যেখানে গাড়ির অন্তিম নিশ্বাস শোনা যায়

শাহ আলী থানার বাইরে পড়ে থাকা জব্দকৃত তিনটি গাড়ি। ছবি: এসকে এনামুল হক/স্টার

অচল চারটি টায়ার, প্রতিটি চাকার প্রায় অর্ধেক অংশ মাটিতে ডুবে গেছে, দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটি একটি টয়োটা করোনা এক্সিভ। গাড়িটির কোনো জানালা নেই, এমনকি সামনের বা পেছনের উইন্ড-স্ক্রিনও উধাও। নেই রিয়ার-ভিউ আয়না, নিখোঁজ একটি টেইল লাইটও। ড্যাশবোর্ডের কিছু অংশ ভেঙে গেছে। পুরো গাড়িটি যেন দুমড়ে আছে। কয়েকটি জায়গায় মরিচার আস্তর, আঁচড় দেখা যাচ্ছে। গাছ থেকে ঝরে পড়া পাতায় ডুবে আছে গাড়িটির ভেতরের অংশ।

ধূসর রঙের এই ধাতব কাঠামো, যেটি এক সময় ঢাকা মেট্রো গ ১১-৯০৪২ লাইসেন্স প্লেট নিয়ে ঢাকার রাস্তায় সগৌরবে বিচরণ করেছিল, সেটি আজ প্রায় ১৩ বছর ধরে শহরের শাহ আলী থানার সামনে জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। ২০০৮ সালের জুলাইয়ে পুলিশ জব্দ করার পর থেকে গাড়িটিতে কোনো যত্নের ছাপ পড়েনি।

নিষিদ্ধ দ্রব্য পরিবহনের সময় প্রমাণ হিসেবে গাড়িটি জব্দ করা হয়েছিল। সে সময় গাড়িতে থাকা তিন আরোহীকে আটক করে পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। সে বছরই মামলাটির চার্জশিট দাখিল করা হয়েছিল।

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই থানার এক উপপরিদর্শক (এসআই) এ তথ্যগুলো দ্য ডেইলি স্টারকে নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেন, ‘গত ১৩ বছরে মামলাটি নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে, এর মালিক এখনো তার গাড়িটি ফিরিয়ে নিতে আসেননি।’

তিনি আরও জানান, গাড়িটি সরিয়ে নিতে কিংবা নিলামে বিক্রি করে দেওয়ার অনুমতি চেয়ে ঢাকার একটি আদালতের কাছে পাঁচ বার অনুরোধ জানানো হলেও আদালত থেকে এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। কাছেই দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া আরেকটি গাড়ি। চাকার ধ্বংসাবশেষ দেখেই কেবল বোঝা যায় যে, একসময় এটি একটি গাড়ি ছিল।

শাহ আলী থানার পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, এই হলুদ ট্যাক্সি ক্যাবটি ২০০৯ সালে মে’তে একটি সড়ক দুর্ঘটনার সময় জব্দ করা হয়। ওই সড়ক দুর্ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয়েছিল। অবহেলার কারণে ওই মৃত্যুর ঘটনায় চালকের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। সে বছরের আগস্টে মামলার চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছিল। আজ পর্যন্ত কেউ গাড়িটি ফিরিয়ে নিতে আসেনি।

সম্প্রতি ওই জায়গাটিতে পরিদর্শন করে ১০টি গাড়ি জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। অধিকাংশ গাড়ির ব্যাপারেই পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে কোনো বিস্তারিত তথ্য দিতে পারেনি।

এক কনস্টেবল বলেন, ‘কতক্ষণ ধরে এসব গাড়িকে পাহারা দিয়ে রাখা যায়? অন্ধকার হলেই মানুষ গাড়িগুলো থেকে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ খুলে নিয়ে চলে যায়।’

শুধু শাহ আলী থানাই নয়, ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকার থানাগুলোতে প্রমাণ হিসেবে জব্দ করা কোটি টাকা মূল্যের কয়েক শ গাড়িতে মরিচা পড়ছে। সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় সেগুলো ধুলোয় ধূসরিত হচ্ছে।

ঝড়, শিলাবৃষ্টি, সূর্যের কঠিন দাবদাহ কিংবা তীব্র শীত— আবহাওয়া যেমনই হোক না কেন, মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এ গাড়িগুলোর দেখাশোনার জন্য কেউ নেই। এক পর্যায়ে গাড়ির ভেতরে গাছপালা জন্মাতে শুরু করে। গাড়িগুলো রূপান্তরিত হয় মশার চারণক্ষেত্রে।

ডেইলি স্টারের সংবাদদাতারা সম্প্রতি ঢাকার কমপক্ষে ১২টি, চট্টগ্রামের তিনটি, খুলনা মহানগরীর দুইটি এবং নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, বগুড়া, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, দিনাজপুর, ফরিদপুর ও বাগেরহাটের আরও ১৬টি থানা পরিদর্শন করে একই ধরনের পরিস্থিতি দেখতে পান।

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার এক কর্মকর্তা সম্প্রতি জানান, তার থানায় প্রমাণ হিসেবে মোটরসাইকেলসহ দেড় শতাধিক গাড়ি জব্দ অবস্থায় আছে। জায়গার অভাবে তারা কিছু যানবাহন স্টেশন চত্বরে ও আশেপাশের জায়গায় রাখতে বাধ্য হয়েছেন।

এ বিষয়ে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এ গাড়িগুলোকে পাহারা দেওয়ার জন্য আমাদের অতিরিক্ত জনবল মোতায়েন করতে হবে।’

সম্প্রতি বনানী থানায় গিয়ে দেখা গেছে, ধুলা ও ময়লা আবৃত জব্দ গাড়িগুলো থানার সামনের একটি সরু রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে রাখা। বেশ কিছু যানবাহনের যন্ত্রাংশ নিখোঁজ।’

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এই গাড়িগুলোর কারণে রাস্তায় যান চলাচলে সমস্যা হচ্ছে।

ডেইলি স্টারকে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই যানবাহনগুলোর বেশিরভাগই সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, কয়েকটি অপরাধের সময় ব্যবহার করা হয়েছিল, কয়েকটিকে দুষ্কৃতিকারীদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সদ্যসাবেক উপ-কমিশনার (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগ) মো. ওয়ালিদ হোসেন জানান, বিভিন্ন মামলার প্রমাণ হিসেবে জব্দ করা মোটরগাড়ি ও ভারী জিনিসগুলো জায়গার অভাবে তারা থানার বাইরে ও আশেপাশের এলাকায় রাখতে বাধ্য হচ্ছেন।

ফলে, জব্দ করা প্রমাণগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মানুষের যাতায়াত ও যান চলাচলেও সমস্যা হচ্ছে।

মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু জানান, গাড়িগুলোকে সংরক্ষণ করার জন্য বিদেশের মতো আমাদের আদালতের কোনো ইমপাউন্ড নেই। তিনি বলেন, ‘মামলাগুলোর বিচারকাজ শেষ হওয়ার পর পুলিশ আদালতের আদেশ অনুযায়ী গাড়িগুলো সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে।’

ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ট্র্যাফিক, উত্তর) আবু রায়হান মুহাম্মদ সালেহ বলেন, ‘আমরা যে গাড়িগুলো জব্দ করি, সেগুলো নির্দিষ্ট ডাম্পিং গ্রাউন্ডে রেখে দেওয়া হয়। সাধারণত সেখান থেকেই মালিকরা তাদের নিজ নিজ যানবাহন সংগ্রহ করে নিয়ে যান।’

তবে, উন্নত বিশ্বে এ পুরো প্রক্রিয়াটি বেশ ভিন্ন।

যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে মামলায় জব্দ হওয়া গাড়িগুলোকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনুমোদিত এজেন্টরা ‘ইমপাউন্ড’ করে। তারা এই গাড়িগুলোকে রেকারের মাধ্যমে নিয়ে যায় এবং মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিজস্ব ইমপাউন্ড গ্রাউন্ডে সংরক্ষণ করে। আদালতের ছাড়পত্র পাওয়ার পর গাড়ির মালিক ইমপাউন্ড এজেন্টকে উপযুক্ত রেকার চার্জ ও দৈনিক ভাড়া (যতদিন গাড়িটি ইমপাউন্ডে ছিল সে অনুযায়ী) দিয়ে গাড়িটি নিয়ে যেতে পারেন।

এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটা নিশ্চিত হয় যে গাড়িটি যে অবস্থায় আটক হয়েছিল, মালিক মোটামুটি সে অবস্থাতেই ইমপাউন্ড থেকে তা আবারও সংগ্রহ করতে পারছেন। বিদেশের ইমপাউন্ড লটগুলো সাধারণত বহুতল দালানগুলোতে হয়ে থাকে। সেখানে গাড়ির সুরক্ষার জন্য উপযুক্ত নিরাপত্তাকর্মী থাকে। অন্তত উপরে ছাদ থাকায় সেসব গাড়ি প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পায়।

Comments