চলুন অক্সিজেনের বদলে বার্গার আর মুরগি ভাজা খাই
ঢাকা শহরে আমাদের মতো গুটিকতক মানুষের অবস্থা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ”বলাই” এর মতো। কেউ গাছকে আঘাত দিলে বা অকারণে গাছের ফুল ছিঁড়লে আমাদের মন খারাপ হয়। কেউ যদি হাঁটতে হাঁটতে ছড়ি দিয়ে দু’পাশের গাছগুলোকে মারতে মারতে চলে, হঠাৎ করে গাছের একটা ডাল ভেঙে নেয়, তখন আমাদের অনেক কষ্ট হয়। সেই সাথে বলাইয়ের মতো আমরাও বুঝতে পারি, অন্য কারো কাছে আমাদের এই মনখারাপের কোনো মানে নেই।
তবে ব্যথাটা আরো অনেক বেশি বাজে যখন দেখি হোটেল, রেস্তোরাঁ, গাড়ি পার্কিং আর রাস্তা করার নামে নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে। আমরা কেউ কেউ অল্পবিস্তর প্রতিবাদ করার চেষ্টা করি। আর না পেরে আমরাও বলাইয়ের মতো মুখ ফিরিয়ে চলে যাই। চুপ করে থাকি, ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাই।
করোনা মহামারি এসে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে “অক্সিজেন” কী এবং কতটা প্রয়োজনীয়। এরপরেও আমরা ভুলে গিয়েছি আম্পানে সুন্দরবন ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে দেশকে বাঁচালো। সিডর-আইলার ধ্বংসযজ্ঞ দেখেও আমাদের কোনো পরিবর্তন হয়নি। গাছ যে আমাদের প্রাণ বাঁচায় এই কথাটি আমরা কি জানি না, নাকি জেনেও পাত্তা দিই না?
ঢাকা শহরে বসবাসকারি এবং নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কর্মরত অধিকাংশ মানুষ গ্রাম থেকে এসেছেন। গ্রামীণ জীবন সবুজে লালিত পালিত হওয়া জীবন। তারা জানেন ঘাসের ভেতরেও প্রাণ থাকে, থাকে ফুল। পাখিরা এক গাছ থেকে অন্য গাছে মুখে করে ফল নিয়ে যায় বলেই অঙ্কুরোদগম হয়। গাছে গাছে অসংখ্য পাখির বাসা থাকে, সেখানে তাদের ডিম থাকে, ছানারা থাকে। গাছের চারপাশ ঘিরে বেড়ে ওঠে লতাপাতা, নামহারা ফুল, পাখিতে-খাওয়া ফলের বিচি পড়ে ছোটো ছোটো চারা বের হয়, অথচ এই লোকগুলোই কেন শহরে এসে নির্বিচারে গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নেন, আমি বুঝি না। আপনার যারা পাখির বাচ্চাকে বাস্তুচ্যুত করছেন, মনে রাখবেন আপনাদের শিশুরাও একদিন অক্সিজেনের অভাব আরো প্রকটভাবে অনুভব করবেন। যেমন এখনটা করছেন আপনারা।
অনেকে বলেন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন চাইলে তো গাছগাছালি কাটা পড়বে, খাল-নদী মাঠ ভরে যাবেই, তাতে আপত্তি করলে কি চলে? আপত্তি তো করছিনা। কিন্তু অবকাঠামোগত উন্নতি করতে গিয়ে যদি কাঠামোটাই নাই হয়ে যায়, তাহলে এই উন্নয়ন করে আর কী হবে? দুঃখের জায়গা হচ্ছে সত্যিকারের উন্নয়নের জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটলেও কথা ছিল, গাছগুলো কাটছে রেস্তোরাঁ, গাড়ি পার্কিং বানানোর মতো ফালতু কাজে।
উন্নয়নের নামে যদি নির্বিচারে গাছ কাটা, পাহাড় কাটা, পাহাড় দখল করে রিসোর্ট বানানো, জঙ্গল উজাড়, নদী-খাল ভরাট করা যদি বন্ধ না হয়, তাহলে আমাদের মাথার উপর খাড়ার ঘা পড়বেই, বাড়বে দুর্যোগ-দুর্বিপাক। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বনভূমি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে পরিবেশের কথা একদম চিন্তা না করে। সুন্দরবন, ভাওয়াল বন, শাল-গজারির বন, টেকনাফের বনভূমি, লাউয়াছড়া বনাঞ্চল সব একে একে উধাও হয়ে যাচ্ছে।
যে কোনো উন্নয়নমূলক কাজের জন্য মানুষ পরিবেশ ও প্রকৃতির কতটা ক্ষতি করতে পারে, সে প্রসঙ্গে একটা সীমার কথা বলেছেন লেনিন এবং তারও আগে মার্কস এবং এঙ্গেলস। ‘প্রকৃতির দ্বন্দ্ববাদ ’ নামের বইতে ফ্রেডরিক অ্যাঙ্গেলস বলছেন, ‘প্রকৃতির ওপর আমাদের বিজয় নিয়ে নিজেদের গর্বিত ভাবার দরকার নেই। কারণ, প্রতিটি বিজয়ের পর প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয়। প্রথম দফায় আশানুরূপ ফল পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় ফলাফলটা হয় অন্য রকম, যা প্রায়ই প্রথম ফলকে বাতিল করতে পারে।’ (সূত্র: প্রথম আলো মতামত) আমাদের অবশ্য কে কী বলছেন, তাতে কিছু যায় আসে না। আমরা নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল।
আমাদের এই অপরিণামদর্শীতার জন্য পরিবেশরক্ষা সূচকে বাংলাদেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে নিচের দিক থেকে এখন দ্বিতীয়। ঢাকা শহরের কত পার্ক উধাও হয়ে গেছে। বাকি পাঁচটি পার্ককেও আমরা যদি এখন “ন্যাড়া” করার কাজে নামি, তাহলে তো প্রকৃতি-মানুষের জন্য আর কোনো জায়গাই থাকলো না। তাছাড়া মেট্রোরেল করতে গিয়ে কত গাছগাছালি যে কাটা পড়লো আমাদের চোখের সামনে, তাতো দেখছিই।
যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স (ইপিআই) ২০১৮’ শীর্ষক যৌথ গবেষণায় ১০টি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে- বায়ুর মান, পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন, ক্ষতিকর ভারী ধাতু, জীববৈচিত্র্য ও বাসস্থান, বনায়ন, মৎস্য সম্পদ, জলবায়ু ও জ্বালানি, বায়ুদূষণ, পানিসম্পদ এবং কৃষি। এর কিছুই আমরা মানি না বলে পরিবেশ রক্ষার বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের গড় স্কোর ক্রমশ নিচের দিকেই নামছে।
যারা গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নেন, যারা পার্ক উচ্ছেদের পক্ষে তারাতো প্রায় সবাই বিদেশে গিয়েছেন এবং দেখেছেন সেখানে তারা কীভাবে পার্ক রক্ষা করে, কীভাবে শিশুদের জন্য খেলার মাঠ রাখা হয়, কীভাবে স্কুলগুলোতে খেলার জন্য উন্মুক্ত জায়গা রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়। অথচ তারাই দেশে ফিরে এসে বনভূমি উজাড় করার নথিপত্রে সই করেন। আমি যখন ১৯৯৪ সালে প্রথম একটি ইউরোপীয় দেশে গিয়ে দেখেছি, সেখানে প্রতি পাড়াতে একটা পার্ক আর একটা করে লাইব্রেরি আছে, তা আমাকে অভিভূত করেছিল। কারণ তারা জানে যে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনায় মানুষ আর প্রকৃতি রাখতে হয় সবচেয়ে আগে।
ছোটবেলায় পড়েছিলাম আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে বলেছিলেন ‘গাছের প্রাণ আছে’। প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ জানতো, গাছের প্রাণ আছে। বৃক্ষদেবতার কথা আছে অনেক প্রাচীন সাহিত্যে ও আদিবাসী সমাজে। এছাড়া ক্রমবিকাশে, বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের উদ্ভবের যে ধারণা আমরা পাই, তাতেও স্পষ্ট দেখানো আছে ক্রমবিকাশের এক পর্যায়ে একটি শাখা উদ্ভিদ ও অন্য শাখা প্রাণীদের দিকে বিস্তৃত।
জগদীশ বসু দেখিয়েছিলেন, উদ্ভিদেরও প্রাণীদের মতো সুখ-দুঃখের অনুভূতি আছে, তারাও গরম, ঠান্ডা, শব্দ প্রভৃতিতে উদ্দীপিত হয়। অথচ সেই সময় বিলেতের এক পত্রিকায় তার এই গবেষণার খবর প্রকাশ পাওয়ার পর, তারা কার্টুন করেছিল “মুলা খেতে মালি প্রবেশ করা মাত্র সব মুলা ভয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।” (সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা) গাছের যে প্রাণ আছে, সে বিষয়ে ব্রিটেন এখন তাদের চিন্তা ভাবনা সম্পূর্ণ পাল্টে ফেললেও, আমরা কি বিশ্বাস করি যে গাছেরও প্রাণ আছে? যদি করতাম, তাহলে কি নির্বিচারে গাছ কোপাতে পারতাম?
বলাই অনেকদিন থেকে বুঝতে পেরেছিল, কতগুলো ব্যথা আছে যা সম্পূর্ণ ওর একলারই, ওর চার দিকের লোকের মধ্যে তার কোনো সাড়া নেই। আমরাও এখন তাই-ই বুঝি বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে। বলাইকে ওর কাকি বলেছিল, কী যে পাগলের মতো বকিস। ও যে জঙ্গল, সাফ না করলে চলবে কেন। এখন আমাদেরও তাই বলা হচ্ছে --- এগুলো সব জঙ্গল, কেটে ফেলে সেই জায়গায় রেস্টুরেন্ট বানানো হবে। সেখানে আমরা আমাদের সন্তানদের বিশুদ্ধ অক্সিজেনের বদলে মুরগি ভাজা আর বার্গার-স্যান্ডউইচ খাওয়াবো।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, বলাই বুঝেছিল কিন্তু আমরা এখনো বুঝি না যে পৃথিবীর পথ পরিক্রমায় জীবজগতের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল গাছ। সে সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলেছে, আমি থাকবো, আমি বাঁচবো। আমি চিরপথিক, মৃত্যুর পর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যাত্রা করব রৌদ্র-বাদলে, দিনে-রাত্রে। আর তাই বাংলাদেশে নির্বিচারে গাছ কেটে সাবাড় করলেও গাছ থেকে যাবে এই পৃথিবীতে। কিন্তু আমরা, এই বাংলাদেশের মানুষ হারিয়ে যাবো। কারণ আমাদের নালিশ শোনার কেউ নেই।
শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments