্জনই যাদের একমাত্র লক্ষ্য এবং তা যেকোনো মূল্যেই হোক না কেন।

এমন এক বাস্তবতায় সাসটেইনেবিলিটির মতো এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়টির অবস্থান কোথায়? স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, বিশ্বের বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সাসটেইনেবিলিটিতে কম-বেশি বিনিয়োগ করছে। কিন্তু, ক্ষেত্র বিশেষে প্রয়োজনের অনুপাতে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ যেন বিশাল সমুদ্রে এক ফোটা জলসদৃশ। তাদের বিনিয়োগ ব্যবসায় মুনাফা বৃদ্ধিতে কতটা প্রভাব রাখবে, বিনিয়োগ করার সময় সে বিষয়টি বিনিয়োগকারীরা বিবেচনা করে থাকেন। এমনকি সাসটেইনেবিলিটিতে বিনিয়োগ করার সময়ও বিনিয়োগকৃত অর্থ কী পরিমাণে ফেরত আসবে, সেই হিসাবটাও করে থাকেন।

আবারও বলছি, একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠনের সফলতা সেই প্রতিষ্ঠানের প্রবৃদ্ধি দেখেই বিচার করা হয়। সাসটেইনেবিলিটিতে বিনিয়োগ করলে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে হয়তো কিছুটা প্রশংসিত হবে। বিনিয়োগকারীরা কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠানের একমাত্র মুনাফা বা প্রবৃদ্ধির দিকেই লক্ষ্য রাখেন।

এই বিষয়টি কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, সে প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের পরামর্শ হলো, তাদের বিনিয়োগকৃত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘমেয়াদে কীভাবে সাসটেইনেবিলিটির চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার উদ্যোগ নিচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণ করা। উদাহরণস্বরূপ: এনভায়রনমেন্টাল, স্যোশাল অ্যান্ড গভর্ন্যান্সে (ইএসজি) প্রয়োগ ক্রমে বৃদ্ধি পাওয়া বিষয়টি লক্ষণীয়। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইএসজি ব্যবহার করে ব্যবসায়িক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সাসটেইনেবিলিটিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে সুফল ও সুবিধা রয়েছে।

এই তত্ত্বের মূল বিষয় হলো, ইএসজি কৌশলগুলো প্রয়োগে একদিকে বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষা হয় এবং অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক সুফল বয়ে আনে। এই যুক্তির মধ্যে সত্যতা নিহিত রয়েছে। কিন্তু, সেটি দীর্ঘমেয়াদের পরিপ্রেক্ষিতে। কাজেই সাসটেইনেবল বা টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন, এমনকি শূন্য প্রবৃদ্ধি অর্জনের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে অতি দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করলে তা সম্ভবত একটি সফল বিনিয়োগ হতে পারে।

কিন্তু, আমরা জানি যে, এভাবে বিনিয়োগ করা হয় না। একজন বিনিয়োগকারী সাধারণত ২০-৩০ বছর মেয়াদে এমনকি এর চেয়েও কম সময় ধরে বিনিয়োগ করে থাকেন। এসময়ের মধ্যে তিনি তার বিনিয়োগের ফেরত প্রত্যাশা করেন এবং বিদ্যমান ব্যবসায়িক ধারা বা সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে সেটি পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি।

এই প্রচলিত ব্যবসায়িক ধারাকে পরিবর্তনের উপায় কী? একটি ব্যবসা প্রবৃদ্ধি অর্জনে ধীর গতিতে এগোবে, অথবা প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে না, এমনকি প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও সেটি হবে দায়িত্বশীলতার সহিত অর্থাৎ কার্বন নিউট্রাল বা কার্বন নিরপেক্ষ। এ ধরনের ব্যবসায়িক ধারা আমরা কি চালু করতে পারব? এ প্রশ্নটি নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। এমনকি আমার ব্যবসার ক্ষেত্রেও এটি ভেবেছি। আমি বিশ্বাস করি একটি উপায় রয়েছে। আর সেটি হলো শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। বিশ্বের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো তাদের উদ্ভাবনী শক্তি ও দক্ষতাকে দ্রুত কাজে লাগানোর সময় এসেছে।

যেসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ধরণীর কল্যাণের কথা বিবেচনা করে সে অনুযায়ী কর্মপন্থা অবলম্বন করে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছে, তাদের এই মহতি উদ্যোগের জন্য আর্থিক প্রণোদনা কোথায়? আমি শুনেছি অনেক ব্র্যান্ড নাকি পোশাক উৎপাদনের পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে এবং টেকসই পোশাক উৎপাদন করার দিকে মনোনিবেশ করছে, যেন সেই কাপড়গুলোর ব্যবহারকাল দীর্ঘ হয়। যেমন: মার্কিন ডেনিম ব্র্যান্ড লেভি সম্প্রতি ঘোষণা করছে, তারা ‘স্লো ফ্যাশন’ বা ধীরগতির ফ্যাশনের দিকে মনোনিবেশ করবে। এমন একটি শিল্প যেখানে প্রবৃদ্ধি অর্জনই সবার মূল লক্ষ্য, সেখানে ‘স্লো ফ্যাশন’র মতো উদ্যোগ ও প্রবৃদ্ধি অর্জন এ দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাটা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ বলে স্বীকার করেছে লেভি। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে লেভি এ উদ্যোগের জন্য কোনো ধরনের উৎসাহব্যঞ্জক সুবিধা পাবে কি? যেমন কর রেয়াত অথবা অনুদান?

কোনো ব্র্যান্ড লেভির মতো পথ অনুসরণ করলে তাকে অবশ্যই উৎসাহ প্রদানের জন্যে প্রণোদনা ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ ধরণী রক্ষায় লেভির অনুসৃত পথই হচ্ছে বাস্তবসম্মত। একইভাবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে লাগামহীন প্রবৃদ্ধি অর্জনের ধারাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একীভূতকরণ কি পৃথিবীর কল্যাণের জন্য সর্বোত্তম পন্থা? ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একীভূতকরণ আরও প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথকে সুগম করবে। কিন্তু, সেটি বিনিয়োগকারীদের ছাড়া অন্য কারো জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে কি?

ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো এই ইস্যুতে নিজেরা নিজেদের পর্যবেক্ষণ করবে না। বর্তমান বাস্তবতায় প্রবৃদ্ধিই সর্বাগ্রে বিবেচ্য বিষয়। কাজেই এই প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রবণতা ভিন্ন ব্যবসায় অন্যান্য পন্থা অবলম্বনকে প্রণোদনার মাধ্যমে যাতে উৎসাহিত করা যায়, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে সেরকম কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে। যদি তারা সেটি করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে পৃথিবী রক্ষা করার জন্য ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করা কঠিন হয়ে পড়বে।

মোস্তাফিজ উদ্দিন: ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments