কোটি টাকার ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোতে আমানত বেড়েছে

কালো টাকা সাদা করার সুযোগ ও মহামারিতে অর্থ পাচার করতে না পারাকে আমানত বৃদ্ধির কারণ মনে করেছেন বিশেষজ্ঞরা

সরকার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পর গত বছর দেশের ব্যাংকগুলোতে নির্দিষ্ট কিছু অ্যাকাউন্টে দ্রুত আমানতের পরিমাণ বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, অন্তত এক কোটি বা তারচেয়ে বেশি অর্থ জমা থাকা অ্যাকাউন্টগুলোতে গত বছর মোট ৩ লাখ ৬৪ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা জমা ছিল, যা আগের বছরের তুলনায় ১৮ শতাংশ বেশি।

২০১৯ সালে এ ধরনের অ্যাকাউন্টগুলোতে আমানত বেড়েছিল ৭ শতাংশ, এবং ২০১৮ সালে ছিল ১৩ শতাংশ।

কোটি বা তার বেশি টাকার অ্যাকাউন্টের সংখ্যাও ২০১৯ সালের ৬২ হাজার ৭১০ থেকে বেড়ে গত বছর ৭১ হাজার ৩৪৬ হয়েছে।

দ্য ডেইলি স্টার বেশ কিছু ব্যাংকার, কর কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলেছে। তারা মনে করছেন, আমানত বৃদ্ধি এবং কালো টাকা সাদা করার সুযোগের মধ্যে একটি শক্তিশালী যোগসূত্র রয়েছে।

তারা কোভিড-১৯ মহামারির মাঝে বিদেশে অর্থ পাচার সীমিত হওয়া এবং জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরোপিত বিধিনিষেধের কথাও উল্লেখ করেন।

চলতি অর্থবছরে সরকার কালো টাকাকে সাদা করার বিশেষ সুযোগ দিয়েছে। অপ্রদর্শিত সম্পদ ও আয়কে ট্যাক্স রিটার্নে দেখিয়ে এবং মাত্র ১০ শতাংশ করের বিনিময়ে এ ধরনের সম্পদের উৎস সম্পর্কে কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই বৈধ করে নেওয়া যাচ্ছে।

সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ কালো টাকা সাদা করার সুযোগের বিরোধিতা করছেন কারণ এটি দুর্নীতি ও আইন অমান্য করার প্রবণতাকে উৎসাহিত করে।

তবে এই বিধানের কারণে বর্তমান অর্থবছরে ১০ হাজার মানুষ তাদের অবৈধ পন্থায় উপার্জিত সম্পদের তথ্য উন্মোচন করেছেন। তারা চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে রেকর্ড পরিমাণ ১৪ হাজার ২৯৫ কোটি টাকার সম্পদকে নগদ টাকা, ফিক্সড ডিপোজিট রিসিট (এফডিআর), সঞ্চয়পত্র এবং শেয়ার হিসেবে দেখিয়ে বৈধ করেছেন। কর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর হিসেবে ১ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা পেয়েছে।

ব্যাংকার ও বিশ্লেষকরা কালো টাকা সাদা হওয়া এবং এক কোটি বা তারচেয়ে বেশি আমানত থাকা অ্যাকাউন্টগুলোতে আমানত বেড়ে যাওয়ার মাঝে একটি সম্পর্ক দেখতে পাচ্ছেন।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, অঘোষিত আয়কে বৈধ করার বিধানটির কারণে এ ধরনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আমানতের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে থাকতে পারে।

জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুস সালাম আজাদ ও ডাচ বাংলা ব্যাংকের (ডিবিবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মোহাম্মদ শিরিন মাহবুবুর এর মতের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন।

গত বছরের দ্বিতীয় অর্ধে এক কোটি বা তার চেয়ে বেশি তহবিলের অ্যাকাউন্টগুলোতে আমানতের পরিমাণ বেশ বড় আকারে বেড়েছে।

গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মাঝে এ ধরনের অ্যাকাউন্টগুলোতে ৪৩ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা জমা পড়ে, যা ২০১৯ সালের একই সময়সীমার মাঝে ১০ হাজার ২৪৮ টাকা আমানতের চেয়ে ৩৩০ শতাংশ বেশি।

গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে সার্বিক আমানতের পরিমাণ ১৩ লাখ ৭৯ হাজার ২৫০ কোটিতে দাঁড়ায়, যা আগের বছরের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি। ২০১৯ সালে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ শতাংশ আর ২০১৮ সালে ১০ শতাংশ।

এখানে থেকে একটি ব্যাপার পরিষ্কার যে এই অ্যাকাউন্টগুলোতে আমানতের প্রবৃদ্ধির হার সার্বিক ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন যে একটি অসাধু চক্র অপ্রদর্শিত সম্পদকে বৈধ করার সুযোগ দেওয়ার জন্য সরকারের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছে।

‘কালো টাকা কখনও অর্থনীতির জন্য ভাল কিছু বয়ে আনে না। তারা (কালো টাকার মালিক) সাধারণত জমি অথবা পূঁজিবাজার থেকে শেয়ার কিনে থাকে।’

অঘোষিত সম্পদকে বৈধ করার প্রতিক্রিয়া হিসেবে শেয়ার ও জমির দাম বেড়ে যায়, এবং এসব খাতে বিনিয়োগকারী সাধারণ মানুষদের জন্য নানা রকম বিপদ তৈরি হয়, বলেন তিনি।

অবৈধ সম্পদের মালিকদের মাঝে অনেকেই সাধারণত তাদের আত্মীয় স্বজনের নামে ব্যাংকে অর্থ জমা রাখে। মজিদ বলেন, এখন তারা তাদের অর্থ নিজেদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করছেন, যার কারণে এক কোটি বা তার চেয়ে বেশি টাকার অ্যাকাউন্টগুলোতে আমানতের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকে অপ্রদর্শিত অর্থ প্রবেশ করার কারণে ব্যাংকিং খাতে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত ১ লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকার বাড়তি তারল্য রয়েছে।

‘একজন ব্যক্তিকে এক বছরে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত আয়কর দিতে হয়, কিন্তু এই অসাধু চক্রটি তাদের অবৈধ অর্থ থেকে মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করে নিতে পারছে’, বলেন মজিদ।

মজিদ উল্লেখ করেন যে সরকারের এই উদ্যোগটি দুর্নীতিকে উৎসাহিত করেছে, যা আর্থিক খাতে সামগ্রিকভাবে অনিয়ম সৃষ্টি করেছে।

এনবিআর এর আরেকজন সাবেক চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে এনবিআর পর্যন্ত সব জায়গায় বড় আকারে অটোমেশনের প্রচলন করতে পারলে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার বিধানটির কোন প্রয়োজন হতো না।

তিনি উল্লেখ করেন, অটোমেশন একই সঙ্গে দুর্নীতি দমন করে এবং কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতাকে কমিয়ে আনতে সহায়তা করে।

তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে থাকা কর্মকর্তা ও এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা তাদের নিজ স্বার্থ হাসিলে সরকারকে এ বিধানটি চালু রাখতে প্রভাবিত করেছেন।

তিনি উল্লেখ করেন, যেহেতু অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ উপায়ে উপার্জন করা হয়নি, কোনো পরিস্থিতিতেই একে সাদা করার জন্য তৈরি সরকারি বিধানকে সমর্থন করা উচিত নয়।

তবে বাংলাদেশ কর আইনজীবীদের সংগঠনের সভাপতি মনিরুল হুদা অর্থকে বৈধ করার এ ধরনের সুযোগকে সমর্থন জানিয়েছেন।

‘এই উদ্যোগটি সরকারকে মূল ধারায় টাকা ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করেছে’, বলেন তিনি।

সাধারণত উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা তাদের টাকা সাদা করে আবাসন খাতে বিনিয়োগ করে, অপরদিকে অতি ধনীরা তা ব্যাংকে রাখে অথবা পূঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে।

অন্যান্য কারণ

পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট অফ বাংলাদেশ এর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, কোভিড-১৯ এর সংক্রমণকে প্রতিরোধ করার জন্য বিভিন্ন দেশের জারি করা লকডাউন ও বিধি-নিষেধ বিদেশে অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে।

তিনি উল্লেখ করেন, এ সব কারণে অবৈধ অর্থের মালিকদের জন্য বিদেশে যাওয়ার সুযোগ কমে গিয়েছে, যা একই সঙ্গে তাদের অর্থ পাচারের প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো ব্যক্তি উন্নত দেশগুলোতে বাড়ি কিনতে চায়, তাহলে তারা সাধারণত সে দেশগুলো ভ্রমণ করতে যায়। কিন্তু মহামারির কারণে তারা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এ কাজটি করতে পারছেন না, এবং তারা বাধ্য হচ্ছেন ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে, বলেন আহসান।

সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান মজিদ বলেন, অবৈধ সম্পদের মালিকেরা সাধারণত নির্দিষ্ট কিছু দেশে দ্বিতীয় নিবাস তৈরির জন্য অর্থ পাচার করেন, যেমন কানাডা ও মালয়েশিয়া। তবে বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বিধি-নিষেধের কারণে তাদের জন্য এ কাজটি অনেক ঝামেলাপ্রদ হয়ে গিয়েছে।

এমটিবিএল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুর বলেন, বিভিন্ন দেশে যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে অতি ধনীদের খরচ করার ক্ষেত্র অনেকটাই সীমিত হয়ে গেছে।

তারা এখন ছুটি কাটাতে কিংবা চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে পারছেন না, বলেন তিনি।

ডিবিবিএল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাশেম উল্লেখ করেন যে সরকার বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয় পত্র কেনার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করার পর এক শ্রেণির মানুষ ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে উদ্যোগী হয়েছেন। 

পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, পরিবার সঞ্চয়পত্র ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র—এ তিন ধরনের সঞ্চয়পত্র মিলিয়ে একজন মানুষ সর্বমোট ৫০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করতে পারেন না। যুগ্ম নামে সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করা যায় এ তিন ধরনের সঞ্চয়পত্রে।

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

3,930 candidates for 44th BCS to face fresh viva: PSC

The oral interviews of these candidates were conducted up until July 18 after a total of 11,732 examinees passed the 44th BCS written tests

1h ago