তুমি দেখতে যা, আসলেও কি তুমি তাই?
হেফাজতকে নিয়ে প্রশাসন যেন হঠাৎ নতুন করে নড়েচড়ে বসেছে। একটার পর একটা চমকপ্রদ তথ্য জানতে পারছে জনগণ হেফাজতের নেতৃত্ব নিয়ে। অথচ এতগুলো বছর ধরে হেফাজতি ভাইরা নানাভাবে বিশৃংখলা চালিয়েছে, জনগণের সম্পত্তি ধ্বংস করেছে, সরকারের বিরুদ্ধে উসকানি দিয়েছে, মানুষ হত্যা করেছে কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলেনি, কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
২০১৩ সালে অর্থাৎ আট বছর আগে করা “সরকার উৎখাতে” উসকানি দেওয়ার মামলায় হঠাৎ করেই গ্রেপ্তার হলেন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামীবাদী। অথচ আট বছর ধরে পুলিশ আজিজুলকে “খুঁজে” পাচ্ছিল না বলে পত্রিকায় খবরে প্রকাশ।
এদিকে হেফাজত নেতা মামুনুলকে নিয়ে প্রতিদিনই নানাদিক থেকে ভেসে আসছে নানা ধরনের খবর। তার কর্মকাহিনীর বিভিন্ন দিক নতুনভাবে উন্মোচিত হচ্ছে বলে তাকে নিয়ে মিডিয়া ও জনগণের মধ্যে উৎসাহ দেখা যাচ্ছে। এমনকি যারা চোখ-কান বন্ধ করে এতদিন মামুনুলকে তাদের নেতা বলে মনে করতো, তারাও এখন তার ব্যক্তিগত জীবনের কাহিনী শুনে খানিকটা নড়েচড়ে বসেছে। যদিও ভক্তির অন্ধত্বে তাদের অধিকাংশই মামুনুলের কৃতকর্মের পক্ষে নানা যুক্তি দিয়েই চলেছে।
এ প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ল, আমরা যখন ছোট তখন বাসায় জোব্বা পরা এক লোক এসে হাজির হলো সুদূর রংপুর থেকে। তার হাতে এক হাজার দানার তসবীহ। সেই প্রথম আমরা এক হাজার দানার তসবীহ দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। প্রথমে জোব্বাধারী ব্যক্তিকে চিনতে না পারলেও, পরে দেখলাম উনি আমাদের দূর সম্পর্কিত নুরা চাচা। নুরা চাচাকে তো সাধারণ প্যান্ট-শার্ট পরাই দেখেছিলাম, হঠাৎ বেশ বদল করায় আমরা চিনতে পারিনি। তার তসবীহটা থেকে রাতের বেলা আলো বের হতো দেখে, আমরা মানে বাসার ছোটরা আরও বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম। তখন রেডিয়াম দেয়া তসবীহর কথা আমরা জানতাম না। আর জানতাম না বলেই চাচাও মোটামুটি একে একটা “ঐশী ঘটনা”বলে আমাদের মধ্যে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
চাচা সেইবার এসে খুব কম বলছিলেন। মাঝেমধ্যে দু’একটা ধর্মের বাণী দিতেন আর নামাজ রোজা কায়েম করার কথা বলতেন। তার এই হঠাৎ পরিবর্তন এবং ধর্মীয় লেবাস নেওয়া দেখে বাসার সবাই খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। বাসার সদস্যদের কেউ কেউ ওনার ভক্তও হয়ে উঠল। ভক্তি থেকে এরা চাচার ফাই-ফরমাশ খাটতেও শুরু করেছিল। শুধুমাত্র ওই জোব্বা ও নূরানি তসবীহ দিয়ে দু’সপ্তাহের মধ্যেই চাচা তাদের বশে আনতে পেরেছিলেন।
চাচা তার এই পরিবর্তন প্রসঙ্গে কারো প্রশ্নের তেমন কোন উত্তর দিতেন না। সে যা হোক, বাসার সবাই ধরে নিলো মানুষটার মধ্যে মহা একটা পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু দু’সপ্তাহ পর বাড়ি থেকে খবর এলো চাচা ব্যবসা করে নিজের ও মানুষের টাকা উড়িয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। পুলিশ এবং ব্যবসায়িক পার্টনাররা তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর পালিয়ে বেড়ানোর মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে এই ধর্মীয় বেশ এবং তসবীহকে ব্যবহার করছে।
মানুষকে ধর্মের কথা বলে বশ করাটা সবচেয়ে সহজ বলেই আদি যুগ থেকে একশ্রেণির ধর্ম ব্যবসায়ী ধর্মকেই দমণ-পীড়ণ ও আয়ের বড় উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছে।
সেদিন একটা লেখায় এমন একটা তথ্য পেলাম, যা আজকের এই ঘটনার সাথে একেবারে মিলে যায়। এক হাজার বছর আগে পারস্যের (ইরান) নিশাপুরে জন্মগ্রহণকারী কবি, গণিতবেত্তা, দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ ওমর খৈয়ামের লেখায় সেই ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যে ঘটনা সত্য থেকে নেওয়া। তিনি বলেছেন, যারা দুরাচার করে অর্থাৎ দৃশ্যমান মন্দ কাজ করে (যেমন মদ খায়, অর্থ বা সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে যৌনকর্ম করে) তাদের চেয়ে যারা গোপনে একই কাজ করে কিন্তু বাইরে নিজেদের পরহেজগার ও মুখে ধর্মের কথা বলে মানুষকে পাপের শাস্তির ভয় দেখায়, তারা অনেক বেশি মন্দ। সেখানে একজন যৌনকর্মী একজন ধর্মগুরুকে বলছে "আমি দেখতে যা, আমি আসলেও তাই, কিন্তু তুমি দেখতে যা, আসলেও কি তুমি তাই?"
সেখানেই লেখক লিখেছেন, ভারতীয় বেদ উপনিষদের শিক্ষায় 'ধর্ম' কথাটির অর্থ বিভিন্ন বিশ্বাসের নাম নয়। এটি হলো তার বা বস্তুর চরিত্র, যাকে ইংরেজিতে আমরা প্রোপার্টি বলি। যেমন লোহার ধর্ম যে তাতে মরিচা পড়ে, লোহা পানিতে ডোবে, পানি নিচের দিকে গড়ায় এইরকম। বেদ উপনিষদের শিক্ষায় মানুষের ধর্মও সেরকমই।
চোর যদি চুরি করে, যৌনকর্মী যদি অর্থের বিনিময়ে দেহদান করে তাহলে সেটা ধর্মহীনতা নয়। ধর্মহীন তারাই যারা বাইরে এক আর ভেতরে অন্যরকম। যারা মানুষকে ধোকা দেয় এবং বহুরূপী। তারা মুখে এক কথা বলে, আর ভিতরে আরেক। ফলে সাধারণ মানুষ তাদের চিনতে ভুল করে, আর তাদের পাতা ফাঁদে পা দেয়।
তারাই ধর্মহীন যারা বাইরে ধর্মের লেবাস পড়ে, আর অন্তরে ভোগের স্বপ্নে দিশেহারা থাকে। তারা কখনো মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করে সওয়াব অর্জন করতে বলে না, তারা ধর্মের মূলনীতি মেনে চলতে বলে না। শুধু পরকালের ভয় দেখিয়ে মানুষকে অস্থির ও দুর্বল করে তোলে, নারীর বিরুদ্ধে অশ্লীল কথা বলে আনন্দ লাভ করে, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে উসকে দেয় আর অসচেতন মানুষকে ধ্বংসযজ্ঞে মাতিয়ে তোলে।
মানুষ যে পৃথিবীতে এসে ধর্মকে অধর্মের কাজে লাগাবে, তা আল্লাহ জানতেন। আর জানতেন বলেই তার বান্দাদের মোনাফেক সম্পর্কে বারবার সচেতন করেছেন। বলেছেন, তোমরা কাফেরদের চাইতেও মোনাফেকদের সম্পর্কে বেশি সচেতন থাকবে। কারণ মুনাফেকরা হলো ভণ্ড। এরা ধর্মের বেশভুষা পরে প্রকৃত ধর্ম ও ধার্মিকদের ক্ষতি করে। অধিকাংশ মানুষ বুঝতেই পারবে না কীভাবে এই ভণ্ডরা মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করছে। গায়ে আতর দিয়ে এমন একটা সুফি চেহারা ধারণ করে, যাতে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেওয়া সহজ হয়।
যারা মুসলিমদের চিহ্নিত শত্রু, তাদের পক্ষে চট করে মুসলমানদের বিপদে ফেলা সম্ভব হয় না, যতোটা সম্ভব হয় মোনাফেকদের দ্বারা। এরা যা যা বলে এবং এরা যা করে, এই দুটোর মধ্যে কোন মিল নেই। মানুষ হিসেবে, নাগরিক, স্বজন বা প্রতিবেশি হিসেবে এরা ইসলামের মূল আদর্শ থেকে অনেক দূরে। কারণ এদের কোন নিয়ত নেই। ইসলামে শান্তির বাণীকে গোপন করে এরা শুধু আগুন জ্বালানোর বা জেহাদের ডাক দেয়।
এ কথাগুলো বলার কারণ একটাই, তাহলো ধর্মের ধ্বজাধারী লোকের উসকানিতে তার অনুসারীরা এবং সাধারণ মানুষ কতবার সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি ধ্বংস করেছে।
এই ধ্বজাধারীরাই মানুষকে ধর্মের নামে উত্তেজিত করে তুলে সেদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ পৌর মিলনায়তনের ভেতরে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। কালো ছাইয়ে ঢাকা মিলনায়তনটি এখন ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী হয়ে আছে। গত ২৮ মার্চ হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতালের দিন সংগঠনের কর্মী-সমর্থকেরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে যে জ্বালাও পোড়াও করেছে, তা শুধু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতাকেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভাতে এমন ভাংচুর করা হয়েছে, ১৫৩ বছরের ইতিহাসে কখনো এমন ঘটনা ঘটেনি। এই সম্পত্তিগুলো জনগণের এবং জনগণ এগুলো ব্যবহার করে। একবারও কি মনে হয়নি মোদিবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে কেন হেফাজত সমর্থকদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হাটহাজারিতে জনগণের সম্পত্তিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করতে হলো?
ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম ধর্মের কোথায় আছে এইভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর কথা? ২৬ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত এই তিন দিনের সহিংসতায় মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল সরকারি স্থাপনা। শহরটিতে অন্তত ৫৮টি প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় হামলা হয়। সরকারি হিসাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এই তিন দিনে সংঘর্ষে ১৩ জন নিহত হয়েছেন। হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুযায়ী এই সংখ্যা ১৫। (সূত্র: প্রথম আলো)
সরকার বিভিন্ন সময়ে এই হেফাজতের বিভিন্ন দাবি-দাওয়াকে আশকারা দিয়ে মাথায় তুলেছে। যদিও এইবার সরকার হেফাজতকে অন্যভাবে ট্যাকেল করার চেষ্টা করছে। এমনকি থানায় থানায় মেশিনগান চৌকি বসিয়েছে। কিন্তু এসব করে জিহাদের নামে ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকাতে সরকার কতটা সফল হবে, তা কেউ জানে না। ভণ্ডদের একবার মাথায় তুললে, তাদের মাথা থেকে নামানো কঠিন হয়। এই দেশের লোকজন কাদেরকে ধর্মীয় নেতা বানিয়ে রাখে, রাষ্ট্র কাদেরকে ধর্মীয় নেতা হিসেবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়, কেন দেয়, সেই উত্তর আমরা না জানলেও, এটা জানি যে এসবই অসুস্থ রাজনীতির অংশ। এদেরকে প্রগতিশীল ও সুস্থ রাজনীতি দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, ব্যক্তির অপকর্ম বা চারিত্রিক ত্রুটি উন্মোচন করে নয়।
শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments