ভারতে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট এবং বাংলাদেশের করণীয়

ছবি: সংগৃহীত

ভারতে করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। হাসপাতালগুলোতে তিল পরিমাণ জায়গা নেই। অসহায় মুমূর্ষু কোভিড রোগীরা হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে হয় খোলা বারান্দায়, নয়তো অ্যাম্বুলেন্সে। আবার কেউ কেউ চিকিৎসা না পেয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। আর কারো গন্তব্য হচ্ছে সরাসরি শ্মশান কিংবা গোরস্থানে। একদিকে হাসপাতাল ও আইসিইউতে শয্যার অভাব, অন্যদিকে দেশব্যাপী দেখা দিয়েছে মারাত্মক অক্সিজেন সংকট। অক্সিজেনের অভাবে দম আটকে মারা যাচ্ছে রোগীরা।

১৩৯ কোটির বেশি জনসংখ্যার দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে সম্পূর্ণভাবে। দ্বিতীয় ঢেউ চূড়ায় পৌঁছাতে এখনো কয়েক সপ্তাহ বাকি। আর এর ভেতরই সংক্রমণ ও মৃত্যুর দিক দিয়ে দ্বিতীয় ঢেউ ছাপিয়ে গেছে প্রথম ঢেউয়ের ভয়াবহতাকে। স্বাস্থ্য ও পরিসংখ্যানবিদদের ধারণা, দ্বিতীয় ঢেউয়ের চূড়ান্ত পরিণতি দেখতে আরও কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে।

প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কা কাটিয়ে ভারতে গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। এরপর চলতি বছরে ফেব্রুয়ারির শেষভাগ থেকে দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা আবার বাড়তে শুরু করে। মার্চে হঠাৎই দৈনিক সংক্রমণের হার বাড়তে থাকে আকস্মিকভাবে এবং এপ্রিলে তা বেড়ে পূর্বের সব রেকর্ড ভাঙতে থাকে একের পর এক।

সর্বশেষ গতকাল বৃধবার ভারতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত আরও তিন লাখ ৬০ হাজার ৯৬০ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এটিই এখন পর্যন্ত দেশটিতে ও বিশ্বে একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত। একই সময়ে মারা গেছেন আরও তিন হাজার ২৯৩ জন। এটিই এখন পর্যন্ত দেশটিতে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু।

এখন প্রশ্ন হলো— হঠাৎ করে করোনা সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বমুখী হারের পেছনে কারণ কী? ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চালানো নির্বাচনী প্রচারণা, ভোট গ্রহণ ও বৃহৎ সমাবেশই কি এর জন্যে দায়ী? নাকি কুম্ভ মেলায় হাজারো মানুষের অংশগ্রহণ ছড়িয়ে দিয়েছে ভাইরাসকে বিস্তৃতভাবে? নাকি এটা হয়েছে করোনাভাইরাসের অতি-সংক্রমণশীল নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলোর উত্থানের কারণে?

‘ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট’ই কি দ্বিতীয় ঢেউয়ের মূল কারণ?

ভাইরাসে প্রতিনিয়ত মিউটেশন বা রূপান্তর ঘটে এবং এর ফলে নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট বা স্ট্রেইন তৈরি হয়। ভাইরাসের জন্যে এটা একটা অতি স্বাভাবিক ঘটনা। মিউটেশনের মাধ্যমে তৈরি হওয়া নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলো বেশিরভাগই হয় নিরীহ। তবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে নতুন রূপান্তরিত স্ট্রেইনগুলো হয়ে উঠতে পারে অতি-সংক্রামক ও মারাত্মক রোগ সৃষ্টিকারী। কখনো এরা ফাঁকি দিতে পারে আমাদের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে, আবার কখনো এরা হয়ে উঠতে পারে ভ্যাকসিন প্রতিরোধী। এ ধরনের সমস্যাজনক ভাইরাস স্ট্রেইনকে বলা হয়ে থাকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’। ভারতে এই ধরনের একটি অতি-সংক্রামক নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে গত বছরের অক্টোবরে। এই নতুন ভ্যারিয়েন্টটি হচ্ছে বি.১.৬১৭। ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিনে দুটি উল্লেখযোগ্য মিউটেশনের কারণে এই ভ্যারিয়েন্টটি ‘ডাবল মিউট্যান্ট’ হিসেবেও পরিচিত।

মহারাষ্ট্রে জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে সংগৃহীত ৩৬১টি নমুনার মধ্যে ২২০টি, অর্থাৎ ৬০ শতাংশ বি.১.৬১৭ ‘ডাবল মিউট্যান্ট’ ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়। গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটার (জিআইএসএআইডি) তথ্য অনুযায়ী, এই ভ্যারিয়েন্টটি ইতোমধ্যে অন্তত ২১টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাজ্যেও পাওয়া গেছে ১০৩টি বি.১.৬১৭ ‘ডাবল মিউট্যান্ট’ ভ্যারিয়েন্ট। এই ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্টগুলো ফেব্রুয়ারি থেকেই যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করতে শুরু করে ভারত থেকে আসা ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে। পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড এই ‘ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট’কে তালিকাভুক্ত করেছে ‘ভ্যারিয়েন্ট আন্ডার ইনভেস্টিগেশন’ হিসেবে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে ভাইরাসটি কতটা বিপজ্জনক। অনেক ভারতীয় বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই বি.১.৬১৭ ভ্যারিয়েন্টটি অতি-সংক্রামক ও ভয়াবহ, যা ছড়িয়ে পড়েছে দেশব্যাপী। তাদের ধারণা, দ্বিতীয় ঢেউয়ের ঊর্ধ্বগতির পেছনে এই ভ্যারিয়েন্টেই প্রধানত দায়ী।

বি.১.৬১৭ ভ্যারিয়েন্টের স্পাইক প্রোটিনে দুটি প্রধান মিউটেশন ঘটেছে: একটি হলো এল৪৫২আর এবং অন্যটি ই৪৮৪কিউ। এল৪৫২আর মিউটেশনটি এর আগে দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ক্যালিফোর্নিয়া ভ্যারিয়েন্টে’। গত ২০ এপ্রিল প্রকাশিত ‘সেল’ জার্নালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এল৪৫২আর মিউটেশনের উপস্থিতি রূপান্তরিত ভাইরাসটির কোষ সংক্রমণের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় এবং এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে জীবাণু ছড়ানোর প্রবণতাও মূল ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চেয়ে অনেক বেশি। অর্থাৎ এই মিউটেশন নতুন ভ্যারিয়েন্টকে অতি-সংক্রামক ভাইরাসে পরিণত করেছে। এ ছাড়াও, ওই গবেষণায় আরও দেখানো হয় যে, অ্যান্টিবডি এই ভ্যারিয়েন্ট ভাইরাসকে তেমন দক্ষতার সঙ্গে নিষ্ক্রিয় করতে পারে না। অর্থাৎ এই রূপান্তরিত ভাইরাসটির ভ্যাকসিন-বিরোধী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও এখনো তা প্রমাণিত নয়।

বি.১.৬১৭’র দ্বিতীয় প্রধান মিউটেশনটি হচ্ছে ই৪৮৪কিউ। এই একই ধরনের মিউটেশন রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের ভ্যারিয়েন্টগুলোর ভেতরেও (ই৪৮৪কে)। দুই ক্ষেত্রেই মিউটেশন ঘটেছে স্পাইক প্রোটিনের একই অবস্থানে, অর্থাৎ ৪৮৪তম স্থানে। তবে, মিউটেশনের অবস্থানগত মিল থাকলেও এদের ভেতর পার্থক্য রয়েছে অ্যামিনো অ্যাসিড পরিবর্তনে। দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্টে গ্লুটামিক অ্যাসিড প্রতিস্থাপিত হয়েছে লাইসিন দিয়ে; অন্যদিকে ইন্ডিয়া ভ্যারিয়েন্টে (বি.১.৬১৭) এই গ্লুটামিক অ্যাসিডটি প্রতিস্থাপিত হয়েছে গ্লুটামিন দিয়ে। এই কারণেই এই দুটি ভ্যারিয়েন্ট অনেকটা একই রকম হলেও সম্পূর্ণ এক নয়। ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্টে উপরোল্লিখিত দুটো মিউটেশন ছাড়াও আরও ১১টি বিভিন্ন ধরনের মিউটেশন রয়েছে।

ভারতের প্রাথমিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বি.১.৬১৭ ভ্যারিয়েন্টটি মূল করোনাভাইরাসের চেয়ে বেশি সংক্রমণশীল, যা যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবরেটরি পরীক্ষাতেও পূর্বে প্রমাণিত হয়েছে। তবে, একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে ভারতে কিন্তু বি.১.৬১৭ ভ্যারিয়েন্ট ছাড়াও অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টও শনাক্ত হয়েছে। এর ভেতরে উল্লেখযোগ্য ভ্যারিয়েন্টগুলো হচ্ছে ইউকে (বি.১.১.৭), দক্ষিণ আফ্রিকা (বি.১.৩৫১) ও ব্রাজিল (পি.১) ভ্যারিয়েন্ট। আর অতিসম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে শনাক্ত হয়েছে বি.১.৬১৮ নামের আরেকটি ভ্যারিয়েন্ট। এই ভ্যারিয়েন্টটি ‘ট্রিপল মিউট্যান্ট’ নামেও পরিচিত। দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্টের মতো এই ভ্যারিয়েন্টেও ই৪৮৪কে মিউটেশনটি রয়েছে।

২১ এপ্রিল নেচার জার্নালে প্রকাশিত একটা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, পাঞ্জাব রাজ্যে বিস্তৃত সংক্রমণের প্রধান ভ্যারিয়েন্টটি হচ্ছে ‘ইউকে ভ্যারিয়েন্ট’ (বি.১.১.৭)। অন্যদিকে, মহারাষ্ট্রের প্রধান ভ্যারিয়েন্ট ইন্ডিয়ান ‘ডাবল মিউট্যান্ট’ ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.৬১৭)। এই দুটো ভ্যারিয়েন্টই অতি-সংক্রমণশীল এবং এরা উভয়ই ইমিউন সিস্টেম বা রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে পারে। সুতরাং এ থেকে এটা অনুমান করা যায় যে ভারতে চলমান বিধ্বংসী দ্বিতীয় ঢেউয়ের পেছনে এই নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলো বেশ বড় ভূমিকা পালন করছে।

ভারতে বর্তমানে আমরা মহামারির যে তাণ্ডব দেখছি, সেরকমটি আমরা পূর্বে দেখেছি ব্রাজিলের ম্যানাউস শহরে, যেখানে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির প্রধান কারণই ছিল অতি-সংক্রমণশীল ও ইমিউন সিস্টেম ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্ট পি-১।

করোনা মহামারির প্রথম ঢেউয়ে ভারতে প্রতি পাঁচ জনে একজন মূল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল। এ ছাড়াও, সেরোসার্ভেইল্যান্স স্টাডিতে দেখা গেছে, ভারতের শহরাঞ্চলগুলোতে শতকরা ৫০ ভাগ মানুষের রক্তেই করোনাভাইরাসের বিপরীতে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। এ থেকে ধারণা করা হচ্ছিল, অন্তত শহরাঞ্চলের বেশ বড় একটা অংশ কোভিডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে এবং পরবর্তী ঢেউয়ের সময় এরা অন্তত সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে। তবে, চলমান দ্বিতীয় ঢেউয়ের বিস্তার ও ব্যাপ্তি এই ধারণাকে উল্টে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে— ৫০ শতাংশ মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি থাকা সত্ত্বেও তারা কেন করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেল না? কেন প্রতিদিন হাজারো মানুষ মারা যাচ্ছে কোভিডে?

এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা না থাকলেও এটা এভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে, সম্ভবত বর্তমান সময়ের সংক্রমণ হচ্ছে ভাইরাসের নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে, যেটি শরীরে পূর্বে তৈরি হওয়া ইমিউনিটি বা রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে রোগ তৈরি করতে পারে। আর এই তালিকায় প্রথমেই যে ভ্যারিয়েন্টটির নাম চলে আসে, সেটি হলো— বি.১.৬১৭। তবে, এই ভ্যারিয়েন্টই যে দায়ী, তা বিস্তৃত পর্যায়ে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে ভ্যারিয়েন্ট সার্ভেইল্যান্স না করে শতভাগ নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। ইন্ডিয়ান বি.১.৬১৭ ভ্যারিয়েন্টটির সম্ভাব্য বিধ্বংসী চরিত্রের কারণে যুক্তরাজ্য সম্প্রতি ভারতকে লাল তালিকাভুক্ত করেছে এবং ভারত থেকে নিজ দেশে সবার প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে, যাতে করে এই ভ্যারিয়েন্ট তাদের দেশে বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে না পড়ে।

নির্বাচনী প্রচারণার কারণেই কি এই মহামারি বিপর্যয়?

চলতি বছরের মার্চ থেকে যখন ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হল, ঠিক তখন থেকেই পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, কেরালা ও তামিলনাড়ুতে শুরু হলো পুরোদমে নির্বাচনী প্রচারণা ও ভোটগ্রহণ। প্রতিটি নির্বাচনী সমাবেশে হাজারো মানুষ জমায়েত হলো মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত। এসব সমাবেশে স্বাস্থ্যবিধি মানা হলো না একদমই। ফলে যা হওয়ার তাই হলো। এই চারটি রাজ্যেই করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেল আশঙ্কাজনকভাবে। পশ্চিমবঙ্গে দৈনিক করোনা সংক্রমণ সংখ্যা মধ্য মার্চ থেকে মধ্য এপ্রিলের ভেতরে এক হাজার থেকে এক লাফে বেড়ে হলো ১২ হাজার।

আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, এই মার্চ-এপ্রিল সময়টাতে যে শুধু উপরের এই চারটি রাজ্যে করোনা সংক্রমণ বেড়েছে তা নয়। বরং এই সময়টিতে দেশের অন্যান্য রাজ্যেও করোনার বিস্তার ঘটেছে ব্যাপকভাবে। যেমন: মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ, দিল্লি ও কর্ণাটকে করোনার সংক্রমণের ব্যাপক বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়। যদিও এসব রাষ্ট্রে নির্বাচনী সমাবেশ ছিল না। এ থেকে বলা যায় যে, দ্বিতীয় ঢেউয়ে দেশব্যাপী মহামারির যে সুনামি বয়ে যাচ্ছে, তার পেছনের মূল কারণ জনসমাবেশ বা নির্বাচনী প্রচারণা নয়; বরং অতি-সংক্রমণশীল ভ্যারিয়েন্টগুলো দায়ী হতে পারে।

ভারতের মহামারি বিপর্যয় থেকে শিক্ষণীয় কী?

শুধু যে ভারত তা নয়, মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যয় ও উচ্চ সংক্রমণ আমরা দেখেছি ব্রাজিল, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্সেও। এই সবগুলো দেশেই প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে দ্বিতীয় ঢেউ ছিল বহুগুণ মারাত্মক। প্রতিটি দেশেই এই ধ্বংসাত্মক করোনা ঢেউয়ের জন্য দায়ী করা হয়েছে করোনাভাইরাসের নতুন নতুন সব ভ্যারিয়েন্টকে। বাংলাদেশেও শনাক্ত হয়েছে ইউকে ও দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্ট। এর ভেতরে দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি রাজধানীসহ শহরাঞ্চলগুলোতে অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি। মার্চ থেকে মধ্য এপ্রিলে বাংলাদেশেও দেখা গেছে দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়ংকর উত্থান। অনেক বিজ্ঞানীর মতে বাংলাদেশেও দ্বিতীয় ঢেউয়ের পেছনে ইউকে বা দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টের ভূমিকা থাকতে পারে।

৫ এপ্রিল থেকে নেওয়া সরকারি কিছু উদ্যোগ ও ‘লকডাউন’র কারণে এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের গতি এখন নিম্নমুখী। অর্থাৎ দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। তবে, সংক্রমণের এই নিম্নমুখী ধাপ হতে পারে ক্ষণস্থায়ী এবং সংক্রমণের হার হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে যেকোনো সময় যদি কার্যকরী প্রশমন ব্যবস্থা সঠিকভাবে প্রয়োগ না করা হয়। অসতর্ক হলে আমরাও পড়তে পারি মহামারি বিপর্যয়ে, যেমনটি হয়েছে ভারতে। মহামারির বিপর্যয় এড়াতে তাই এখনই বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সেগুলো হলো—

১. বাংলাদেশে ‘ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট’ প্রবেশ বন্ধে ভারতের সঙ্গে আকাশ ও সড়ক পথের সীমান্ত বন্ধ করে দিতে হবে কমপক্ষে ১৪ দিনের জন্য। এ সময়ে কেউ ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারবে না। অতি প্রয়োজনে যাদেরকে দেশে প্রবেশ করতে হবে, তাদেরকে বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন করতে হবে। এরপর কোভিড টেস্টে নেগেটিভ হলেই কেবল তারা দেশে প্রবেশ করতে পারবে। এই পদ্ধতি যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য হবে।

২. বাংলাদেশে বিস্তৃত পর্যায়ে ভ্যারিয়েন্ট সার্ভেইল্যান্স চালাতে হবে। এজন্য জিনোম সিকোয়েন্সিং অথবা মিউটেশন-স্পেসিফিক টার্গেটেড আরটি-পিসিআর করা যেতে পারে। আরটি-পিসিআরের জন্যে থার্মোফিশার কোম্পানির ‘মিউটেশন প্যানেল’ বেশ উপযোগী ও সহজলভ্য পদ্ধতি হতে পারে। মহামারি বিপর্যয় এড়াতে ভ্যারিয়েন্ট মনিটরিং এখন অত্যাবশ্যকীয়।

৩. দেশব্যাপী লকডাউন শিথিল করার পর একটি দীর্ঘমেয়াদি অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন ধাপের লকডাউন ও প্রশমন পদ্ধতি চালু রাখতে হবে অন্তত তিন মাস। জনগণকে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালাতে বাধ্য করতে হবে। এসব উদ্যোগ ছাড়া সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না।

৪. দেশের প্রতিটি জেলায় হাসপাতাল বেড, আইসিইউ ও অক্সিজেন সরবরাহ বাড়াতে হবে। প্রতিটি সরকারি মেডিকেল কলেজে হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা সংযোজন করতে হবে। এগুলোর সুব্যবস্থা ছাড়া মহামারির সংকটকালে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে, যেমনটি হয়েছে ভারতে।

৫. দেশব্যাপী টিকাদান কর্মসূচি আরও জোরদার করতে হবে। যাতে করে চলতি বছরের ভেতরেই দেশের মোট জনসংখ্যার ৬০-৭০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনা যায়। সেরাম ইনস্টিটিউট ছাড়াও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করতে হবে। ভ্যাকসিন ছাড়া করোনা মোকাবিলা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম: এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি, সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

আরও পড়ুন:

Experts Views: Should we be worried about India variant?

দ. আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন কতটা কার্যকর

দেশে করোনার নতুন স্ট্রেইন ছড়িয়ে পড়া রোধে করণীয়

অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের কারণে রক্ত জমাট বাঁধা এবং আমাদের যত ভ্রান্তি!

অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন কতটা সুরক্ষা নিশ্চিত করে?

ভ্যাকসিন নিলেও করোনায় আক্রান্তের সম্ভাবনা থাকে?

ভারতে করোনার নতুন স্ট্রেইন, বাংলাদেশে সতর্কতা জরুরি

৪ সপ্তাহের পার্থক্যে দ্বিতীয় ডোজে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ৫৩ শতাংশ, ১২ সপ্তাহে ৮৩ শতাংশ

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

6h ago