করোনাকালে চিকিৎসকদের রাত-দিন

ঢামেকের করোনা ইউনিটে ডিউটিরত অবস্থায় মাস্ক-পিপিই পরে আছেন ডা. মুক্তাদির ভূইয়া। ছবি: মুক্তাদিরের ফেসবুক থেকে নেওয়া

‘আর কিছুক্ষণ পরেই প্রথম রোজার প্রথম ইফতার হবে। অনেকেই পরিবারের সঙ্গে বসে হয়তো ইফতার করবেন, আবার অনেকেই জরুরি সেবার কাজে নিয়োজিত থাকার কারণে বাইরে ইফতার সেরে নেবেন। কিন্তু আমরা এমন এক দায়িত্বে আছি, যেখানে মাস্ক খুলে মুক্ত বাতাস খাওয়াই মানা, সেখানে পানি তো দূরের কথা। তারপরও আমরা ক্লান্তিহীন ডিউটি করে যাচ্ছি, যেন আপনারা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সুন্দর মুহূর্তগুলো উপভোগ করতে পারেন। আমরা এমনই এক অভাগা পেশায় আছি, করোনাকালে এই পরিস্থিতিতে আমাদের কথা কেউ একবার বলে না আমরা কেমন আছি?’

গতকাল কথাগুলো নিজের ফেসবুকে লিখেছেন ডা. মুক্তাদির ভূইয়া। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার। এখন পর্যন্ত প্রায় শ দেড়েক ডাক্তার করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তারা মূলত সেবা দিতে গিয়ে রোগীদের থেকে আক্রান্ত হয়েছেন। সঠিক ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) না পাওয়াও ডাক্তারদের আক্রান্ত ও মৃত্যুর একটি বড় কারণ। পিপিই কেলেঙ্কারি যেভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, তা শেষ হয়েছে নিশ্চিত করে বলা যাবে না। ফলে ডাক্তার, নার্সসহ চিকিৎসা কর্মীদের ভেতরে হতাশা আছে, আছে অভিমান ও ক্ষুব্ধতা।

ডা. মুক্তাদির ভূইয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলছিলেন, ‘এই করোনাকালে শুধু বাংলাদেশে না, সারাবিশ্বে চিকিৎসক, নার্স, স্টাফরা যে একনিষ্ঠ সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের বর্তমান অবস্থা আসলে কাউকে বোঝানোর মতো নয়। এটা কেবল যারা প্রত্যক্ষ করছেন তারাই বুঝতে পারবেন।’

‘গত বছরের মার্চ-এপ্রিল থেকে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছি। সীমাহীন সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমাদের লড়াই এখনো চলছে। ইতোমধ্যে অনেক চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন, তবে কাজ থামাননি। আমরা চিকিৎসক। আমরা জানি, যেকোনো বিপর্যয়ে মানুষকে সেবা দিয়ে যেতে হবে। সে শপথ নিয়েই আমরা চিকিৎসক হয়েছি’, বলেন তিনি।

ঢামেকের এই চিকিৎসক বলেন, ‘এখন রমজান চলে। এরপরও আমরা তিন শিফটে কখনো আট ঘণ্টা, কখনো ১২ ঘণ্টা ধরে টানা কাজ করছি। গত এক বছর ধরে আমাদের ডিউটি রোস্টার বা ম্যান-পাওয়ারে কোনো পরিবর্তন নেই। তবে আশঙ্কার বিষয় হলো, সম্প্রতি চিকিৎসকদের করোনায় আক্রান্তের হার অনেক বেড়ে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে আমাদের ডিউটি রোস্টারে। এ সপ্তাহে আমার সঙ্গে যার ডিউটি করার কথা ছিল, তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। সারাদেশেই এমন ঘটছে, আগামী এক-দুই সপ্তাহ পর চিকিৎসকরা আর কত ওয়ার্ক লোড নিতে পারবেন তা নিয়ে আমরা নিজেরাই সন্দিহান।’

করোনার নতুন সংক্রমণ তো প্রতিদিন বাড়ছে, মানুষ মারা যাচ্ছে। আপনাদের পর্যবেক্ষণ কী?

ডা. মুক্তাদির ভূইয়া বলেন, ‘করোনা চিকিৎসায় ঢামেক এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বেডের হাসপাতাল। এখানে দুটি ভবন মিলিয়ে প্রায় ৮০০-৯০০ বেড রয়েছে, যেখানে করোনা পজিটিভ ও সন্দেহভাজন রোগীদের আলাদাভাবে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। গত দুই-তিন সপ্তাহ ধরে রোগী আসার পরিমাণ বেড়ে গেছে। বেডের যে ব্যবস্থা ছিল, তার প্রায় দুই-তিন গুণ রোগী আসছেন প্রতিদিন। এতে বেড আর ফাঁকা থাকছে না, সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এখন যারা আসছেন সব গুরুতর রোগী।’

‘গত ছয় মাস ধরে এত গুরুতর রোগী ছিল না। হালকা উপসর্গ বা সামান্য জটিলতা নিয়ে রোগীরা আসতেন। সেসময় দুই-তৃতীয়াংশ বেড খালি ছিল। আর এখন প্রতিনিয়ত অ্যাম্বুলেন্স আসছে আর ফিরে যাচ্ছে। গত পরশু আমার দেখা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির রাত ছিল। আমি যে ওয়ার্ডে আছি, একরাতে সে ওয়ার্ডে এত সংখ্যক গুরুতর রোগী আসতে এবং মারা যেতে আগে কখনো দেখিনি। অনেক রোগী বেড পর্যন্ত আসতে পারেননি। হাসপাতালে ভেতর এসেই মারা গেছেন’, যোগ করেন তিনি।

চিকিৎসকদের নিরাপত্তায় ঢামেকের ব্যবস্থাপনা কেমন? সুরক্ষা সামগ্রী পাচ্ছেন নিয়মিত?

ঢামেকের এই সহকারী রেজিস্ট্রার বলেন, ‘মাস্ক, পিপিই সংক্রান্ত বিষয়টি আমাদের বুঝতে বুঝতেই লেগেছে প্রায় আট মাস। মাস্ক, পিপিইর কোয়ালিটি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, অনেক কেলেঙ্কারি হয়েছে। এখন আমরা যেসব সরঞ্জাম পাচ্ছি সেগুলোর কোয়ালিটি নিয়ে কথা বলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। যা পাচ্ছি তাই ব্যবহার করে কাজ করছি। এতে চিকিৎসকরা অহরহ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। গত দুই-তিন সপ্তাহে ঢামেকে প্রায় শতাধিক চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। করোনায় ঢামেকের কোনো চিকিৎসক এখন পর্যন্ত মারা যাননি। তবে, যারা ডিউটি করছেন তাদের কয়েকজনের পরিবারের সদস্য মারা গেছেন।’

‘গত দুই-তিন সপ্তাহ ধরে যে হারে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে, গত বছরের এই সময়েও সেরকম ফ্লো ছিল। তখন কর্তৃপক্ষের কাছে আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করার জন্য চিকিৎসকরা দাবি জানিয়েছিলেন। গত এক বছর ধরে এর বাস্তবায়নের চিত্রটি গণমাধ্যম সূত্রে অনেকেই জানেন। এ বিষয়ে যদি এক বাক্যে বলি, আমরা হতাশ। আর কিছু বলতে চাই না। ক্লান্ত হয়ে গেছি’, বলেন তিনি।

আপনারা কিসে এত হতাশ?

ডা. মুক্তাদির ভূইয়া বলেন, ‘কারো প্রতি আমাদের রাগ, ক্ষোভ কিংবা ঘৃণা নেই। তবে হতাশা ও অভিমান আছে। পুলিশ মানুষের বন্ধু, চিকিৎসকরা সেবক। সেই পুলিশ লকডাউনে চিকিৎসকদের হাসপাতালে যাওয়া-আসার পথে জরিমানা করছে, অপমান করছে। সরকারের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে যেখানে জরুরি সেবার কারো মুভমেন্ট পাস লাগবে না। সেখানে এই অপমান। কী বিচিত্র এক দেশ!’

‘এই কথাগুলো আমার বলার কথা না। আমাদের চিকিৎসকদের অনেক সংগঠন আছে। এসব সংগঠনে অনেক বড় বড় নেতা, বড় বড় চিকিৎসক দায়িত্বশীল পদে আছেন। এগুলো তাদের বলা দরকার। তারা কেন বলছেন না, তা আমি জানি না। আমি আমার ব্যক্তিগত জায়গা থেকে ফেসবুকে একটি খোলা চিঠি লিখেছি। আসলে আমরা দেশের সরকার থেকে শুরু করে দায়িত্বশীল সবার কাছ থেকে সহমর্মিতা চাই, উৎসাহ চাই’, বলেন তিনি।

ঢামেকের এই চিকিৎসক বলেন, ‘করোনাকালে দেশের অর্থনীতি চাঙা রাখতে সরকার অনেক কিছুই করছে। কৃষি, গার্মেন্টসসহ প্রায় সব খাতে প্রণোদনা সহায়তা দিচ্ছে দিচ্ছে। চিকিৎসকরা গত এক বছর ধরে সম্মুখযুদ্ধ করছেন। সরকারের সহায়তার ছিটেফোঁটাও তারা পায়নি। এখন পর্যন্ত চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে এমন দাবি তোলাও হয়নি। চিকিৎসকরা সেটি আশাও করে না। চিকিৎসকরা চায়, সরকারের পাশাপাশি দেশের জনগণও তাদের উৎসাহ দিক, চাঙা রাখুক।’

এজন্য কী করা উচিত বলে মনে করেন?

ডা. মুক্তাদির ভূইয়া বলেন, ‘পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে সেরকম কোনো সেবাই দেওয়া হচ্ছে না। চিকিৎসকদের থাকা, খাওয়া, বিশ্রামের কোনো কিছুই বিজ্ঞানসম্মত হচ্ছে না। সেসব দেশে চিকিৎসকদের যেভাবে আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন, ওয়ার্মআপ করা হচ্ছে, আমাদের এখানে তা হচ্ছে না। এখানে শুধু টাকার বিষয়টিই মুখ্য নয়। চিকিৎসকদের যেকোনো উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে গিয়ারআপ রাখা উচিত, যা আমরা পারছি না। প্রতিবেশী ভারত যেভাবে মহামারির শুরু থেকেই চিকিৎসকদের সুশৃঙ্খলভাবে কাজের মধ্যে রেখেছে, আমাদের দেশ সেটা এখনো করতে পারেনি।’

‘এই করোনা মহামারি থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। চিকিৎসক হিসেবে আমাদের একটাই চাওয়া বা প্রত্যাশা। তা হলো— করোনা চিকিৎসা দিতে গিয়ে যারা আক্রান্ত হচ্ছেন বা যাদের পরিবারের সদস্যরা আক্রান্ত হচ্ছে, সবার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা। সেই সঙ্গে আমাদেরকে যে ধরনের ঝুঁকিভাতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার বাস্তবায়ন দেখতে চাই। সর্বোপরি দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই এবং আমাদের দায়িত্বশীল পদে যারা আছেন তারা আমাদের পাশে থেকে সবসময়ই উৎসাহ দিয়ে যাবেন, সেই আশাই ব্যক্ত করি।’

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

10h ago