‘ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবারই তো সামাজিক সম্মান আছে’
করোনার শুরুতে মাস্ক না পরায় যশোরের মনিরামপুরে উপজেলার সহকারী কমিশনারের (ভূমি) চার বৃদ্ধকে কান ধরানো ও তাদের ছবি তোলা, কয়েকদিন আগে নারায়ণগঞ্জে ৩৩৩ নম্বরে খাদ্য সহায়তা চেয়ে উল্টো উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ধার্য করা জরিমানা দিতে মেয়ের সোনার গয়না বন্ধক ও ঋণ করা এবং সম্মানহানীর পর ঘর থেকে বের হতে না পারা, পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সচিবালয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাতে সাংবাদিক রোজিনার শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়া, বগুড়া আদমদীঘিতে ছাগল পাতা খেয়ে ফেলায় মালিকের অনুপস্থিতিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দুই হাজার টাকা জরিমানা করার ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে আলোচনায় এসেছে রাষ্ট্রের কর্মচারীরা।
প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণের ওপর প্রজাতন্ত্রের বেতনভুক্ত কর্মচারিদের এমন সব আচরণের বিষয় নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব আবু আলম মো. শহীদ খানের সঙ্গে।
এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘এগুলোকে ক্ষমতার অপব্যবহার বলা যায়। কত কিছু হয়ে যাচ্ছে সমাজে, সেখানে এই ধরনের ঘটনাগুলোতে জরিমানা করা নৈতিকভাবে শোভা পায় না। দেশে কত ধরণের অপরাধ হচ্ছে সেগুলো দেখে না কেন?’
এ ধরণের পরিস্থিতি তৈরির পেছনে যথাযথ প্রশিক্ষণ না হওয়াকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘যথাযথ প্রশিক্ষণ তাদের হয়নি। আমরা যখন চাকরিতে ঢুকলাম তখন যেভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, এখনতো ওইভাবে নেই। জানি না এখন প্রশিক্ষণ কেমন হয়। একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে পরীক্ষা দিয়ে ক্যাডার হন। তাকে তো প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানসিকভাবে এই কাজের জন্য তৈরি করতে হবে। সেখানে ঘাটতি আছে বলেই এমনটা হচ্ছে।’
এমন কার্যক্রমের কারণে মানুষের ভেতরে ক্ষোভ তৈরি হবে জানিয়ে এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘এতে সরকারি কাজে তারা বিভিন্ন সময়ে বাধার সম্মুখীন হবেন, শান্তিপূর্ণভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হবে না, এমন নানা ধরণের সমস্যা হতে পারে।’
সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার ঘটনায় মামলা ও অজ্ঞাতনামা হাজারো আসামি থাকার বেশ কিছু উদাহরণ রয়েছে সম্প্রতি সময়েই।
এই ধরণের ঘটনা বন্ধে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দায়িত্বরত অবস্থায় মানুষের সঙ্গে তাদের আচরণবিধি বা কোড অব কনডাক্ট থাকা দরকার। যারা অন্যায় করবে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। যদিও তেমন কিছু চোখে পড়ে না।’
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী প্রায়শই বলেন, ইউএনওসহ সকল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সংজ্ঞা অনুসারে এবং দেশের আইন ও সরকারি চাকরি আইন অনুযায়ী জনগণের সেবক। কিন্তু, দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রতিক ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, তারা ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে শারীরিক, আর্থিক ও সামাজিক হয়রানি করছেন। এগুলো শুধু তাদের চাকরিবিধি অনুযায়ীই নয়, অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ আইনেও অপরাধ। এর জন্য তাদের অনুকরণীয় শাস্তি প্রাপ্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ ধরনের ক্ষমতার অপব্যবহারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করলে এটাই বোঝায় যে, সরকার এ ধরণের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিচ্ছে এবং তাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সরকারের মনে রাখতে হবে, তারা ঔপনিবেশিক শাসক নয়। তারা কেবলমাত্র সেই জনগণের সেবায় নিয়োজিত, যারা সকল ক্ষমতার উত্স।’
সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীরা যা কিছু করবেন, আইনের মধ্যে থেকেই করবেন। কান ধরানোর ঘটনা নিয়ে তো অনেক সমালোচনা হয়েছে। এটা তো করা যায় না। এমন তো কোনো বিধান নেই। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবারই তো সামাজিক সম্মান আছে। আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে, আমরা গণকর্মচারী। সকল সময় জনগণের সেবা করা আমাদের কাজ এবং আইন প্রয়োগ করার সময় আমাদের সহানুভূতির সঙ্গে প্রয়োগ করতে হবে।’
নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, যশোরের ঘটনার উদাহরণে টেনে তিনি বলেন, ‘এর প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ভুল হয়েছে। তাদের যারা সুপারভাইজার আছেন, তারা সঙ্গে সঙ্গে এসব ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেননি।’
আইনের প্রয়োগ করতে গিয়ে অনেক বেশি সহনশীলতা এবং সংবেদনশীলতার সঙ্গে কাজ করা উচিত বলে মনে করেন সাবেক এই জ্যেষ্ঠ সচিব।
গণমাধ্যমে এ ধরণের বিষয়গুলো উঠে আসা একটি ভালো দিক জানিয়ে আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, ‘প্রশিক্ষণের সময় এই উদাহরণগুলো নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। এতে করে ভবিষ্যতে আমরা আরও বেশি মানবিক প্রশাসন দেখতে পারব।’
‘মানবিক প্রশাসনের জন্য আগে মানবিক রাষ্ট্র চাই। মানবিক রাষ্ট্র তৈরি করতে না পারলে মানবিক প্রশাসন, মানবিক পুলিশ কিছুই আমরা তৈরি করতে পারব না,’ যোগ করেন তিনি।
এক্ষেত্রে শাসকদের দায়িত্ব অনেক বেশি জানয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের শাসক দল, অন্যান্য রাজনৈতিক দলসহ সবার একসঙ্গে কাজ করতে হবে।একটি মানবিক রাষ্ট্র তৈরি করতে। এদেশের নাগরিকরা একটি মানবিক রাষ্ট্র চায়।’
বিভাগীয় যে শাস্তির বিধান রয়েছে তার কতটা প্রয়োগ হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিভাগীয় শাস্তি দেওয়া হয়। এর সব তো আর খবরে আসে না। তবে, সেগুলোকে যথেষ্ট মনে না-ও হতে পারে কারও কারও কাছে। সেক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন।’
Comments