অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের কারণে রক্ত জমাট বাঁধা এবং আমাদের যত ভ্রান্তি!

oxford-vaccine
ছবি: সংগৃহীত

সারা পৃথিবীতে করোনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে টিকাদান কর্মসূচি। তারপরও মহামারিকে প্রতিহত করতে হিমশিম অবস্থা। একটি ঢেউয়ের পরে আরেকটি ঢেউ এসে কেঁড়ে নিচ্ছে হাজার হাজার প্রাণ। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবং ইন্দোনেশিয়াসহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে করোনা সংক্রমণ আবার বাড়ছে আশংকাজনক হারে।

অতি সংক্রামক করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইনগুলো ছড়িয়ে পরছে চারদিকে। এ থেকে বাঁচার অন্যতম কার্যকরী হাতিয়ার হচ্ছে ভ্যাকসিন এবং কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। ভ্যাকসিনের সুফল পাওয়ার জন্য সময় দিতে হবে। আগে কয়েকবার বলেছি, আবারও বলছি। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন প্রথম ডোজ নেওয়ার ২২ দিন পর থেকে সাধারণত কার্যকারিতা শুরু হয়। কারও ক্ষেত্রে কার্যকারিতা শুরু এর চেয়ে কম সময়ে হয়ত হতে পারে, আবার কারও কারও ক্ষেত্রে কার্যকারিতা শুরু হতে ২২ দিনের চেয়েও বেশি সময় লাগতে পারে। সুতরাং ‘ভ্যাকসিন নেওয়ার ১২ দিন পর করোনায় আক্রান্ত’, ‘ভ্যাকসিন নেওয়ার এক মাস পর করোনায় আক্রান্ত’ এসব সংবাদ শিরোনাম সঠিক তথ্যকে আড়াল করে ভ্যাকসিন সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়ায়। এসব সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে আমাদের সতর্কতা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের মনে রাখতে হবে ভ্যাকসিনের সুরক্ষা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত।

আর এই ভ্যাকসিনকে নিয়েই শুরু হয়েছে অপপ্রচার এবং ভ্রান্তি। নেতিবাচক এসব খবরে তৈরি হচ্ছে ভ্যাকসিন ভীতি এবং অনেকেই আস্থা হারিয়ে ফেলছেন ভ্যাকসিনের ওপর।

সম্প্রতি ডেনমার্ক, নরওয়ে, আইসল্যান্ড, ইতালিসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটা দেশ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন প্রদান সাময়িক স্থগিত করেছে। তার কারণ, ভ্যাকসিন দেওয়ার পর কিছু সংখ্যক মানুষের শরীরে ব্লাড ক্লট বা রক্ত জমাট বাঁধাজনিত জটিলতা দেখা দিয়েছে। ডেনমার্ক এবং ইতালিতে দুজনের মৃত্যুও হয়েছে। নরওয়ের তিন জন অল্পবয়স্ক স্বাস্থ্যকর্মীর শরীরেও ভ্যাকসিন পরবর্তী ব্লাড ক্লট হয়েছে। এই রক্ত জমাট বাঁধার সঙ্গে ভ্যাকসিনের আসলেই কোনো সংযোগ রয়েছে কি না, তা ক্ষতিয়ে দেখার জন্যই মূলত ভ্যাকসিন প্রদান সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে এ কয়েকটি দেশে। তবে যুক্তরাজ্য, বাংলাদেশ এবং ভারতসহ পৃথিবীর অন্যান্য সব দেশেই অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের কার্যক্রম চলছে আগের মতই স্বাভাবিক।

অনুমোদনের পূর্বে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের ট্রায়াল করা হয়েছে ২৪ হাজার মানুষের ওপর। এই ট্রায়ালের সময় কারও শরীরে ভ্যাকসিনের কারণে রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা ঘটেনি। অনুমোদনের পর যুক্তরাজ্যে এ যাবত এই ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে ১১ লাখ মানুষকে। সেখানেও কোনো রক্ত জমাট বাঁধাজনিত জটিলতা দেখা দেয়নি। গোটা ইউরোপে ৫০ লাখ মানুষকে দেওয়া হয়েছে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন, যাদের ভেতরে মাত্র ৩০ জনের শরীরে দেখা দিয়েছে ব্লাড ক্লট বা রক্ত জমাট বাঁধা সমস্যা।

ব্রিটেনের রেগুলেটর এমএইচআরএ এবং ইউরোপের রেগুলেটর ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সি এই ঘটনাগুলো নিবিড়ভাবে ক্ষতিয়ে দেখেছে। তারা বলছে, ভ্যাকসিন দেওয়ার পর যে রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা ঘটেছে, তা নিতান্তই কোইন্সিডেন্টাল বা কাকতালীয় ঘটনা। এর সঙ্গে ভ্যাকসিনের কোনো সম্পর্ক নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও একই অভিমত। ব্লাড ক্লট বা রক্ত জমাট বাঁধা অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নয়।

তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, ভ্যাকসিন দেওয়ার পর খুব স্বল্প সংখ্যক হলেও কিছু কিছু মানুষের শরীরে এরকম ঘটনা ঘটছে কেন?

ডিপ-ভেইন থ্রোম্বসিস, পালমোনারি এম্বোলিজম এবং আর্টারিয়াল থ্রোম্বসিস হচ্ছে রক্ত জমাট বাঁধাজনিত রোগসমূহ। আর দশটা সাধারণ রোগের মতই এই রোগগুলোও হয় প্রাকৃতিক নিয়মেই। গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি বছর গোটা বিশ্বে গড়ে রক্ত জমাট বাঁধাজনিত সমস্যায় আক্রান্ত হয় প্রতি ১,০০০ জনে ১ জন। আর যাদের বয়স ৮০ বা তার বেশি তাদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটি প্রতি ১,০০০ জনে ৭ জন। ভ্যাকসিন দেওয়ায় এই সংখ্যার যদি কোনো প্রকার বৃদ্ধি হয়, তাহলে বলা যাবে যে রক্ত জমাট বাঁধার সঙ্গে ভ্যাকসিনের সংযোগ রয়েছে।

এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী সাধারণ গণিত করলে দেখা যায় যে, ইউরোপে ভ্যাকসিন ছাড়া এমনিতেই ৫০ লাখ মানুষের ভেতরে এক মাসে রক্ত জমাট বাঁধাজনিত সমস্যা দেখা দেওয়ার কথা ৪১৬ জনের এবং যাদের বয়স ৮০ বা তার বেশী, তাদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটি হবে প্রায় ৩,০০০ জন। একে বলে কোনো রোগের ইন্সিডেন্স। ইউরোপের দেশগুলোতে প্রথমে ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে বৃদ্ধদের। সুতরাং তাদের ক্ষেত্রে রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনাও বেশী।

এখন আমরা দেখছি ইউরোপে ৫০ লাখ অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রহীতার ভেতর রক্ত জমাট বাঁধাজনিত সমস্যা হয়েছে ৩০ জনের। এই সংখ্যাটি এক মাসে সম্ভাব্য ঘটনার চেয়ে ১৪ থেকে ১০০ গুণ কম। অর্থাৎ ভ্যাকসিন দেওয়ার পর যে ৩০টি রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা ঘটেছে তার সঙ্গে ভ্যাকসিনের কোনো সংযোগ নেই। এই রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনাগুলো স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটতো। এ কারণেই ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সি বলেছে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন রক্ত জমাট বাঁধার জন্য কোনো রিস্ক ফ্যাক্টর বা কারণ না। যে ঘটনাগুলো দেখা যাচ্ছে তা সম্পূর্ণই ‘কোইন্সিডেন্টাল’ বা কাকতালীয়।

বাংলাদেশে গত দেড় মাসে কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে ৪২ লাখের ওপর। এই ভ্যাকসিনে যদি রক্ত জমাট বাঁধতোই, তাহলে তো এই দেড় মাসে ব্লাড ক্লট বা রক্ত জমাট বাঁধা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতো কমপক্ষে ৫০০ জন। ভ্যাকসিন নেওয়ার পর করও রক্ত জমাট বেঁধেছে? একজনের তথ্যও আমরা জানি না।

ভারতে দুই কোটি মানুষকে কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। কয়জন মানুষ রক্ত জমাট বাঁধা সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে? এই সংখ্যাটি কি ১,৬০০ জনের বেশী? যদি না হয়ে থাকে তাহলে ভ্যাকসিনের সঙ্গে রক্ত জমাট বাঁধার কোনো সম্ভাবনা নেই। ভারতীয় রেগুলেটরের তথ্য অনুযায়ী এখনো কোভিশিল্ডের কারণে সেখানে রক্ত জমাট বাঁধার কোনো ঘটনা ঘটেনি।

তবে, ভ্যাকসিন দেওয়ার পর যদি কোনো মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা হয় বা করও মৃত্যু হয়, তাহলে তা যথাযথভাবে পরীক্ষা করে দেখতে হবে এর সঙ্গে ভ্যাকসিনের কোনো সংযোগ আছে কি না। আর এ কারণেই অনেক সময় ভ্যাকসিন কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত রাখা হয়। এটা সম্পূর্ণই নিরাপত্তা এবং সাবধানতার জন্য। এই ঘটনাটিই ঘটেছে ডেনমার্ক, নরওয়েসহ আরও কয়েকটি দেশে। খুব শিগগিরই হয়ত এই দেশগুলি আবার অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের কার্যক্রম পুনরায় শুরু করবে।

ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরুর দিকে ভারতে সংবাদ ছড়িয়েছিল যে, ভ্যাকসিন নিয়ে একজন বা দুজন মারা গেছে। পরবর্তীতে প্রমাণ হয়েছে যে, মারা গেছে হৃদরোগে এবং যার সঙ্গে ভ্যাকসিনের কোনো সম্পর্ক ছিল না। বাংলাদেশেও একটি মৃত্যুর ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে নিরূপণ করা অপরিহার্য ও অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে বিভ্রান্তি বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

সুতরাং, বাংলাদেশে যারা ভ্যাকসিন নিতে ভয় পাচ্ছেন বা দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভেতর রয়েছেন, তারা নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম না দেখে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিগুলো বোঝার চেষ্টা করুন। আন্তর্জাতিক ড্রাগ রেগুলেটর যা বলে তা বিশ্বাস করুন। কারণ তারা যেগুলো পরামর্শ দেয় তা বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনা করেই দিয়ে থাকে। আর এসব ক্ষেত্রে সেফটি বা নিরাপত্তার কথাটাই তারা সবচেয়ে ওপরে রাখে। সুতরাং ভ্যাকসিন নিন। ভ্যাকসিন আপনাকে বাঁচাতে পারে কোভিডের মৃত্যু থেকে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা ভুলবেন না। মাস্ক পড়ুন, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন। হাত ধোয়া অব্যাহত রাখুন, নাকে-মুখে হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।

ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম: এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি, সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য।

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

আরও পড়ুন:

অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন কতটা সুরক্ষা নিশ্চিত করে?

ভ্যাকসিন নিলেও করোনায় আক্রান্তের সম্ভাবনা থাকে?

ভারতে করোনার নতুন স্ট্রেইন, বাংলাদেশে সতর্কতা জরুরি

৪ সপ্তাহের পার্থক্যে দ্বিতীয় ডোজে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ৫৩ শতাংশ, ১২ সপ্তাহে ৮৩ শতাংশ

ভ্যাকসিন নেওয়া এবং না নেওয়া, মানুষ চিহ্নিত হবে দুই দলে

করোনার নতুন স্ট্রেইন শনাক্ত হয় না বাংলাদেশের পিসিআর পরীক্ষায়

মত-দ্বিমত ‘করোনাভাইরাসে দ্বিতীয়বার আক্রান্তের সম্ভাবনা নেই?’

ভ্যাকসিন নিয়ে দ্বিধা ও বিতর্ক কেন?

ভ্যাকসিন কবে পাব এবং অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের ‘ভুল ডোজ’র আশাবাদ

যুক্তরাজ্যের স্ট্রেইন দেশে শনাক্ত: ‘দেরিতে জানিয়ে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছি’\

করোনার নতুন স্ট্রেইন: করছি কী, করণীয় কী

করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইনে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ‘কিছুটা কমতে পারে’

ভ্যাকসিন, অ্যান্টিবডি পরীক্ষা ও গণস্বাস্থ্যের কিট

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

5h ago