নারী অধিকার আন্দোলন কার হাতে, তারা কতটা প্রস্তুত?
বাংলাদেশে নারী ও মেয়ে শিশুর ওপর নির্যাতন, হত্যা এবং সহিংসতা বেড়েই যাচ্ছে। এসব যারা করছে, তাদের দুঃসাহস এতটাই বেড়েছে যে অন্যায় করে সামাজিক মাধ্যমে তা পোস্ট করছে এবং নিজেরাই আজেবাজে মন্তব্য করছে। এরকম ঘটনা একটার পর একটা ঘটেই চলেছে। কিন্তু, ঘটনাগুলোর কোনো সুরাহা হচ্ছে না। অপরাধীকে বিচারের দরজায় নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। বিচারের মুখোমুখি হলেও বিভিন্ন ফোকর গলে অপরাধী বের হয়ে আসছে।
কাজেই একদিকে অপরাধীরা আস্কারা পাচ্ছে, অন্যদিকে বিচারের দাবি ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ছে। উল্লেখ, মুনিয়া, তনু, নুসরাতদের সংখ্যা বাড়ছেই। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা সাধারণ মানুষকে ব্যথিত ও উদ্বিগ্ন করে তুললেও বিচারের বাণী নীরবেই থেকে যাচ্ছে।
পাশাপাশি দেখছি, আমাদের দেশের নারী অধিকার সংগঠনগুলো নারী নির্যাতনের বিচারের দাবিতে ক্রমশ দুর্বল ভূমিকা রাখছে। দাবি আদায় বা বিচারের দাবি জানানোর ক্ষেত্রে তাদের শানিত ভাবটা অনুপস্থিত। রাজপথেও তাদের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করার মতো। কিন্তু কেন?
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ৭১ জন নারী শুধুমাত্র স্বামীর হাতেই নিহত হয়েছেন। শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩৮৭টি। এই নির্যাতনের মধ্যে সবধরনের নির্যাতন আছে। এছাড়া আরও ৩৮৭ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ৭১টি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। কেউ কি এইসব ঘটনার প্রতিবাদ করেছেন? মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে কোনো জবাব দাবি করেছেন? এই দুই মন্ত্রণালয়ের কি কোনো ব্যাখ্যা তারা পেয়েছেন?
অব্যাহত প্রতিবাদ, মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকার পরেও কেন ধর্ষণের হার বাড়ছে? এরজন্য দায়ী বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা, নানাধরনের আর্থ-রাজনৈতিক-সামাজিক প্রভাব এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদিচ্ছার অভাব। সেই সঙ্গে বলতে হচ্ছে, দাবি-দাওয়া আদায়ে নারী অধিকার কর্মীদের জোরালো ভূমিকার অভাব রয়েছে।
অথচ সেই ব্রিটিশ আমল থেকে আজ পর্যন্ত নারীকে একটা অসম অবস্থায় থেকে প্রতিযোগিতায় নামতে হচ্ছে। নারীর এই সামনে এগিয়ে যাওয়ার সংগ্রাম কিন্তু একদিনের নয় বা একজনের নয়। যুগে যুগে নারী নেত্রীরা সব বাধা পেরিয়ে এগিয়ে এসেছেন বিজয়ের ঝাণ্ডা উঁচু করে। সেইসব যোদ্ধাদের অনেকেই চলে গেছেন। রেখে গেছেন তাদের আদর্শ এবং অসমাপ্ত কাজ। আমাদের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, নারীর স্বাধিকার ও অধিকার আন্দোলনগুলোর পাশাপাশি ভূমি আন্দোলন, নারী শিক্ষার আন্দোলন, শিল্প, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, গণমাধ্যমে টিকে থাকার সংগ্রামে যেসব নারীর কথা ইতিহাসে লেখা আছে তাদের পাশাপাশি অনেকেই আছেন যাদের নাম ইতিহাসে লেখা নেই। কিন্তু আজকের এই অর্জনে তাদের অবদানও কম নয়।
আয়েশা খানম, বুলা আহমেদ, রাখী দাস পুরকায়স্থ চলে গেলেন পাশাপাশি সময়ে। তাদের এই চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন জাগছে। ঘরে-বাইরের আন্দোলন, নিপীড়ন-নির্যাতন সহ্য করা, মিটিং-মিছিল করা, সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো, বক্তব্য রাখার মত সাহসী এবং সরকারের সঙ্গে সমঝোতা ও ন্যায্য হিস্সা আদায় করার যোগ্যতাসম্পন্ন এবং বিভিন্ন সংস্থার কাছে গ্রহণযোগ্য নারী নেতৃত্বের সংখ্যা কি ক্রমশ কমে আসছে? কেউ কেউ অবসরে গেছেন, কেউবা মারা গেছেন অথবা কেউ কেউ নানা কারণে কথা বলতে ইচ্ছুক নন। এক কথায় বলা যায় দাবি আদায়ের জন্য বলিষ্ঠ, প্রতিবাদী ও এক্টিভিষ্ট নেত্রী কি আমরা পাচ্ছি? অথবা নারী নেতৃত্ব এখন কাদের হাতে?
এদেশে নারীদের অধিকারের আদায়ের সংগ্রাম কিন্তু শেষ হয়নি। নারীরা এখন আর অন্তঃপুরবাসিনী নন। কাজেই এখন নারী ঘরে এবং বাইরে নির্যাতিত হচ্ছেন। নারীর নিজস্ব এই আন্দোলনকে পথ দেখাতে একজন সুফিয়া কামাল, একজন জাহানারা ইমাম কি আর আসবেন?
অনেকেই নিজের অবস্থান থেকে পলিসি লেভেলে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে অধিকাংশই চাকরি বা কাজের সুবাদে নারী আন্দোলনের প্রক্রিয়াগুলোর সঙ্গে জড়িত। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানানোর মতো এবং নারী ও মানবাধিকার আন্দোলনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো সেইরকম শক্তিশালী নেতৃত্ব কি নতুন করে তৈরি হচ্ছে? রাজপথে এবং তৃণমূল পর্যায়ে আন্দোলন না থাকলে, শুধু পলিসি লেভেলে কাজ করলে কি ফলাফল পাওয়া সম্ভব হবে?
এমন অনেক নারী নেত্রীকে আমরা পেয়েছি, তারা যখন থেকে কাজ করে আসছেন, তখন সমাজে নারীর অবস্থান ছিল অধস্তন। শিক্ষা-দীক্ষাহীন ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবেশে ছিল নারীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। এই অবস্থার মধ্যেও যারা একটু সুযোগ পেয়েছেন, তারাই সামাজিক প্রতিরোধ ভেঙে বের হয়ে এসেছিলেন। তারা যে শুধু নিজেরাই বেরিয়ে এসেছেন, তা নয়- আলোকবর্তিকা হাতে পথ দেখিয়েছেন আরও অনেক নারীকে।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের নারী আন্দোলন নিয়ে কথা বলতে হলে আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে হবে ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান হয়ে স্বাধীনতার পরের বাংলাদেশকে নিয়ে। সংগ্রাম একটি দীর্ঘ যাত্রা, একদিনে বা কয়েক বছরে তা অর্জন করা যায় না। ব্রিটিশ আমলে আমাদের মুসলিম নারীরা অনেকটাই পেছন থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন নানারকম রক্ষণশীলতার বেড়ি চূর্ণ করে।
এদেশের ভূমিতে নারীর অধিকার খুব সামান্য বা নেই বললেই চলে। অথচ ইলা মিত্র থেকে জায়েদা খাতুন প্রত্যেকেই আন্দোলন করেছেন পুরুষের পাশাপাশি ভূমির ওপর ন্যায্য অধিকারের দাবিতে। ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পরেও পূর্ব পাকিস্তানের নারীদের ভাগ্যে খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি। তখনও নারীর অধিকার, দাবি-দাওয়া প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নারীরা ছিলেন বড় শক্তি। স্বাধীনতার পর শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ প্রায় সবক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ কিছুটা বাড়লেও, মানুষ হিসেবে নারী তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেই থাকলো।
পরবর্তীকালে নারীকেই আন্দোলন করতে হলো তার স্বায়ত্তশাসন ও সমান মজুরির দাবিতে, কথা বলতে হলো মানবাধিকার নিয়ে। নারীরা একত্রিত হয়ে সহিংসতা, যৌতুক, ধর্ষণ ইত্যাদি ইস্যুতে প্রতিবাদী হওয়ার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে অবদান রাখতে শুরু করেন। ৭০ দশক থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে বিভিন্ন দাবিতে অত্যন্ত সক্রিয় ও শক্তিশালী নারী আন্দোলন হয়েছে। দাবিগুলো অর্জিত হয়েছে নারীর দীর্ঘ সংগ্রাম, তাদের আত্মত্যাগ, কাজ, অবদান ও সাহসের ফলে।
নারীর মুক্তি সংগ্রামের ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আমরা পেয়েছি অসংখ্য প্রগতিশীল নারী নেত্রীকে, যারা নিজেরা আলোকিত হয়েছেন এবং অন্যদের পথ দেখিয়েছেন। আমরা যাদের আলোতে আজ আলোকিত হয়েছি, যারা আমাদের চলার পথ গড়ে দিয়েছেন, তাদের অনেকেই আজ পৃথিবীতে নেই। আমাদের পূর্বসূরিরা সংকটময় পরিস্থিতিতে যে পথ তৈরি করে দিয়েছেন, আমরা আজকে সেই সমতল পথেই হাঁটছি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীর দৃপ্ত পদচারণা ছিল। নারী নেতৃত্ব দীর্ঘসময় ধরে ক্ষমতায় থাকার পরেও বাস্তবে এদেশে নারী রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাহীন এবং নানাধরনের বৈষম্যের শিকার। স্বীকার করতে হবে রাজপথের আন্দোলনে বা নারীর অধিকার বিষয়ক দেনদরবারে এবং নীতিনির্ধারণী আলোচনায় নারীর ভূমিকা ও অংশগ্রহণ ক্রমেই কমে আসছে।
অতীতে অধিকার আদায়ে বা মানবাধিকারের দাবিতে, ছাত্র আন্দোলনে, রাজনৈতিক সংগ্রামে নারীকে যতোটা এগিয়ে আসতে দেখেছি, আজ সেই গতিতে কোথায় যেন একটা টান পড়েছে। নারীরা বেরিয়ে আসছেন, পড়াশোনা শিখছেন, উচ্চপদে আসীন হচ্ছেন, দেশ-বিদেশে যাচ্ছেন। কিন্তু, সংগ্রাম পরিচালনার ক্ষেত্রে ইচ্ছাশক্তির ও দায়িত্ববোধের অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
নারী আন্দোলন গতি হারাচ্ছে। এর পেছনে রাজনীতি না থাকা যেমন একটি কারণ, অন্য কারণটি হচ্ছে নারীসহ সবার মধ্যে এক্টিভিজমের অভাব। নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাই সবার মনে একটা আশংকা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে যে, আমাদের নারী আন্দোলন কি পিছিয়ে যাচ্ছে? সামনের দিনগুলোতে কারা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবেন? এবং তারা কতোটা প্রস্তুত?
শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments