বুলেট ট্রেন সম্প্রসারণে চীনের অবিশ্বাস্য সাফল্য

চীনের বুলেট ট্রেন। ছবি: সংগৃহীত

বুলেট ট্রেনের জাপানি নাম সিনকানশেন। এই ট্রেন দিয়ে তারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। জাপানে দ্রুত গতির বুলেট ট্রেনের আরও অগ্রগতি হয়েছে। তবে বুলেট ট্রেন সম্প্রসারণে জাপানসহ সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে চীন।

এই শতাব্দীর শুরুতেও চীনে দ্রুত গতির রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটিতে বর্তমানে প্রায় ৩৭ হাজার ৯০০ কিলোমিটার (২৩ হাজার ৫০০ মাইল) এলাকা জুড়ে নির্মিত হয়েছে বৃহত্তম রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে সারা দেশ সংযুক্ত।

এই বিশাল রেল ব্যবস্থার অর্ধেকেরও বেশি অংশ তৈরি হয়েছে গত পাঁচ বছরে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আরও তিন হাজার ৭০০ কিলোমিটার রেললাইন তৈরি হওয়ার কথা। ২০৩৫ সালের মধ্যে এটি দ্বিগুণ হয়ে ৭০ হাজার কিলোমিটারে পৌঁছে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

বুলেট ট্রেনের ভেতরে। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের অনেক দেশ যেখানে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য বিমান ও সড়ক পথের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে, সেখানে চীন আন্তঃনগর যোগাযোগের জন্য দ্রুত গতির রেল ব্যবস্থার দিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

গত বছরের হিসাব অনুযায়ী, চীনের ৭৫ শতাংশ শহর রেললাইন দ্বারা সংযুক্ত। অনেক ক্ষেত্রেই এই ট্রেনগুলোর সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৩৫০ কিলোমিটার (২১৭ মাইল), যা এক শহর থেকে আরেক শহরে যাওয়ার ব্যাপারটিকে সহজ করে দিয়েছে। 

চীনের ৭৫ শতাংশ শহর রেললাইন দ্বারা সংযুক্ত। ছবি: সংগৃহীত

চীন তার উন্নত রেল ব্যবস্থাকে শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ যোগাযোগকে উন্নত করার জন্যই নয়, বরং নিজেদের অর্থনৈতিক শক্তিমত্তার পরিচায়ক হিসেবেও ব্যবহার করতে চায়। বর্তমান ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রেল যোগাযোগের মাধ্যমে তারা চীনের দূরবর্তী ও বিচ্ছিন্ন এলাকাগুলোর নিজস্ব কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে মূলধারার সঙ্গে সংযুক্ত করতে চায়।

চীনের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য সুবিশাল রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল দেশটির বিশাল আয়তন এবং এর ভূবৈচিত্র্য। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত এ প্রকল্পগুলোকে ইউরোপ কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো আইনি সমস্যায় পড়তে হয়নি।

২০২০ সালের শেষের দিকে এসে চীনের জাতীয় রেল ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় নয় হাজার ৬০০ দ্রুতগতির ট্রেন যাতায়াত করছে।

প্রথাগত প্রযুক্তির বদলে চীন তার রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারে অন্য সব দেশ থেকে এগিয়ে আছে।

বেইজিং ও উত্তরের হেবেই প্রদেশের ঝাংজিয়াকোউ এলাকার মাঝে পরিচালিত চালকবিহীন 'বুলেট ট্রেন' সর্বোচ্চ ৩৫০ কিলোমিটার গতিবেগে চলতে পারে, যা এ ধরণের ট্রেনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গতি।

এই রেলপথে ১০টি অত্যাধুনিক স্টেশন রয়েছে। বাদালিং চ্যাংচেং এলাকার আরেকটি রেলপথের মাধ্যমে পর্যটকরা দ্রুত চীনের প্রাচীরে পৌঁছাতে পারেন। এটি বিশ্বের গভীরতম দ্রুতগতির রেলপথ, যা ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০২ মিটার গভীরে (৩৩৫ ফুট) নির্মিত হয়েছে।

বুলেট ট্রেনের ভেতরে। ছবি: সংগৃহীত

নতুন প্রযুক্তির স্বয়ংক্রিয় ট্রেনগুলোতে সিটের সঙ্গে রয়েছে ফাইভ জি প্রযুক্তির টাচস্ক্রিণ কন্ট্রোল প্যানেল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন আলোর ব্যবস্থা, হাজারো নিরাপত্তা নিশ্চায়ক সেন্সর এবং হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী যাত্রীদের জন্য বিশেষ আসনের ব্যবস্থা। যাত্রীদের রেল স্টেশনে সহায়তা দেওয়ার জন্য রয়েছে ফেশিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তি এবং বিভিন্ন ধরনের রোবট।

বিশাল আকারের রেল স্টেশনগুলোও দেখার মতো চমকপ্রদ! হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে যেন বিমানবন্দরের টার্মিনাল।

বুলেট ট্রেন সম্প্রসারণে জাপানসহ সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে চীন। ছবি: সংগৃহীত

ট্রেনের ভাড়াও হাতের নাগালের মধ্যেই। ভাড়া শুরু হয়েছে ১৩ মার্কিন ডলার থেকে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় এক হাজার ১০০ টাকা।

২০২০ সালে চীনের জাতীয় রেল প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান সিআরআরসি একটি দ্রুত গতির বৈদ্যুতিক ট্রেনের প্রস্তাবনা দিয়েছে, যা বিভিন্ন দেশের মধ্যে যাতায়াতে সুবিধা এনে দিতে পারে। এই ট্রেনের চাকাগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী গেজ পরিবর্তন করতে পারে। এতে করে এটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ব্রড ও মিটার গেজ রেললাইন ব্যবহার করে ভারত ও পাকিস্তানে যাতায়াতের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত করা সম্ভব।

প্রস্তাবিত নতুন রেলপথটি হিমালয় পেরিয়ে ভারত ও পাকিস্তান হয়ে রাশিয়া ও সাবেক সোভিয়েত দেশগুলো পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। এর মাধ্যমে চীন তার রপ্তানি পণ্যগুলোর জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করতে চাইছে। 

বুলেট ট্রেনের ভেতরে। ছবি: সংগৃহীত

'বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ' বা বিআরআই নামে পরিচিত এ উচ্চাভিলাষী প্রকল্পটির মাধ্যমে চীন এশিয়া থেকে শুরু করে ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশে তাদের অর্থনৈতিক প্রভাবকে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে আশাবাদী।

তবে চীনের এই উদ্যোগকে ভালো চোখে দেখছে না তাদের সবচেয়ে বড় আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক প্রতিপক্ষ ভারত। আমেরিকার সমর্থন ভারতের পক্ষে। চীনকে ঠেকানোর বহুবিধ ঘোষিত-অঘোষিত পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে আমেরিকা, জাপান, ভারত। তবে অর্থনৈতিক শক্তি দিয়ে চীন প্রায় অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। অনেকটা দ্রুতগতির ট্রেনের মতোই!

তথ্যসূত্র: সিএনএন ও জাপান টাইমস

Comments

The Daily Star  | English

‘Shockingly insufficient’

"The proposed decision to allocate USD 250 billion per year for all developing countries is shockingly insufficient," said the adviser

3h ago