কল্পনা রাণীর জীবন ও সম্পদে হিন্দু নারীর সমানাধিকারের প্রশ্ন

কল্পনা রাণীর সাথে পরিচয় হয়েছিল প্রায় ১০/১২ বছর আগে। তিন সন্তান নিয়ে যশোরে পথের পাশে একটি ভাঙাচোড়া চায়ের দোকান চালাতেন। সেখানে বসে চা-বিস্কুট খেতে খেতে কথা বলে জানলাম, বিয়ের কয়েক বছর পর তার স্বামী উধাও হয়ে যায়। বাবা যতোদিন বেঁচে ছিলেন, তাকে কাজের সন্ধানে পথে নামতে হয়নি। কিন্তু বাবা মারা যাবার পর ভাইয়েরা দায়িত্ব নেয়নি। বাবার অনেক সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও কল্পনা কিছু পায়নি। কারণ হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী তিনি বাবার কোনো সম্পত্তি পাননি। বিয়ের সময় পাওয়া দু’একটা গয়না বিক্রি করে এই দোকান দিয়েছেন।

সেদিনই আমি জানলাম হিন্দু নারী বাবার সম্পত্তির কিছুই পান না। একজন হিন্দু নারীর জন্য কী কষ্টকর একটা অনুভূতি। ছোটবেলা থেকে ভাইবোন একই ঘরে, একই বাবা মায়ের কোলে চড়ে বড় হয়েছে। অথচ বড় হয়ে দেখলো তাদের দুজনের ভেতর ধর্ম প্রভেদ রেখা টেনে দিয়েছে। মেয়েরা বড় হয়ে বুঝলো বাবা মায়ের আদর-ভালবাসা তাদের হলেও সম্পত্তির ছিঁটেফোটাও তাদের নয়। অথচ পরিবারে বাবা-মায়ের আদরের সন্তান ছিল সে বা তারা।

কল্পনা রাণীর মতো দুর্ভাগা অনেকেই আছেন। আমার এই লেখা দেখে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পক্ষ থেকে কেউ কেউ বলতেই পারেন, কেন একজন মুসলিম নারী হিন্দু নারীর সম্পত্তির অধিকার নিয়ে কথা বলছেন? নিজেদেরটা নিয়ে বলছেন না কেন? একজন নারী হিসেবে যখন দেখি হিন্দু নারী তাদের অধিকার থেকে সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত, তখন মুখ বন্ধ করে বসে থাকা যায় না। একজন নারীর বঞ্চনা মানে, অন্য নারীরও অধিকারহীনতা।

এখানে বলে নেয়া ভালো যে মুসলিম নারী যাও বাবা-মায়ের সম্পত্তির আধা ভাগ পান, হিন্দু নারীতো তাও পাচ্ছেন না। এমনকি বাংলাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য তালাক প্রথাও নেই। সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারের ইস্যুটা নিয়ে কাজ করছে একটি বিশেষ ফোরাম, যে ফোরামে আমার সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন জড়িত। আর সেকারণে এমন সব তথ্য আমাদের হাতে এসেছে, যা সত্যিই একজন হিন্দু নারীর জন্য খুবই দুঃখের, কষ্টের।

বর্তমানে প্রচলিত হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী অনেকক্ষেত্রেই হিন্দু নারী ও মেয়েরা পিতা-মাতা ও স্বামীর সম্পত্তির অংশ পায় না। আইনের এই অসম পরিপ্রেক্ষিতকে সামনে রেখে সম্পত্তিতে হিন্দু নারী ও পুরুষের সমান অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ”খসড়া হিন্দু উত্তরাধিকার আইন- ২০২০” প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনটি তৈরির ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নতুন এই খসড়া আইনে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারী-পুরুষ ও হিজরা (তৃতীয় লিঙ্গ) ব্যক্তির সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে গঠিত “হিন্দু আইন প্রণয়নে নাগরিক উদ্যোগ” কোয়ালিশন এই আইনটির খসড়া তৈরি করেছে।

বর্তমানে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী যদি কারো পুত্র সন্তান থাকে, তাহলে কন্যা সন্তানরা তাদের উত্তরাধিকার সম্পত্তি পায় না। যদিও নারীর অর্জিত সম্পত্তির অংশ তার পরিবারের পুরুষ সদস্যরা ঠিকই পেয়ে থাকেন।

অবশ্য হিন্দু নারীর যদি কোনো ভাই না থাকে, তাহলে বাবার সম্পত্তির কিছুটা ভাগ শুধু তারাই পেতে পারেন, যাদের কোন পুত্র সন্তান আছে অথবা পুত্র সন্তান লাভের সম্ভাবনা আছে। এখানেও কিন্তু সেই ছেলে সন্তানের প্রভুত্বের ব্যাপারটিই চলে আসে। ছেলেসন্তান না থাকলে কোন হিন্দু নারী সম্পত্তির কিছুই পাবেন না। এর অন্য মানে হলো সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার জন্য পুরুষ সন্তানের জন্মকে উৎসাহিত করা এবং কন্যা সন্তানকে অপ্রয়োজনীয় মনে করা।

স্ত্রীধন বলে হিন্দু নারীদের প্রাপ্য কিছু সম্পত্তি আছে, যা তারা বিয়ের সময় উপহার হিসেবে বাবা, মা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে পেয়ে থাকেন। অনেকেই কুযুক্তি দিয়ে বলেন যে, এই স্ত্রীধনতো হিন্দু নারীরা পেয়েই থাকেন, তাহলে আর সম্পত্তির ভাগ কেন? কিন্তু প্রশ্ন হলো সেই স্ত্রীধনের পরিমাণ কত? সেক্ষেত্রে যদি বাবা-মা তাদের কন্যাকে কিছু দেন, তবেই কন্যাসন্তান কিছু পাবে, নতুবা এটি পাওয়ার ক্ষেত্রে কোন হিসাব নিকাশ ও আইনি বাধ্যবাধকতা থাকছে না।

আর স্ত্রীধন হিসেবে প্রাপ্ত এই সম্পত্তি হয়ে থাকে অস্থাবর সম্পত্তি। অস্থাবর সম্পত্তি হাতছাড়া হওয়া খুব কঠিন কোনো ব্যাপার নয়। বেনুকা চৌধুরী ও শশীবালা দেবী, এরকম দুই জন। যারা অঢেল পরিমাণে স্ত্রীধন পেলেও হাতে রাখতে পারেননি। বেনুকার টাকাপয়সা, গয়নাগাটি সব স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকেরা জোর করে নিয়ে নিয়েছিল। আর স্বামী মারা যাওয়ার পর শশীবালা দেবী তার টাকা ছেলের পড়াশোনার জন্য খরচ করলেও, ছেলে তাকে আর দেখছে না। বাবার অনেক টাকা থাকলেও ভাইয়েরা দুঃসময়ে তাদের পাশে এসে দাঁড়াননি। সেই দুঃসময়ে তাদের স্ত্রীধনও কোনও কাজে লাগেনি।

আর তাই প্রয়োজন পড়েছে হিন্দু সম্পত্তি আইন পরিবর্তনের। এই খসড়া আইনে নারী-পুরুষ, পুত্র বা কন্যা সন্তান, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন অথবা বাবা-মায়ের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে কোনও অসম বিভাজন করা হয়নি। অবশ্য কোনও ব্যক্তির নিজের অর্জিত সম্পত্তি সম্পূর্ণভাবে তার নিজের সম্পত্তি হবে এবং কোনও ব্যক্তি সম্পত্তির উত্তরাধিকারের যোগ্য হবেন না, সে বিষয়টিও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

বর্তমান আইনে বিধবা নারীরা জীবনস্বত্বে যে সম্পত্তি পান, তা তিনি বিক্রি বা উইল করতে পারেন না। শুধু যতদিন বাঁচবেন, ততদিন ভোগ করবেন। এর মানে হচ্ছে আদতে এই সম্পত্তির পুরো মালিক তারা হতে পারেন না। ভারত ১৯৫৬ সালে ”হিন্দু সাকসেশন অ্যাক্ট” পাশ করেছে এবং এই আইনের মাধ্যমে হিন্দু নারী ও পুরুষের উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে সমান অংশ নিশ্চিত করেছে এবং পরবর্তীতে ২০০৫ ও ২০০৭ সালে তারা আইনটি সংশোধনের মাধ্যমে আরও যুগোপযোগী করেছে।

বাংলাদেশের সংবিধান-১৯৭২ এর  ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান ও রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ-১৯৭৯ এ বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালে সই করেছে। যেখানে নারীর অধিকার ভোগ ও চর্চার  প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার কথা বলা হয়েছে। অথচ সম্পত্তিতে সমান অধিকার না থাকার কারণে হিন্দু নারী ও মেয়েরা বিভিন্নভাবে বঞ্চনা, বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।

এই আইনের খসড়া তৈরি করতে গিয়ে জেলায় জেলায় এরকম অনেক হতভাগ্য নারীর জীবনের কষ্টের কথা জানা গেছে। আর তাই হিন্দু নেতাদের পক্ষ থেকেই দাবি উঠেছে উত্তরাধিকার আইনটি সংশোধন করা হোক। তবে তারা বলেছেন ধর্মান্তরিত হলে হিন্দু নারী-পুরুষ উত্তরাধিকার সম্পত্তির অধিকার হারাবেন, আইনে এই বিধান রাখা হবে।

সেদিন একটি আলোচনায় বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি নিমচন্দ্র ভৌমিক বলেছেন, অনেকে অবশ্য নারীকে সম্পত্তিতে এই অধিকার দেয়ার বিষয়ে চুপ করে থাকেন। এটাকে মানসিকভাবে সমর্থন করতে চান না তারা। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র ভারতে এই অধিকার দেয়া হয়েছে। তাহলে বাংলাদেশে হিন্দু নারীদের এই অধিকার দিতে সমস্যা কোথায়? নেতৃবৃন্দ মনে করেন গণতান্ত্রিক ও প্রতিষ্ঠানিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশে এই আইন সংশোধন জরুরি।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিন্দু নারীদের এই বৈষম্যমূলক অবস্থা বিবেচনা করে ২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল জাতীয় লিগ্যাল এইড দিবস, জন্মাষ্টমিসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হিন্দু নেতাদের আহ্বান জানিয়েছেন হিন্দু উত্তরাধিকার আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য। এরই ধারাবাহিকতায় “হিন্দু আইন প্রণয়নে নাগরিক উদ্যোগ” কোয়ালিশন একটি খসড়া হিন্দু উত্তরাধিকার আইন প্রণয়ন করেছে। এই আইনটি কিন্তু হঠাৎ করে প্রণীত হয়নি। এটি নিয়ে সাতটি বিভাগীয় শহরে হিন্দু আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধি, হিন্দু ধর্মীয় সংগঠনের প্রতিনিধিদের সাথে মতবিনিময় করা হয়েছে এবং তাদের মতামত খসড়া আইনটিতে যুক্ত করা হয়েছে।

কোনও কোনও প্রগতিশীল হিন্দু ব্যক্তিত্ব অবশ্য এখনো মনে করেন যে বাংলাদেশে হিন্দু নারীর ডিভোর্স দেয়ার অধিকার নেই, পুনর্বিবাহের ও সন্তান দত্তক নেয়ার সুযোগ নাই, অথবা অর্পিত সম্পত্তি আইন নিয়েও কিছু বলা হয় না, সেখানে শুধু উত্তরাধিকার আইন নিয়ে টানাটানি কেন। আমরা মনে করি কোন কোন ইস্যু নিয়ে কথা হচ্ছে না, এটা বলার চাইতে যা নিয়ে কথা হচ্ছে, তাকে সমর্থন জানানোটা কি বেশি বাস্তবসম্মত নয়?

আমরাও চাই যে অন্যান্য আধুনিক ও সভ্য রাষ্ট্রের মতো দেশে ধর্মীয় আইনের পাশাপশি ইউনিফর্ম সিভিল ল প্রতিষ্ঠিত হোক, যাতে সব ধর্মের নারীর প্রতি বৈষম্য দূর হয়। আমরা জানি গ্রামে বা শহরে এখনকার বাবা-মা তাদের কন্যা ও পুত্র সন্তানকে আলাদা চোখে দেখেন না। সমান সেবাযত্ন, আদর, সুযোগ ও অধিকার দিয়েই সন্তানকে বড় করে তোলেন। সেখানে সম্পত্তির ভাগ শুধু ছেলে সন্তান পাবে এটাও তারা আর সমর্থন করেন না। কিন্তু ধর্মীয় কারণে বাধ্য হন এই বিভাজন করতে। কাজেই আমরা সেই দিনের দিকে তাকিয়ে আছি, যেদিন রাষ্ট্র এমন ব্যবস্থা করবে, যা দেশের নারী-পুরুষকে সমান অধিকার দেয়ার পথ প্রশস্ত করবে।

শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Anti-Discrimination Students Movement

Students to launch a party by next Feb

Student leaders who spearheaded the July-August mass uprising are planning to launch a political party by early February 2025 and contest the next general election.

8h ago