পাড়া, স্কুল ও সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পাশে জ্বলছে ইটভাটা
‘আমরা বান্দরবান সদর উপজেলার কুহালং ইউনিয়নের গুংগুরু খেয়াং পাড়ার সংখ্যা ক্ষুদ্র খেয়াং জনগোষ্ঠী কয়েকশ বছর ধরে বসবাস করে আসছি। এখানে প্রায় ২৫০ পরিবার খেয়াং জনগোষ্ঠী ছাড়াও খেয়াং পাড়া সংলগ্ন মারমা, চাকমা ও বাঙ্গালিদের যুগ যুগ ধরে শান্তিপূর্ণ সহবস্থান রয়েছে।
বান্দরবান জেলায় বসবাসরত খেয়াং জনগোষ্ঠীর প্রায় তিন হাজার সদস্যের মধ্যে গুংগুরু খেয়াং পাড়া ছাড়া সবাই দুর্গম পাহাড়ে বসবাস করেন। গুংগুরু খেয়াং পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া জেলার আর কোনো খেয়াং পাড়ায় সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই।
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, গুংগুরু খেয়াং পাড়ার মধ্যখানে গড়ে ওঠা গুংগুরু পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অবৈধভাবে এবিসি নামে একটি ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে।
গত প্রায় ১৭ বছর ধরে ইটভাটাটি বন্ধের জন্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থায় অসংখ্যবার আবেদন, নিবেদন, স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে।
একাধিকবার মানববন্ধন করা হয়েছে, গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট মহল থেকে ইটভাটাটি বন্ধে অথবা স্থানান্তরে কোনো প্রকার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ইটভাটাটির কয়েকশ গজের মধ্যেই বন বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলও রয়েছে।
২০১১ সালের ৬ ডিসেম্বর বন ও পরিবেশ মন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি, ২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন, ২০১৩ সালের ১৪ জানুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বরাবর আবেদন, ২০১৩ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের পরিবেশ অধিদপ্তর পরিচালক বরাবর আবেদন, ২০১৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বরাবর আবেদন ও ২০১৬ সালের ৬ মার্চ বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন জায়গায় আরও অনেক আবেদন দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু এত আবেদনের পরেও ইটভাটা বন্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর বান্দরবান জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো স্মারকলিপিতে গুংগুরু খেয়াং পাড়াবাসী এভাবেই তাদের সমস্যার কথা উল্লেখ করেন।
গুংগুরু পাড়ার প্রবীণ অধিবাসী ক্যসা মং খেয়াং বলেন, ‘আমাদের পাড়ার পাশে দুধপুকুরিয়া ধোপাছড়ি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে প্রায় ২০ বছর আগেও হরিণ, সরীসৃপ, হুলক গিবন, ফিশিং বিড়াল, চিতাবাঘ, ময়ূর, বন মোরগ ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখিসহ বন্য প্রাণী দেখতাম। এখন আর এগুলো দেখা যায় না বললেই চলে।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০০৫ সালে অভয়ারণ্যের কাছে ইটভাটাটি স্থাপনের পর এই সংরক্ষিত বন থেকে প্রচুর পরিমাণে গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এতে এই অভয়ারণ্যের জীব-বৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী বলেন, ইটভাটার ধোঁয়া, সেখানে আসা ভারী ট্রাকের শব্দ ও ধূলিকণার কারণে শ্রেণীকক্ষে পড়াশোনার খুবই অসুবিধা হয়।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মজিদ উদ্দিন বলেন, ‘আমরা শিক্ষক ও স্থানীয়রা বেশ কয়েকবার স্কুল সংলগ্ন ইটভাটাটি বন্ধে স্থানীয় প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। কিন্তু এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ইটভাটাটি অবিলম্বে বন্ধ করার দাবি জানাচ্ছি।’
চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা ইটভাটাটি সম্পর্কে জেলা প্রশাসনকে অবহিত করেছি। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’
ইটভাটাটির জন্য সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা তা অস্বীকার করে বলেন, ‘ইটভাটার জন্য এই অভয়ারণ্য থেকে গাছ কখনো কাটা হয় না।’
বান্দরবানের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. লুৎফুর রহমান বলেন, ‘বিদ্যালয় বা সংরক্ষিত বনের কাছে ইটভাটা স্থাপনের উপায় নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইটভাটাটির বিস্তারিত আমাদের জানতে হবে এবং এটি সত্য হলে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব।’
এবিসি ইটভাটার মালিক মো. ইসলাম ওরফে ইসলাম কোম্পানি দাবি করেন, এই ইটভাটাটি চালানোর জন্য তার কাছে উচ্চ আদালতের উপযুক্ত নথি রয়েছে।
দ্য ডেইলি স্টার সেই নথির অনুলিপি চাইলে মো. ইসলাম তা হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাবেন বললেও আর পাঠাননি।
Comments