ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট থেকে সুরক্ষায় এক ডোজ অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন যথেষ্ট নয়
করোনা মহামারিতে বাংলাদেশের সামনে এখন দুটো বড় সমস্যা। একটি হচ্ছে প্রায় ১৪ লাখ মানুষের জন্য কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা এবং আরেকটি হচ্ছে দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাব।
সেরাম ইনস্টিটিউট যখন থেকে কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে, মূলত তখন থেকেই প্রায় ১৪ লাখ মানুষের সময়মতো দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় প্রথমে ধারণা করা হচ্ছিল যে যারা কোভিশিল্ডের একটি ডোজ পেয়েছেন তারা অন্তত তিন মাস কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষিত থাকবে। অতএব, দ্বিতীয় ডোজ একটু দেরিতে দিলেও বড় কোনো সমস্যা নেই। এসময়ের ভেতরেই হয়তো অন্য কোনো দেশ থেকে ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করে অপেক্ষমানদের দ্বিতীয় ডোজ দিয়ে পূর্ণ সুরক্ষা নিশ্চিত করে যাবে।
সর্বশেষ ফেইজ-৩ ক্লিনিকাল ট্রায়ালে দেখা গেছে যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের একটি ডোজ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ৭৬ শতাংশ কার্যকরী এবং এই কার্যকারিতা অন্তত তিন মাস বজায় থাকে। সাম্প্রতিক পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের চালানো ভ্যাকসিন পরবর্তী কার্যকারিতার সমীক্ষা থেকে দেখা যায় যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা অথবা ফাইজার ভ্যাকসিনের একটি ডোজ ‘ইউকে ভ্যারিয়েন্ট’ (বি.১.১.৭) দিয়ে সংক্রমণ প্রতিরোধে কমপক্ষে ৬০ শতাংশ এবং মারাত্মক কোভিড প্রতিরোধে ৮০ শতাংশের উপরে কার্যকরী। এই গবেষণার ফলাফলটি প্রকাশিত হয়েছে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের ১৩ মে ২০২১ সংখ্যায়।
অতএব ট্রায়াল রিপোর্ট এবং ‘রিয়েল ওয়ার্ড এভিডেন্স’ থেকে এটা নিশ্চিত যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা অথবা ফাইজার ভ্যাকসিনের একটি ডোজ মূল করোনাভাইরাস এবং এর ইউকে ভ্যারিয়্যান্টের সংক্রমণ থেকে ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ সুরক্ষা দেয়।
এসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারণী মহল কোভিশিল্ডের দ্বিতীয় ডোজ প্রথম ডোজের ১২ সপ্তাহের পরে চার থেকে পাঁচ মাসের ভেতরে দেওয়া যাবে বলে মত দেন। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বিতীয় ডোজের জন্য সময় সীমা নির্ধারণ করেছে প্রথম ডোজের ৮ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে। সরকারের পর্যায় থেকে বেশ আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশ থেকে আগামী দুই মাসের ভেতরেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন আনা সম্ভব হবে।
অতি সম্প্রতি পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের আরেকটি স্টাডি বেশ উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। গবেষণাটি এখনও পীয়ার রিভিউ জার্নালে প্রকাশিত হয়নি। এই গবেষণায় দেখা গেছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা অথবা ফাইজার ভ্যাকসিনের একটি ডোজ ‘ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট’ (বি.১.৬১৭.২) দিয়ে সংক্রমণ প্রতিরোধে অক্ষম। তবে ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয় ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ। অর্থাৎ অক্সফোর্ড অথবা ফাইজার ভ্যাকসিনের একটি ডোজ ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের বিপরীতে কার্যকরী নয়। এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষার জন্য অবশ্যই দুটি ডোজ নিতে হবে।
এই ফলাফল এটাই প্রমাণ করে যে দেশব্যাপী ভ্যারিয়েন্ট সার্ভাইল্যান্সের মাধ্যমে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টসহ অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টগুলোর উপস্থিতি এবং এদের বিস্তার মনিটরিং করা কতটা জরুরি। মহামারির গতি প্রকৃতি এবং ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রিত হয় ভাইরাসের মিউটেশন দিয়ে। বাংলাদেশে যদি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়ে থাকে তাহলে যারা কোভিশিল্ডের একটি মাত্র ডোজ পেয়েছেন তারা করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে নিরাপদ নয়। সেক্ষেত্রে তাদের দ্বিতীয় ডোজটি সময়মত কিভাবে দেওয়া যায়, তা আবারও গুরুত্ব সহকারে ভেবে দেখতে হবে। বাংলাদেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
যুক্তরাজ্যে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সংখ্যা দ্রুত হারে বেড়ে যাচ্ছে। দেশটিতে এখন পর্যন্ত তিন হাজার ৪০০ জনের বেশি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে (বি.১.৬১৭.২) আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। এই সংখ্যাটি গত সপ্তাহের চেয়ে এক হাজার বেশি। ইংল্যান্ডের বোল্টন শহরে এখন করোনা আক্রান্তের অর্ধেকই সংক্রমিত হয়েছেন ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে। এই বি.১.৬১৭.২ ভ্যারিয়েন্টটি হচ্ছে ভারতীয় ‘ডাবল মিউট্যান্ট’ খ্যাত বি.১.৬১৭ এর একটি সাব-টাইপ, যা গত ডিসেম্বরে ভারতে শনাক্ত হয়েছে। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের এই বিশেষ ধরনটিই এখন গোটা ভারত জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাজ্যে এখন যতগুলো বিদেশি মিউটেশন রয়েছে তার ভেতরে এই বি.১.৬১৭.২ ভ্যারিয়েন্ট সবচেয়ে বেশি। বিজ্ঞানীদের বদ্ধমূল ধারণা যে আগামী কয়েক মাসের ভেতরেই যুক্তরাজ্যে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট প্রধান ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে আবির্ভূত হবে।
বি.১.৬১৭.২ ভ্যারিয়েন্টটির স্পাইক প্রোটিনে দুটি উল্লেখযোগ্য মিউটেশন ঘটেছে। একটি এর রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইনে (এল৪৫২আর) এবং অন্যটি ফিউরিন ক্লিভেজ সাইটে (পি৬১৮আর)। স্পাইক প্রোটিনের এই দুটো অংশ ভাইরাসের সংক্রমণ এবং বিস্তারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই যুগপৎ দ্বৈত মিউটেশনের কারণেই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ‘ইউকে ভ্যারিয়েন্ট’ (বি.১.১.৭) এর তুলনায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ দ্রুত গতিতে সংক্রমণ বিস্তার করতে পারে। এই বিশেষ মিউটেশনই বি.১.৬১৭.২ ভ্যারিয়েন্টকে মানুষের ভেতরে টিকে থাকার জন্য একটি ‘বেস্ট ফিট’ ভাইরাসে পরিণত করেছে।
ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের ওপরে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং ফাইজারের ভ্যাকসিন কেমন কাজ করে তা দেখার জন্য চলতি বছরের ৫ এপ্রিল থেকে ১৬ মে পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড একটা সমীক্ষা চালায়। এই স্টাডিটা চালানো হয় ১১ হাজার ৬২১ জন ইউকে ভ্যারিয়েন্ট এবং এক হাজার ৫৪ জন ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত মানুষের ওপরে। ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে অক্সফোর্ড বা ফাইজার ভ্যাকসিনের একটি ডোজ ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের বিপরীতে সুরক্ষা দেয় মাত্র ৩৩ শতাংশ এবং ইউকে ভ্যারিয়েন্টের বিপরীতে ৫১ শতাংশ।
অন্যদিকে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার দুই ডোজ টিকা দিলে এর কার্যকারিতা বেড়ে দাঁড়ায় ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের বিপরীতে ৬০ শতাংশ এবং ইউকে ভ্যারিয়েন্টের বিপরীতে ৬৬ শতাংশ। একই ভাবে ফাইজার ভ্যাকসিনের দুই ডোজের কার্যকারিতা ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের বিপরীতে ৮১ শতাংশ এবং ইউকে ভ্যারিয়েন্টের বিপরীতে ৮৭ শতাংশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ভ্যাকসিনকে কার্যকরী হিসেবে গণ্য করতে হলে তার কার্যকারিতার হার হতে হবে কমপক্ষে ৫০ শতাংশের উপরে। এই বিচারে অক্সফোর্ড বা ফাইজার ভ্যাকসিনের ‘এক ডোজ’ ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকরী নয়। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকরী হতে হলে অবশ্যই দুটো ডোজ টিকা ঠিক সময়মতো দিতে হবে।
এ কারণেই যুক্তরাজ্য সরকার এখন তাদের টিকাদান কর্মসূচির গতি দ্বিগুণ করেছে। যাতে করে আগামী জুনের ভেতরেই দেশটির অন্তত ৬০ শতাংশ মানুষকে টিকার দুটি ডোজ দেওয়া যায়। এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশকে দেওয়া হয়েছে ভ্যাকসিনের একটি ডোজ এবং দুটি ডোজ দেওয়া হয়েছে মাত্র ৩৪ শতাংশ মানুষকে।
বাংলাদেশে ভ্যাকসিনের অন্তত একটি ডোজ দেওয়া হয়েছে চার শতাংশেরও কম মানুষকে। এর ভেতরে আবার দেশে গত কয়েক সপ্তাহে বেশ কয়েকটি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে (বি.১.৬১৭.২) আক্রান্ত কোভিড রোগী শনাক্ত হয়েছে। এই রোগীদের পাওয়া গেছে সীমান্ত অঞ্চল এবং রাজধানী ঢাকায়। অন্যদিকে হঠাৎ করে করোনা সংক্রমণের হার আশংকাজনক ভাবে বেড়ে গেছে সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ (৫৫ শতাংশ) এবং সাতক্ষীরায় (৪২ শতাংশ)। সীমান্ত অঞ্চলে সংক্রমণের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পেছনে খুব সম্ভবত ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সংযোগ থাকতে পারে।
লকডাউন থাকার পরও ঈদের আগে এবং পরে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় হাজারো মানুষের চলাচল বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। গত ১০ দিনে গোটা দেশে দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী। বিরামহীনভাবে মানুষের আন্তজেলা চলাচল ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে সহায়তা করতে পারে। অপ্রতুল ভ্যারিয়েন্ট সার্ভাইল্যান্সের কারণে দেশের কোন কোন অঞ্চলে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ছে তাও জানা যাচ্ছে না।
যুক্তরাজ্যের পরিস্থিতি এবং ওখানকার তথ্য উপাত্ত থেকে আমরা জানতে পারি যে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট অন্যান্য ভ্যারিয়েন্ট, যেমন: দক্ষিণ আফ্রিকা, ইউকে এবং ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে অনেকগুণ বেশি সংক্রামক এবং দ্রুত বিস্তারে সক্ষম। খুব সহজেই এই ভ্যারিয়েন্টটি অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টকে ছাড়িয়ে প্রধান ভ্যারিয়েন্টে পরিণত হয়। আর ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বিস্তৃত পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়লে মহামারি যে কী ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে তা আমরা দেখেছি ভারত এবং নেপালে।
সুতরাং বাংলাদেশে এ রকম ভয়াবহ বিপর্যয় এড়াতে জরুরিভিত্তিতে দেশব্যাপী ভ্যারিয়েন্ট সার্ভাইল্যান্স চালাতে হবে। যেসব জেলায় ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হবে সেসব জেলাকে লাল তালিকাভুক্ত করে কন্টেইনমেন্টের মাধ্যমে অন্যান্য জেলাগুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলতে হবে। এতে করে হয়ত ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের দেশব্যাপী বিস্তৃতি অনেক ধীর গতিতে হবে।
ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমণ এবং তা থেকে মৃত্যু ঠেকাতে টিকাদান কর্মসূচি আরও ত্বরান্বিত করতে হবে। এবং ১৪ লাখ মানুষ, যারা কোভিশিল্ডের একটি মাত্র ডোজ পেয়েছেন, তাদের জন্য যে করেই হোক যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দ্বিতীয় ডোজের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ এটা এখন নিশ্চিত যে ভ্যাকসিনের একটি ডোজ ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে না। গাণিতিক মডেলিংয়ের ভবিষ্যৎবাণী হচ্ছে জুলাইয়ের দিকে দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হতে পারে। আর খুব সম্ভবত এই ঢেউটি হতে পারে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে। সুতরাং সমূহ বিপর্যয় এড়াতে আগেভাগেই কার্যকর এবং বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম: এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি, সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments