কেমন অভিজ্ঞতা নিয়ে বড় হবে শিশুটি

কানাডার অন্টারিও প্রদেশের লন্ডন শহরে হামলার স্থানে শ্রদ্ধা জানিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন নিহতদের স্বজন। ছবি: রয়টার্স

কানাডার অন্টারিও প্রদেশে একটি মুসলিম পরিবারের ওপর দিয়ে ট্রাক চালিয়ে চার জনকে হত্যার ঘটনা কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটা মৌলবাদী সহিংস হামলা। একটা পরিবারকে শুধু মুসলমান হওয়ার জন্যই প্রাণ দিতে হলো। মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা থেকে এই হামলা চালিয়েছে ঘাতক।

কানাডার মতো সুসভ্য একটি দেশে যখন হেইট ক্রাইমের মতো কোনো ঘটনা ঘটে, তখন উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না এবং এটাকে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখাও ঠিক হবে না।

আশার কথা হচ্ছে, স্থানীয় পুলিশ এই ঘটনাকে ‘ঘৃণার অবর্ণনীয় বহিঃপ্রকাশ’ ও ‘ইসলাম ভীতি’ আখ্যা দিয়েছে। সাধারণত মুসলিম হত্যার সঙ্গে কেউ জড়িত হলে, তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়। এখানে তা হয়নি। তবে ‘ইসলাম ভীতি’ বলতে পুলিশ প্রশাসন কী বুঝাতে চেয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। কারণ ইসলাম ভীতিকর কোনো ধর্ম নয়। সারাবিশ্বের সাধারণ মুসলমানদের ভয় পাওয়ারও কোনো কারণ নাই। তাহলে পুলিশ কেন এরকম একটি ধারণা পোষণ করবে? ‘ইসলাম ভীতি’ হিসেবে এই ঘটনাকে বিচার করা হলে, তা ভুল হবে। কানাডায় বসবাসরত অসংখ্য মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য এই ঘটনা ভয়াবহ ট্রমা হয়ে দাঁড়াবে।

যারা ধর্মের কথা বলে জঙ্গি হয়, তারা সবাই এক। সেখানে কে কোন ধর্ম বা বর্ণের সেটা কোনো পরিচয় নয়। তাদের পরিচয় একটাই, তারা মৌলবাদী। মুসলিম ভীতি নয়, বরং মুসলিম বিদ্বেষ থেকে খুনি এই ভয়ংকর অপরাধ ঘটিয়েছে। অবশ্য কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, অন্টারিওর এ ঘটনায় তিনি আতঙ্কিত। ‘এ দেশে ইসলাম ভীতির জায়গা নেই। এ ধরনের আচরণ নিকৃষ্ট ও বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। এগুলো বন্ধ করতেই হবে।’

কানাডার মতো সভ্য ও সুশৃঙ্খল দেশে এধরণের একটি ঘটনা অন্য অনেক দেশের শত ঘটনাকেও হার মানায়। জঙ্গিবাদী দেশ বলে সাধারণত যে দেশগুলোর প্রতি আঙ্গুল ওঠানো হয়, যে দেশের নাগরিকদের সহসা ভিসা দেওয়া হয় না, আমি সেইসব দেশের কথা বলছি। বাংলাদেশে যখন হলি আর্টিজানের ঘটনা ঘটেছিল, তখন কানাডাপ্রবাসী প্রতিটি বাংলাদেশি মুসলিম পরিবার লজ্জিত ও দুঃখিত হয়েছিল। বেশ অনেকদিন এই অপরাধের দায়ভার বহন করতে হয়েছিল তাদের। সেটাও ছিল এরকমই বিদ্বেষপ্রসূত একটি পূর্ব পরিকল্পিত জঙ্গি হামলা। সেই কাজের দায়ভার বাংলাদেশের জনগণের বা সরকারের ছিল না।

কানাডার বিভিন্ন প্রদেশে মুসলমান বিদ্বেষী ঘটনায় উদ্বেগ বাড়তে থাকার মধ্যেই এ হামলা হলো।  কেবল ধর্ম পরিচয়ের কারণে হামলার শিকার হয়েছেন তারা। তথ্য উপাত্ত এটাই প্রমাণ করে যে এতো সুন্দর একটি শাসনব্যবস্থার মধ্যেও জাতিবিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও কট্টর ডানপন্থী মত মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।

এরকমই আরও ভয়াবহ ঘটনা আমরা দেখেছি নিউজিল্যান্ডের মসজিদে। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে কিউবেকের একটি মসজিদে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে ছয় জনকে হত্যা করেছিল ঘাতক। গত কয়েক মাসে আলবার্টা প্রদেশে মুসলিম নারীদের গালিগালাজ ও শারীরিক লাঞ্ছনার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি ঘটনাই মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা প্রসূত। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো, হামলাগুলো চালানো হচ্ছে শুধু মুসলিমদের ওপর।

কানাডার মতো দেশে ‘ইসলাম ভীতি’র কারণে একটি পুরো পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার মতো ঘটনা আরও বিপদজনক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। কাজেই আমরা আশা করবো কানাডার মাটিতে এই ঘটনাকে সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে বিবেচনা করে অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা হবে। সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে হামলাকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে সাম্প্রদায়িক হানাহানি আরও বাড়বে।

এ ধরণের অনভিপ্রেত, দুঃখজনক ও ভয়াবহ ঘটনা কানাডার মতো সভ্য দেশে আরও ঘটেছে এবং সেটা সংখ্যালঘু আদিবাসীদের ওপর। এইতো মাত্র কিছুদিন আগে কানাডার ক্যামলুপস স্কুলে ২১৫ শিশুর একটি গণকবর পাওয়া গেছে। এই শিশুদের অপরাধ ছিল তারা ইংরেজি বলা সাদা চামড়ার শিশু ছিল না। তারা ছিল স্থানীয় আদিবাসী আমেরিকান ইন্ডিয়ান। এই ঘটনা জানার পর দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে।

ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে কানাডার আদিবাসী শিশুদের জোর করে মূলধারার সংস্কৃতি আত্মস্থ করাতে দেশটির আবাসিক স্কুলে ভর্তি করানো হতো। কানাডায় এরকম একটি ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর সেখানকার রাষ্ট্রযন্ত্র সরাসরি চার্চকে দায়ী করতে পারছেন। প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজনে চার্চকে আদালতে নেওয়ার কথা বলেছেন। যা আমাদের মতো দেশে অসম্ভব। এই ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো নিজেই ক্যাথলিক চার্চকে স্কুল সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করতে বলেছেন। কারণ সরকারি অর্থে চলা এই স্কুলটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিল রোমান ক্যাথলিক চার্চ। চার্চ ওই শিশুদের সম্পর্কে তথ্য সরবরাহে অসহযোগিতা করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

সেদিন একটি লেখায় পড়লাম কানাডার আদিবাসী কিশোরী মর্নিংস্টার মারক্রেডির কথা। সরকারি চিকিৎসকরা তার ডিম্বাশয় কেটে ফেলে দিয়েছিল যাতে সে সন্তান নিতে না পারে। বিংশ শতকের প্রথম দিকে আমেরিকায় ও কানাডায় মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের পরামর্শে একটি নতুন আইন চালু হয় হেরিডিটি ল বা ইউজিনিক্স স্টেরিলাইজেশন আইন নামে। প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় যে সাদা ককেশিয়ানরা ছাড়া অন্য বাদামী বা কালো বর্ণের যারা আছেন, তারা মানুষ ও বানরের মাঝামাঝি প্রজাতি। তারা নিম্ন প্রজাতি।

এই ইউজিনিক্স স্টেরিলাইজেশন আইন প্রয়োগের মাধ্যমে আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্য ও কানাডায় লাখো আদিবাসী নারী-পুরুষকে তাদের অনুমতি ছাড়াই জোর করে বন্ধ্যাকরণ করা হয়েছে। ইউজিনিক্স স্টেরিলাইজেশন আইনের যুক্তি ছিল যে এইসব নারী-পুরুষেরা কম বুদ্ধির ও সভ্য সমাজে বাস করার যোগ্য নয়। তারা সমাজের বোঝা। তাই তাদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

শিশুদের গণকবর পাওয়ার ঘটনাটি জানার পরই মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। সভ্যতার সেরা বলে আমরা যাদের মনে করি, তারা সেরা হলেও তাদের মধ্যে অনেক সাইকোপ্যাথের বসবাস। তারা শুধু নিজেদের বড় বলে মনে করে। সবাইকে হটিয়ে নিজেরাই কেবল থাকবে।

এরপর একই পরিবারের চার জনকে হত্যার ঘটনাটি দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। নিরাপদ দেশ তাহলে কোনটা? সাম্প্রদায়িক হানাহানি নেই কোন দেশে? মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব কেন দেশে দেশে বাড়ছে? এই পরিবারের যে শিশুটি বেঁচে গেল, সে কতটা ট্রমা নিয়ে বড় হবে, তা কী আমরা জানি? এই শিশুটিই যে পরিবারের হত্যার বিচার করার জন্য নিজেই একদিন জিহাদি হয়ে উঠবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে?

যাক, এরপরেও আমরা বিশ্বাস করি কানাডার মতো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সরকার, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও প্রশাসন স্বচ্ছভাবে কাজ করবে এবং সকল ধর্ম মতের ওপরে গিয়ে নাগরিকের অধিকারের প্রশ্নে রায় দেবেন।

 

শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।) 

Comments

The Daily Star  | English
Anti-Discrimination Students Movement

Students to launch a party by next Feb

Student leaders who spearheaded the July-August mass uprising are planning to launch a political party by early February 2025 and contest the next general election.

8h ago