সাইকেলের শহর মন্ট্রিয়েল
এবার একটু আগেভাগেই মন্ট্রিয়েলের শীত চলে গেল। আবহাওয়া এখন উষ্ণ। দিনের বেলা ঝকমকে আকাশ, রৌদ্রজ্বল। তাপমাত্রা প্লাসের ঘরে। সহনীয় শীতল হাওয়ায় সামারের আমেজ। করোনা মহামারিকালে কঠিন লকডাউন চলছে। একই সাথে সান্ধ্যকালীন কারফিউ। তারপরও মানুষ ঘরে বসে নেই। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে রৌদ্রস্নানে বের হচ্ছে। পথঘাট, পার্ক, মেট্রোস্টেশনে মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। আর এই চলাচলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে সাইকেল।
সাইকেলের শহর বলতে আমাদের মানসলোকে ভেসে ওঠে নেদারল্যাণ্ডসের আমাস্টারডামের কথা। সেই শহরের মতোই সাইকেলবান্ধব আরেক শহর কানাডার মন্ট্রিয়েল। সারা শহরজুড়ে মেট্রো, বাসস্টেশনের পাশাপাশি বিভিন্ন পার্ক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে বাইসাইকেল স্ট্যান্ড। যে কেউ এখান হতে সাইকেল নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ বা তার প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করতে পারে। অবশ্যই কিছু নিয়ম আছে, যা ব্যবহারকারীকে মেনে সাইকেল ভাড়া নিতে হয়। প্রধান সড়কে সাইকেল চালানোর জন্য নির্দিষ্ট লেন করা আছে। কোনো কোনো স্থানে ফুটপাতের পাশে সাইকেলের জন্য আলাদা লেন আছে।
মন্ট্রিয়েল সাইকেল-বন্ধুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে পরিচিত। আপনি যদি একটি সাইকেল ভাড়া নেয়ার পরিকল্পনা করেন, তার আগে অনলাইনে নির্দিষ্ট অ্যাপে সাইন আপ করতে হবে। ঘণ্টা বা সারাদিনের জন্য নির্ধারিত ভাড়া অনলাইনে পে করে নিতে পারবেন। মন্ট্রিয়েলে বসবাসকারী ছাড়াও ভ্রমণকারীরা শহর ঘোরার জন্য বাইসাইকেল পছন্দ করেন। এখানে সাইকেল চালানো খুবই নিরাপদ ও সাশ্রয়ী বাহন হিসেবে জনপ্রিয়।
সাইকেলে ঘুরতে ঘুরতে আপনি দেখতে পারবেন, বসন্ত এসেছে। দীর্ঘদিন পর পত্রপল্লব শুন্য বৃক্ষরাজিতে একটু একটু করে সবুজের ছোঁয়ায় চারিদিক যেন নবপ্রানে জেগে উঠেছে। প্রকৃতির এই রূপ দেখে রবি ঠাকুরের গানটি মনে পড়ে যায়। “আহা আজি বসন্তে কত ফুল ফোটে, কত পাখি গায়..”
হ্যাঁ এখানে এখন গ্রীষ্মের ছোঁয়া লেগেছে। বসন্ত আজ জাগ্রত দ্বারে। সাধারণত অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত তীব্র ঠান্ডা ও শীতের সময়। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে আবহাওয়া ধীরে ধীরে উষ্ণতর হতে থাকে। বলা যায় মে মাসের শেষার্ধ থেকে সামারের শুরু।
মন্ট্রিয়েলে সাত থেকে আট মাস প্রচন্ড শীত ও ঠান্ডা পড়ে। তাপমাত্রা মাইনাস চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের ঘরে ওঠানামা করে। দিনরাত অবিরাম তুষারপাতে জনজীবন দূর্বিষহ হয়ে পড়ে। হাড় কাঁপিয়ে দেয়া শীতের তীব্র ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য জোব্বাজুব্বি পরে হাঁটু সমান তুষার ডিঙ্গিয়ে প্রাত্যহিক জীবন যাপন আমার মতো অনভ্যস্তের পক্ষে ভীষণ কঠিনই হতো। তাই এই আট মাস চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় থাকতাম একটু ঝকঝকে আকাশ, এক ফালি কড়া রোদ আর তাপমাত্রা প্লাসের জন্য। এবার সেই অপেক্ষার পালা একটু আগেভাগে শেষ হওয়ায় খুব আনন্দিত। ফলে অনেকেই সাইকেলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ছে।
সাইকেল নিয়ে যারা ভ্রমণে আসবেন কিংবা এখানে নতুন অধিবাসী ও পড়তে আসা শিক্ষার্থী তাদের জেনে নেয়া উচিত কীভাবে বাইসাইকেল ভাড়া নেয়া যায়। সাইকেল ভাড়া দেয়ার জন্য বিকশায়ার নামে প্রোগ্রামটি মূলত সিটি করপোরেশন পরিচালনা করে। যে কেউ অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলের অনলাইন অ্যাপটি নামিয়ে সাইন আপ করতে পরেন। চাইলে সাইকেল স্ট্যান্ডে বিকশায়ারের কিয়স্কেও যেতে পারেন। এজন্য একটি ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড প্রয়োজন হবে। আপনি ২৪ ঘণ্টা, ৩০ দিনের এবং ৩৬৫ দিনের জন্য সাইন আপ করতে পারবেন। খুবই সহজ পদ্ধতি।
যদি কেউ ২৪ ঘণ্টার জন্য ভাড়া নিতে চান, সাইন আপের পর তিনি একটি আনলকিং কোড পাবেন। ৩০ দিনের এবং বছরব্যাপী ভাড়া নেয়ার জন্য গ্রাহকের মেইলে একটি কী (চাবি) পাঠিয়ে দেয়। সাইকেল নেয়ার সময় আনলকিং কোডটি প্রবেশ করান বা আপনার কী-টি ব্যবহার করুন এবং স্ট্যান্ড থেকে একটি সাইকেল টেনে বের করুন। যে কোন ট্রিপ প্রথম ৩০ মিনিট বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায়।
ঘরে বসে সাইন আপের পর আপনি যে কোনো স্থান থেকে যে কোনো সময় সাইকেল সংগ্রহ করতে পারবেন। প্রয়োজনীয় কাজ শেষে যে কোনো নিকটবর্তী সাইকেল স্ট্যান্ডে সাইকেল ফেরত দিতে পারবেন। মনে রাখা প্রয়োজন, যদি দেখেন সাইকেল স্ট্যান্ড বা ডক পূর্ণ হয়ে আছে তখন আশেপাশের ডকে সাইকেল জমা দিতে পারবেন। প্রশ্ন হচ্ছে, অ্যাপটির লিংক কোথায় পাবেন? খুবই সহজ হচ্ছে গুগলে মন্ট্রিয়েল বাইসাইকেল ভাড়া কিংবা অ্যাপ লিখে সার্চ দিলে লিংক পেয়ে যাবেন।
আসলে গরমে বাই সাইকেলে মন্ট্রিয়েল ভ্রমণ খুবই আনন্দময় ও উত্তেজনাকর। সারা শহর ঘুরে দেখা, জানার জন্য অনেকের প্রথম পছন্দ সাইকেল। পথঘাট চেনার জন্য জিপিএস ব্যবহার না করে হারিয়ে যাওয়ার আনন্দটা সাইকেল ছাড়া অন্য কোনো বাহনে পাওয়াই যাবে না। সাইকেলের প্যাডেলে পা দিয়ে গুন গুন করে গেয়ে উঠুন, আজ আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা...
লেখক: কানাডা প্রবাসী
Comments