দুর্নীতির অভিযোগ, মমতা কি পারবেন সুন্দরবন দুর্গ ধরে রাখতে?
গত বছরের মে মাসে করোনা মহামারির মাঝামাঝি সময়ে পশ্চিমবঙ্গে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। ঘূর্ণিঝড়টির আঘাতে রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চল বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে, বিশেষ করে সুন্দরবন এলাকা। এতে প্রায় এক শ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু ও হাজারো কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
আম্পানে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করেছিল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু, সেই ত্রাণ তহবিলে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে। দুই চব্বিশ পরগনায় প্রচারে গিয়ে বিজেপির প্রবীণ নেতারা এই ইস্যুতে বারবার শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসকে আক্রমণ করেছেন। তহবিলের অপব্যবহারের অভিযোগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেকের দিকেও আঙুল তোলা হয়েছে। অভিষেকের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ডায়মন্ড হারবারের লোকসভা কেন্দ্র সুন্দরবন অঞ্চল থেকে খুব দূরে নয়।
সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। যা ৫৪টি জন-অধ্যুষিত ও ৪৪টি জনবসতিহীন বনভূমি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। এটি হলো রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বাসস্থান। উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা-জুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে তিনটি লোকসভা কেন্দ্র (জয়নগর, মথুরাপুর ও বসিরহাট), ১৭টি বিধানসভা কেন্দ্র ও ৪৩ লাখের বেশি ভোটার। সুন্দরবনের অধিকাংশ মানুষ কৃষি ও মৎস্য চাষের সঙ্গে জড়িত। চাকরির সুযোগের অভাব ও মানব-পশুর দ্বন্দ্ব দশকের পর দশক ধরে চলে আসছে।
গত ১ এপ্রিল দ্বিতীয় দফার বিধানসভা নির্বাচনে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার চারটি বিধানসভা কেন্দ্র ভোটগ্রহণ হয়। এগুলো হলো— গোসাবা, পাঠ প্রতিমা, কাকদ্বীপ ও সাগর। এই চারটি আসনই সুন্দরবনের অধীনে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির পুনরুত্থানের সময়েও এই জেলা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দখলে ছিল। সুন্দরবনের অন্তর্গত অন্য আসনগুলোতে পরবর্তী ধাপে ভোটগ্রহণ হবে।
গোসাবা জয়নগর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত হলেও বাকি তিনটি মথুরাপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। ২০১৯ সালে তৃণমূলের প্রতিমা মণ্ডল জয়নগরে ৫৬ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি বিজেপির প্রার্থীকে তিন লাখের বেশি ভোটে পরাজিত করেছিলেন। মথুরাপুরে তৃণমূলের জাটুয়া প্রায় ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে তার নিকটতম বিজেপি প্রতিদ্বন্দ্বীকে দুই লাখের বেশি ভোটে পরাজিত করেন। অভিনেত্রী-রাজনীতিবিদ নুসরাত জাহান বসিরহাটে প্রায় ৫৫ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। যেখানে বিজেপির সায়ন্তন বসু সাড়ে তিন লাখের বেশি ভোটে পিছিয়ে ছিলেন।
সুন্দরবনের আসন নিয়ে এবার বিজেপি বেশ আশাবাদী। তাদের ধারণা আম্পানের ত্রাণ নিয়ে অব্যবস্থাপনার কারণে মানুষ তৃণমূলকে প্রত্যাখ্যান করবে এবং বিজেপিকে ভোটে দেবে। যে চারটি আসনে ইতোমধ্যে ভোটগ্রহণ হয়েছে, সেগুলো নিয়ে ইতোমধ্যে দুই দলই জয়ের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে জানায়, কেন্দ্রীয় দরকার আম্পানে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ছয় হাজার ২৫০ কোটি রুপি ত্রাণ দিয়েছিল। কিন্তু, হাজারো ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছিলেন, তারা কোনো সাহায্য পায়নি। তবে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সুন্দরবন বিষয়ক একটি আলাদা বিভাগ আছে এবং সরকারি কর্মকর্তারা ত্রাণসামগ্রী বিতরণের দায়িত্বে ছিলেন।
ত্রাণ তহবিলের অনিয়ম বা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ শুরু থেকে অস্বীকার করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বরং তিনি বলেছেন, তার সরকার কেন্দ্রের সাহায্য ছাড়াই পাঁচ লাখ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে অনুদান দিয়েছে। তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় এসব অঞ্চলের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের কথাও তুলে ধরেন। অবশ্য জনগণের অভিযোগের পর তিনি বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে বদলি করেছেন। একইসঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে ওই অঞ্চলের জনগণের জন্যে সব ধরনের সাহায্য নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন।
সুন্দরবনের টপোগ্রাফি এখানের ভোট-চর্চাকে অনন্য করে তুলেছে। সব ভোটকেন্দ্র টাইগার জোন থেকে দূরে অবস্থিত। এখানকার ভোটাররা জঙ্গল ও নদী পার হয়ে ভোট দিতে আসেন।
এখন প্রশ্ন হলো— সুন্দরবনের আসনগুলো কি বিজেপির দখলে যাবে নাকি আবারও তারা মমতাতেই আস্থা রাখবেন? নাকি অন্যকিছু ঘটবে? যেমন: আম্পানের অব্যবস্থাপনার ক্ষোভে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নিরাপদ ঘাঁটি’ হাতছাড়া হয়ে যাবে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে আগামী ২ মে।
Comments