ন্যাশনাল ব্যাংকের ক্ষমতা খর্ব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক
গুরুতর অনিয়মের অভিযোগের মুখে ন্যাশনাল ব্যাংকের (এনবিএল) আর্থিক অবস্থা উন্নয়নে নজিরবিহীন বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, অ্যাডভান্স ডিপোজিট রেশিও (এডিআর) ৮৭ শতাংশে নামিয়ে আনার আগে প্রথম প্রজন্মের এই ব্যাংকটি আর কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে পারবে না।
ব্যাংকগুলোকে সব সময় ৮৭ শতাংশ এডিআর বজায় রাখতে হয়, যার অর্থ হলো তারা প্রতি ১০০ টাকার বিপরীতে ৮৭ টাকা করে ঋণ দিতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে ন্যাশনাল ব্যাংক ৯০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি এডিআর বজায় রেখেছে, যা নিয়ম পরিপন্থী। এ কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাধ্য হয়েছে এরকম সিদ্ধান্ত নিতে।
উচ্চ এডিআর এটাই নির্দেশ করে যে ব্যাংকটি তার আমানতকারীদের স্বার্থ মাথায় না রেখে বাড়তি ঝুঁকি নিয়ে ঋণ দিয়ে যাচ্ছে।
গত ৩ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চিঠি দিয়ে কিছু নির্দেশনা খুব কড়াভাবে মেনে চলতে বলেছে ন্যাশনাল ব্যাংককে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘ব্যাংকের অর্থায়ন পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় এই নির্দেশাবলী দেওয়া হলো’।
ঋণ অনুমোদন এবং ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নিয়োগ সংক্রান্ত অনিয়ম ও সার্বিকভাবে দুর্বল হতে থাকা ব্যবস্থাপনার অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংক এই পদক্ষেপ নিয়েছে।
২০০৯ সালে সিকদার গ্রুপ ব্যাংকটির বোর্ডের দায়িত্ব হাতে নেওয়ার পর থেকেই ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে।
চেয়ারম্যান জয়নুল হক শিকদার ১০ ফেব্রুয়ারি মারা যাওয়ার পর বোর্ডকে পুনঃবিন্যস্ত করা হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি তার স্ত্রী মনোয়ারা শিকদারকে বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।
ন্যাশনাল ব্যাংক গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর থেকে এ বছরের ১১ এপ্রিল পর্যন্ত কোনো বোর্ড মিটিং করেনি। অভিযোগ আছে যে বোর্ডের অনুমোদন না ব্যাংকটি নিয়েই বিপুল পরিমাণ ঋণ দিয়েছে।
এ ধরণের ঝুঁকিপূর্ণ ঋণদান নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংকের জন্য বছরে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ক্রেডিট প্রবৃদ্ধির সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে।
ন্যাশনাল ব্যাংককে বলা হয়েছে নতুন কোন উপদেষ্টা, পরামর্শক অথবা অতিরিক্ত ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি নিতে হবে।
ব্যাংক কোম্পানি আইন- ১৯৯১ অনুযায়ী সব ব্যাংককে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়।
এর আগে, ন্যাশনাল ব্যাংক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এইচ এম বুলবুলকে অস্থায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল।
তার নিয়োগের মেয়াদ ৩১ মার্চ শেষ হয়ে গেলেও কিছু পরিচালকের পৃষ্ঠপোষকতায় বুলবুল পদ ধরে রাখার চেষ্টা করেন, যা নীতিমালার পরিপন্থী।
বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৬ এপ্রিল ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কাছে বুলবুলকে পদ থেকে প্রত্যাহার করার নির্দেশ পাঠায়।
১৯৮৩ সালে কার্যক্রম শুরু করা এ ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে শাহ সৈয়দ আবদুল বারীকে তিন মাসের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর ন্যাশনাল ব্যাংকের বোর্ডের ওপর ভরসা রাখতে পারছে না। তাই তারা জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নিয়োগদানের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংককে অন্য ব্যাংক অথবা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ অধিগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে।
এডিআরকে নির্ধারিত সীমায় নামিয়ে আনার পর ন্যাশনাল ব্যাংককে ঋণ দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে তাদেরকে বিভিন্ন নিয়ম মেনে চলতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংকটি তার মূলধন তিন হাজার ৬৬ কোটি টাকার বিপরীতে সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত বড় ঋণ দিতে পারবে।
এছাড়াও, ব্যাংকটি কোন একক ঋণগ্রহীতাকে তার মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি টাকা ঋণ দিতে পারবে না। অন্য ব্যাংকের জন্য প্রযোজ্য সীমাটি ৩৫ শতাংশ।
এ সীমাবদ্ধতায় ন্যাশনাল ব্যাংক একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ ৩০৭ কোটি টাকা ঋণ দিতে পারবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংকের কিছু পরিচালকের অনিয়মের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে পেরেছে।
তিনি বলেন, ‘সর্বশেষ নির্দেশগুলো ব্যাংকটিকে কর্পোরেট সুশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করবে।’
ন্যাশনাল ব্যাংককে তার ২০ জন শীর্ষ ঋণ খেলাপির কাছ থেকে টাকা আদায়ের পরিস্থিতি নিয়ে মাসিক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গত মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংককে চারটি প্রতিষ্ঠানের কাছে দেওয়া ঋণের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- রংধনু বিল্ডার্স, দেশ টিভি, রূপায়ন ও শান্তা এন্টারপ্রাইজ।
ব্যাংকটি অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের মাঝে বড় আকারের ঋণ বিতরণ করেছে।
বেশ কিছু ব্যাংক পারষ্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে তাদের নিজ নিজ পরিচালকদের মাঝে এ ধরনের ঋণের আদান প্রদান করে। এই ঘটনাগুলো ব্যাংক খাতে কর্পোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দুঃচিন্তার উদ্রেক করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ন্যাশনাল ব্যাংক অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের মাঝে সাত হাজার ২১৬ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে, যা ব্যাংকটির সর্বমোট প্রদত্ত ঋণের ১৮ শতাংশ।
ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৮৫ কোটি টাকা, যা ২০০৯ সালে ছিল মাত্র ৩৮৮ কোটি। গত বছর ব্যাংকটি দুই হাজার ১৫৪ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন না করলে খেলাপি ঋণের আকার আরও বড় হতো।
দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারনে গত বছর ব্যাংকটি নিয়মিত ও খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে ৪৩৫ কোটি টাকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যাংকটির ২১৪টি শাখার মাঝে ৪০টি শাখা লোকসানের মধ্যে রয়েছে।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ সৈয়দ আবদুল বারী’র কাছে মন্তব্য চাওয়া হলেও তিনি তাতে সাড়া দেননি।
Comments