মুক্তিযুদ্ধ

১২ মে ১৯৭১: সাতবাড়িয়া গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক তৎপরতাময় দিন

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১২ মে ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এদিন মার্কিন সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটি পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানে সামরিক ও আর্থিক সাহায্য বন্ধ রাখার আহ্বান জানায়। মার্কিন কংগ্রেসের সিনেটর কর্নেলিয়াস গ্যালাঘর জাতিসংঘের প্রতিনিধি সভায় বাংলাদেশের সমস্যাকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনার জন্য সকল রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান।

জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন সব রাষ্ট্রের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের সাহায্যের আহ্বান জানান। অ্যাসোসিয়েট প্রেস এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, মার্চ থেকে গত দুই মাসে প্রায় ৫ লাখ বাঙালি গণহত্যায় নিহত হয়েছে। তবে দায়িত্বশীল মহলের মতে সংখ্যা ১০ লাখের ‌ওপরে। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এদিন বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও জীবন রক্ষার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব ও বিশ্বনেতাদের প্রতি আবেদন জানায়। এদিন দেশের বহু জায়গায় পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে দোর্দণ্ড প্রতাপে প্রতিরোধযুদ্ধ গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী। এদিন পাবনার সুজানগরের সাতবাড়িয়ায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ব্রাশফায়ার করে প্রায় ৬০০ মানুষকে হত্যা করা করে দুই শতাধিক লাশ পদ্মা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া দেয়।

বিশ্বনেতা ও রাজনৈতিক নেতাদের বিবৃতি

১২ মে মার্কিন সিনেটর বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটি বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানে সামরিক ও আর্থিক সাহায্য বন্ধ রাখার আহ্বান জানায়। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানে মার্কিন বিমান ও ট্যাঙ্ক ব্যবহার সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করে।

১২ মে মার্কিন কংগ্রেসম্যান কর্নেলিয়াস গ্যালাঘর জাতিসংঘের প্রতিনিধি সভায় বলেন, "পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাটিকে সবার মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত। পূর্ব পাকিস্তানে যেভাবে সেনাবাহিনী গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ চালাচ্ছে তা ভয়াবহ। সব দেশকে এখনই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসা উচিত।"

১২ মে জাতিসংঘ সেক্রেটারি জেনারেণ উ থান্ট বিশেষ এজেন্সিসমূহের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের সাহায্য দানের যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তার জবাবে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বলে,’পাকিস্তান অবশ্যই সাহায্য নেবে, তবে এ সাহায্য বিতরণ করবে নিজস্ব সংস্থাসমূহের মাধ্যমে। কোনো আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে সহায়তা করা যাবে না।’

জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন ১২ মে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বলেন ‘বাংলাদেশের শরণার্থীদের জরুরিভিত্তিতে সাহায্যের প্রয়োজন। পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের সংগ্রামকে উপেক্ষা করার কোন অবকাশ থাকতে পারে না।’

১২ মে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার সরকার এক বিজ্ঞপ্তিতে বলে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও জীবন রক্ষার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টসহ বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবদুস সামাদ এই আবেদনটি আজাদে প্রচার করেন। এই বিবৃতিতে আশংকা প্রকাশ করা হয় পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর ওপর অত্যাচার ও নিপীড়ন চালাচ্ছে। এই বিবৃতিতে একই সঙ্গে উল্লেখ করা হয় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যেন সরকারের কোনো প্রতিনিধিকে অনুমতি দিয়ে বাংলাদেশের বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করার সুযোগ দেয়।

পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান নুরুল আমিন এদিন এক বিবৃতিতে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্ন ওঠে না। প্রদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের উপযোগী না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তী শাসন কোনো উপকারে আসবে না। এখন অন্তর্বর্তী শাসন জারি করা হলে পূর্ব পাকিস্তানে কার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে?’

নিখিল ভারত ইত্তেহাদুল মোছলেমানের প্রেসিডেন্ট আবদুল ওয়াহিদ বলেন, বাংলাদেশের স্বীকৃতির ব্যাপারে কেউ অংশগ্রহন করলে তার পরিণতি হবে অত্যন্ত মারাত্মক।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ

অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব আমেরিকার বিশেষ প্রতিবেদক ঢাকা সফর শেষে ১২ মে এক প্রতিবেদনে জানান, পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে শকুনের দল এতো খেয়েছে যে, তাদের আর ওড়ার শক্তি নেই। মার্চ থেকে প্রায় ৫ লাখ বাঙালির মৃতদেহ তারা খাদ্য হিসেবে পেয়েছে। তবে দায়িত্বশীল মহলের হিসেবে মৃতের সংখ্যা ১০ লাখের ওপর।

ভারতে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বৈঠক ১২ মে ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী  ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ভারতে নিযুক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পেগভ। এসময় তারা বাংলাদেশের অবস্থা, শরণার্থী সমস্যাসহ নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। অন্যদিকে কূটনৈতিক মহল ধারণা করে মূলত পূর্ব পাকিস্তানে চলমান যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা ও কূটনীতি কেমন চলবে তা নিয়ে বিস্তারিত জানতে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

একই দিন সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত ফিজ রিলসও পরিস্থিতি, শরণার্থীদের মানবিক বিপর্যয় নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক করেন।

১২ মে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, ‘সীমান্ত রাজ্যগুলোতে শরণার্থী পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে ইন্দিরা গান্ধী ১৬ মে পশ্চিমবঙ্গে আসছেন।’

১২ মে বাংলাদেশ সাহায্য সমিতির পক্ষে একটি প্রতিনিধিদল কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হোসেন আলীর হাতে সাহায্যের অর্থ তুলে দেন। এসময় বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। তার আগে তারা সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সরাসরি প্রয়োজনীয় অর্থ পৌঁছে দিয়েছিলেন।

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ ও গণহত্যা

সাতবাড়িয়া গণহত্যা

১২ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পাবনার সুজানগরের সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের কুড়িপাড়া,শ্যা মনগর, নিশ্চিন্তপুর, কাচুরী, তারাবাড়ীয়া, ফকিৎপুর, সাতবাড়ীয়া, নারুহাটি, সিন্দুরপুর, হরিরামপুর, ভাটপাড়া, কন্দর্পপুর এবং গুপিনপুরসহ প্রায় ১৫-২০টি গ্রামে নিষ্ঠুর গণহত্যা চালায়। ওই দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রামে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে প্রায় ৬০০ নারী পুরুষ শিশুকে লাইন দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে গণহত্যা চালায়। এরপর দুই শতাধিক লাশ পার্শ্ববর্তী পদ্মা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। হানাদার বাহিনী এদিন গণহত্যা করার পাশাপাশি গোটা ইউনিয়নে ব্যাপক লুটপাট, ধর্ষণ ও গান পাউডার ছিটিয়ে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়।

১২ মে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের শুভপুর সেতু এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ট্যাঙ্ক ও কামান নিয়ে আক্রমণ চালায়। সারাদিন যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা সেতু ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে অবস্থান নেন।

১২ মে কুমিল্লার চৌমুহনীর দেড় মাইল উত্তরে মান্দারহাটে অ্যামবুশরত মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য ঘেরাও করার চেষ্টা চালায়। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে হানাদার বাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ বাধে। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা কোনো ক্ষতির শিকার না হয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যায়। পরে পাকিস্তানি হানাদারেরা মান্দারহাট বাজার সম্পূর্ণভাবে পুড়িয়ে দেয়।

১২ মে ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে, সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর কাছ থেকে সুনামগঞ্জ দখল করে নিয়েছে।

নারায়ণগঞ্জে আজিজ সরদারকে আহবায়ক করে ১২৪ সদস্যবিশিষ্ট নারায়ণগঞ্জ শান্তি কমিটি গঠন করে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কাজ শুরু করে স্বাধীনতা-বিরোধীরা।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্র ষষ্ঠ, অষ্টম, নবম খণ্ড।

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা ১৩ মে ১৯৭১

দৈনিক পাকিস্তান, ১৩ মে ১৯৭১

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস; সেক্টর ১, ২

আহমাদ ইশতিয়াক ahmadistiak1952@gmail.com

আরও পড়ুন-

৩ মে ১৯৭১: টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন- ঢাকা এখন মৃত্যুপুরী

১ মে ১৯৭১: ‘বাংলাদেশ এখন একটি চিরন্তন সত্য ও বাস্তবতা’ ভারতীয় শিল্পমন্ত্রী

২৭ এপ্রিল ১৯৭১: কালীগঞ্জে গণহত্যা, ইপিআরের নাম পাল্টে ইপিসিএফ

সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে যিনি উৎসর্গ করেছিলেন নিজের প্রাণ

১৯ এপ্রিল ১৯৭১: প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ১৮ নির্দেশনা

১৮ এপ্রিল ১৯৭১: বিদেশের মাটিতে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন

Comments

The Daily Star  | English

People didn’t sacrifice lives just for election: Asif Mahmud

The adviser stresses the need for reforms for which people came out and ousted 'fascist' Awami League government

50m ago