মানুষের গ্রামে যাওয়া ও হাসি-রসিকতার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
সরকারি নিষেধাজ্ঞা ও শত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে মানুষ গ্রামে ফিরছে। করোনা মহামারি তাদের ঠাসাঠাসি করে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারছে না। কেন মানুষ এভাবে গ্রামে ফিরছে? এর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা কী? আরেক দল মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদেরকে নিয়ে হাস্য-রসিকতা করছে। কেন করছে? তারই বা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা কী?
বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকারের সঙ্গে।
করোনা মহামারিকালেও এত কষ্ট করে এভাবে গ্রামে ফেরার কোনো মনস্তাত্ত্বিক কারণ বা ব্যাখ্যা আছে? শিশু ও পারিবারিক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের এই উপমহাদেশের মানুষ পারিবারিক বন্ধনে বিশ্বাসী। এটা ইউরোপিয়ান বা পাশ্চাত্যের চেয়ে একটু আলাদা। ফলে, আমরা উৎসব কেবল নিজেরা পালন করি না, প্রতিটি উৎসবে পরিবারকে কাছে চাই।’
জীবিকার তাগিদে একটি বড় অংশের মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘উৎসবে তারা তাদের পরিবারের কাছে যেতে চাইবেনই। সারা বছর তারা পরিবারের কাছে যেতে পারেন না অর্থনৈতিক কারণে। ফলে বিশেষ সময়ে পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার একটি তাড়না থাকে।’
দ্বিতীয় কারণ হিসেবে পরিবারের মানুষের চাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে ডা. হেলাল বলেন, ‘লকডাউনের মধ্যে এত কষ্ট করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি যাব? ব্যক্তিগতভাবে অনেকে এমন ভাবেন। কিন্তু, গ্রামে অপেক্ষা করে থাকা মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী, সন্তানের কথায় ঝুঁকি নিয়ে হলেও তিনি বাড়ি যেতে বাধ্য হন।’
তৃতীয় কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমে মানুষের বাড়ি যাওয়ার চিত্র দেখানো হচ্ছে। যার বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না, তিনিও এই ধরনের প্রচারণা দেখে এক ধরনের উৎসাহ পান। এটাকে আমরা বলে থাকি “অবজারভেশনাল লার্নিং”। অনেকে যেহেতু যাচ্ছেন, সেই “ঝাঁকের কই” হয়ে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। নিষেধাজ্ঞার মধ্যে দু-একজন গেলে তখন মনে হয় আমি অপরাধী। কিন্তু, লাখো মানুষের ভিড়ে যখন যাচ্ছি, তখন আমার ভয় নেই।’
অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চলছে এবং ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে। গণপরিবহন না থাকলেও সামর্থ্যবানরা বিকল্প পরিবহনে বাড়ি ফিরছেন উল্লেখ করে এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘মহাসড়ক বন্ধ নেই, অনেক বেশি টাকা খরচ করে প্রাইভেট কার ভাড়া করেও মানুষ বাড়ি যাচ্ছে। উড়োজাহাজের টিকিট বিক্রি হচ্ছে। একটা শ্রেণির মানুষ যখন দেখছে প্রাইভেট কার বা উড়োজাহাজে মানুষ যেতে পারছে, কিন্তু তিনি যেতে পারছেন না, তখন তার ভেতরে এক ধরণের শ্রেণি-চেতনা জাগে। তখন তিনি নিজেকে সামাজিকভাবে বঞ্চিত বলে মনে করে। এই চিন্তা কখনো কখনো তাকে সিস্টেমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বাধ্য করে।’
আইন সবার জন্য সমানভাবে কার্যকর দেখলে মানুষ এই ধরনের ‘বিদ্রোহ’ করতো না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘উড়োজাহাজ, প্রাইভেট কারে তারা বাড়ি যাচ্ছে, আমি বাড়ি যেতে পারছি না— এই চিন্তা থেকে সিস্টেমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে এভাবে বাড়ি যাওয়া।’
ঝুঁকি নিয়ে বাড়িমুখী মানুষদের নিয়ে ট্রলের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যারা নিজেদের অবস্থানটা নিরাপদ করতে পেরেছেন, তারাই ট্রলগুলো করছেন। তাদের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত হয়েছে, পরিবারের সঙ্গে থাকা নিশ্চিত হয়েছে, উৎসব উদযাপনের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। এরপর তারা ট্রল করছেন। যারা সবকিছু নিশ্চিত করতে পারেননি, তারা ট্রল করছেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার তো সমস্যা নেই বা আমার তো বাড়ি যেতে হবে না বা আমি পরিবারের সঙ্গে আছি বা আমি গাড়ি ভাড়া করে বাড়ি যাব বা আমার ফ্লাইটের টিকিট কাটা আছে, সুতরাং আমি ট্রল করতে পারি। এটা হচ্ছে তাদের চিন্তা। করোনা মহামারিতে সামাজিক দূরত্ব বাড়াতে গিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের আত্মকেন্দ্রিকতা তৈরি হচ্ছে।’
পরিপূর্ণ লকডাউন করোনা মহামারি মোকাবিলায় খুব কার্যকরী ব্যবস্থা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটা বাস্তবায়ন করতে হবে সবার জন্যে। একজন দরিদ্র মানুষের করোনা বিস্তারের যে ঝুঁকি, একজন ধনী মানুষেরও একই ঝুঁকি। আমাদের ক্রিকেট টিমের সদস্যরা দেশে ফিরলে যে কোয়ারেন্টিন পদ্ধতি মানা হবে, সেই একই পদ্ধতি বেনাপোল দিয়ে হেঁটে দেশে ফেরা মানুষের জন্যেও মানতে হবে। দুই ধরনের আইন করলেই মানুষ প্রতিবাদ করবে।’
করোনা বিষয়ে মানুষকে যথাযথ বার্তা দিতে সংশ্লিষ্টরা ব্যর্থ হয়েছেন বলে মনে করেন ডা. হেলাল। উপকূলীয় অঞ্চলে মানুষ বিপদ সংকেতগুলো কতটা মেনে চলে, সে উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘যারা বাড়ি যাচ্ছে তাদের দোষারোপ করতে চাই না। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা সাধারণ মানুষকে তাদের ভাষায় করোনার ঝুঁকি বোঝাতে পারেননি বলে মনে করি।’
ঝুঁকি নিয়েও বাড়ি যাওয়ার প্রবণতার বিষয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার বলেন, ‘আমাদের কাছে আত্মীয় ও কাছের মানুষের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েই আমরা নিজেদের অস্তিত্ব টের পাই। পাশ্চাত্যের মতো আমাদের ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবন নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা অনেক বেশি আবেগপ্রবণ। কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আমার মন কী চায়, সেটাই বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ, যুক্তিগতভাবে কোনটা ঠিক তারচেয়ে বেশি কাজ করে আমার আবেগ কী চাচ্ছে, সেটা। বাড়ি যাওয়ার মাধ্যমে আমরা যে আমাদের পরিবারের মানুষের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছি, সেটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে না। অবচেতন মনেই এই ঝুঁকিটা আমরা অস্বীকার করছি। কারণ, আমরা আবেগের জায়গাটা প্রশমিত করতে চাইছি।’
‘ঈদ আমাদের একটি বড় উৎসব। ছোটবেলা থেকেই আমরা জেনে আসছি এর সঙ্গে পরিবারের মানুষের পাশে থাকা, নতুন পোশাক কেনা, সেমাই খাওয়া, এক সঙ্গে ঈদের জামাতে যাওয়া, সবার সঙ্গে কোলাকুলি করা, এক সঙ্গে খাওয়া সম্পর্কিত। ঈদের আনন্দ বলেতে আমরা এগুলোই বুঝি। সারা বছর অপেক্ষায় থেকে এই আনন্দটা আমরা কোনোভাবেই মিস করতে চাই না’, যোগ করেন তিনি।
মানুষ যুক্তির চেয়ে আবেগকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তাই সরকারের কঠোর ভূমিকা নেওয়ার বিকল্প নেই বলে মনে করেন ডা. মেখলা। তিনি বলেন, ‘এতে সরকারের হয়তো জনপ্রিয়তা কমবে, কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থে এটা প্রয়োজন।’
মূলত তরুণ বয়সীরাই বেশি ট্রল করছে বলে মনে করেন ডা. মেখলা। তিনি বলেন, ‘ট্রলের মাধ্যমে তারা নিজেকে উপস্থাপন করতে চাইছে, সবার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে। তার ইউটিউব চ্যানেল বা অন্য কোনো কিছু বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাইছে। অপরকে হেয় করার চেয়ে অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করাটা এখানে মুখ্য।’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মনোযোগ আকর্ষণের একটি সহজ মাধ্যম ট্রল করা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘যে ট্রল করছে তার একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয় আছে, আবার আমরা যারা দেখছি আমাদেরও একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয় আছে। মানুষ ট্রল করছে কেন? কারণ, সেগুলো অন্যরা দেখছে। সহজে মানুষের কাছে পৌঁছানোর সস্তা প্রচেষ্টা থেকে মানুষ ট্রল করছে। আমরা যারা দেখছি তারাও এগুলো নিয়ে মজা করছি। অপরকে হেয় করতে মজা পাচ্ছি, আবার অপরকে হেয় দেখতেও মজা পাচ্ছি। অপরকে হেয় করে বা অন্য কেউ বিব্রতকর কোনো পরিস্থিতিতে আছে এমন কন্টেন্টের ভিউ দেখবেন অনেক বেশি। কারণ, এসব দেখার সময় নিজের ভেতরের অপ্রাপ্তি বোধগুলো কাজ করে। এজন্য আমরা অপরের সমস্যা দেখে মজা পাই।’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রল বন্ধে নীতিমালার প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি এর থেকে উত্তরণে সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে বলে মনে করেন ডা. মেখলা। ছোটবেলা থেকেই শিশুদের সঙ্গে অভিভাবকদের আচরণও এর জন্য দায়ী বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘এখানে প্যারেন্টিংয়ের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।’
Comments