কিশোর-মুশতাকের সামনে অসহায় এক সাংবাদিক

লেখক মুশতাক আহমেদ ও কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর। ছবি: সংগৃহীত

কেবিনে ঢুকেই দেখি বিছানা খালি। চোখের ডাক্তারের কাছে গেছেন। এখনই ফিরবেন, অপেক্ষায় থাকি। মিনিট বিশেক পর রুমে ঢুকলেন। হতভম্ব, কথা হারিয়ে ফেললাম। হুইল চেয়ারে কিশোর। কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর। তাকিয়ে আছি, কিশোরও। কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা ভেঙে ‘কেমন আছেন, ভাইয়া’ জানতে চাইলেন কিশোর! নিজেই হুইল চেয়ার থেকে নেমে বিছানায় ওঠে শুয়ে পড়লেন। শক্ত সামর্থ্য যুবক কিশোর ১০ মাসের ব্যবধানে জীর্ণ-শীর্ণ।

গত ৪ মার্চ কারাগার থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই কথা হয়েছিল কিশোরের সঙ্গে। ফোন করেছিলাম কিশোরের বড় ভাই লেখক আহসান কবিরকে। ‘ভাইয়া আমি কিশোর...’ আমাদের সেই কিশোরের কন্ঠস্বর যেন অপরিচিত। কিশোর বললেন, ‘আমরা ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার সঙ্গে দেখা করে হাসপাতালে যাব। বাসায় যাওয়ার মতো অবস্থায় নেই।’

গত ৬ মার্চ সন্ধ্যায় তাকে সামনে দেখছি। সেই অবস্থা যে এতটা করুণ, বোধে আসেনি সেদিন। কিশোরের হাঁটতে-চলতে খুব কষ্ট হয়।

পায়ের পাতায় ব্যথা, ব্যথা হাঁটুতে। সবই পরিকল্পিত নির্যাতনের ফল। হাত ব্যথা, ঘাড়ে ব্যথা, পিঠে ব্যথা। ব্যথা কমেছে, কান নিয়ে দুশ্চিন্তা কমেনি। মুখ ভর্তি কাঁচা-পাকা দাঁড়ি। বলছিলাম, ক্লিন সেভ করে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে কিশোর। দ্রুত সুস্থ হয়ে কাজ শুরু করতে হবে। কার্টুন আঁকতে হবে, স্কেচ করতে হবে। ফিরতে হবে স্বাভাবিক জীবনে। অপলক দৃষ্টিতে কথাগুলো শুনতে শুনতে নিচের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন, ‘জীবন...! মুশতাক ভাইয়ের বহু স্কেচ এঁকেছি কারাগারে...।’

চোখের পানিতে মুখের মাস্ক ভিজে যায়। লেখক মুশতাক আহমেদ ভর করে আছেন কিশোরের বিধ্বস্ত শরীর-মনের পুরোটা জুড়ে।

কথা প্রসঙ্গে মুখে হাসির ঝিলিক এলেও মুহূর্তেই যেন তা মিলিয়ে যায়। মুখ নিচু করে কী যেন ভাবতে থাকেন। মানসিক নিপীড়ন, শারীরিক নির্যাতন, অপমান-অসম্মানের ট্রমা যেন তার সঙ্গ ছাড়ছে না।

‘জেলে কত মানুষ। সবাই অবাক হয়ে বলেছেন, “আপনি শিল্পী মানুষ। আপনাকে এক নম্বর আসামি করেছে। আপনি তো ভাই ষড়যন্ত্রের শিকার”। কিছুই করলাম না। না করলাম কোনো অন্যায়, না করলাম কোনো অপরাধ। ব্যঙ্গ তো দূরের কথা, আমি প্রধানমন্ত্রী বা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যে কার্টুন আঁকিনি সেই কার্টুন দেখিয়ে তারা বলে, “তুই প্রধানমন্ত্রী ও জাতির পিতাকে ব্যঙ্গ করে কার্টুন এঁকেছিস”। যতই বলি, “না প্রধানমন্ত্রী বা জাতির পিতাকে নিয়ে কার্টুন আঁকিনি,” ততই বলে, “এঁকেছিস”।’

‘খাওয়া নেই, ঘুম নেই। ডায়াবেটিস থাকায় বেশিক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারি না। বারবার একই প্রশ্ন করে। মেজাজ বিগড়ে যায়। তারা আমাকে ‘তুই’ করে বলায় আমিও ‘তুই’ করে বলতে শুরু করি। ক্ষিপ্ত হয়ে বলি, এসব কী প্রশ্ন? কোনো প্রশ্ন হচ্ছে না। আমার কাছে ক্লাস করলে প্রশ্ন করা শেখাতে পারি। কার্টুন বোঝাতে পারি। লাঠি দিয়ে আঘাত করে, বিশ্রি ভাষায় গালাগালি করে। একই রকম ভাষায় জবাব দিই। আমিও সার্ভিসে ছিলাম,’— এক নাগারে কথাগুলো বলে যান কিশোর।

করোনার আগে থেকে বিদেশে স্কলারশিপ খুঁজছিলেন কিশোর। বেশ অগ্রগতিও হয়েছিল। কার্টুন বিষয়ে পড়াশোনার জন্যে বিদেশে যেতে চাচ্ছিলেন। কোভিড-১৯ সবকিছু থামিয়ে দেয়।

করোনাকালে কিশোরের কাজ ছিল না। অনলাইনে পরিচিতজনের কাছে কাজ চাচ্ছিলেন। লেখক মুশতাকের বইয়ের স্কেচ এঁকেছিলেন। মুশতাক ১০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন।

‘মুশতাক কেন তোকে টাকা দিলো?’— একথা বলেও মারধর করে কিশোরকে।

কিশোরকে কাকরাইলের যে বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয়, সেটা ছিল তার এক অস্ট্রেলিয়া-প্রবাসী বন্ধুর বাড়ি। বন্ধু বাড়িটি বিক্রি করে দিতে চাচ্ছিলেন। কিশোরই তখন ছিলেন বাড়িটির দায়িত্বে। সবকিছু ঠিকমতো চলছিল। হঠাৎ করে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। তুলে নেওয়ার পরের ৬৯ ঘণ্টায় ঘটতে থাকে এসব।

‘তোর পরিবারের কেউ আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে?’

‘করে’, দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন কিশোর।

‘কে’?

‘পিতা... এবং বোন...।

এরপর কিশোরের ওপর নেমে আসে সবচেয়ে ভয়ঙ্করতম নির্যাতন। দুই হাত দিয়ে এক সঙ্গে দুই কানে তীব্রভাবে আঘাত করে। কিশোর পরে জেনেছেন, এটা নির্যাতনের প্রচলিত ও দানবীয় কৌশল। কানের পর্দা ফাটানোর জন্যেই মূলত এভাবে আঘাত করা হয়। কিশোরের পৃথিবীটা যেন তছনছ হয়ে যায়। ভোঁ ভোঁ শব্দ হতে থাকে কানে-মাথায়। কিছু শুনছেন না, কিছু দেখছেন না। সম্বিত ফেরে, ডান কান দিয়ে গড় গড় করে রক্ত পরা দেখে।

‘কান দিয়ে রক্ত গড়িয়ে শার্ট ভিজে গেল’, শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলতে থাকেন কিশোর।

নিজের ওপর ঘটে যাওয়া দুঃস্বপ্নের বর্ণনা দিতে কতটা কষ্ট বা যন্ত্রণা হচ্ছিল তা পুরোটা বোঝা যাচ্ছিল না। সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে যায় মুশতাক আহমেদ প্রসঙ্গে।

‘মুশতাক ভাইয়ের ওপর যে কী নির্যাতন হয়েছে!’

কথা শেষ করতে পারেন না, গুমড়ে গুমড়ে কাঁদতে থাকেন কিশোর। থাক, অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলি।

কিন্তু, কিশোর ফিরে আসে মুশতাক প্রসঙ্গে। ‘মুশতাক ভাই বললেন, তুই কিন্তু কাউকে বলবি না যে আমাকে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে।’ আবার গুমড়ে কাঁদতে শুরু করেন কিশোর।

‘তোর ভাবি যেন না জানে, আব্বা-আম্মা যেন না জানে। বার বার আমাকে একথা বলেছেন মুশতাক ভাই,’ বলে যেতে থাকেন কিশোর।

কুমির চাষ করতে গিয়ে ২০০৫ সালে পরিচয় হয়েছিল মাসিহা আখতার লিপার সঙ্গে। লিপা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগ থেকে পাস করা প্রাণীবিদ। কুমির চাষি মুশতাক আহমেদের বর্ণাঢ্য জীবন। মুশতাক আহমদের বাবা ছিলেন কেরু অ্যান্ড কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলেন মুশতাক। তারপর স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে গিয়েছিলেন যুক্তরাজ্যে। চা বাগানে চাকরি করেছেন, ছিলেন ট্যুর গাইড। ঘটনাচক্রে মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর একটি নাটকে ট্যুর গাইডের চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। ২০০৫ সালেই বিয়ে করেন মুশতাক-লিপা। কুমির চাষ ও মুশতাকের জীবনের সঙ্গে মিলেমিশে যান লিপা। প্রিয় স্ত্রী লিপাকে নিজের অসম্মানের কথা লেখক মুশতাক আহমেদ জানাতে চাননি। জানাতে চাননি ৮৯ বছরের বাবা আর ৮১ বছরের মাকে!

কিশোর বলছিলেন, ‘মুশতাক ভাই মারা যাওয়া আগেও কারাগারে তিন বার এভাবে পড়ে গিয়েছিলেন।’ চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে কিশোরের।

‘মুশতাক ভাইয়ের মতো ভালো একজন মানুষকে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হলো...। কী যে যন্ত্রণা হয়েছে... কাপড় নষ্ট করে ফেলেছেন...। মুশতাক ভাই শারীরিকভাবে খুব ফিট ছিলেন। ইলেকট্রিক শকই...’ কিশোরের বাক্য শেষ হয় না।

‘হাঁটিয়ে এনে মুশতাক ভাই ও আমাকে মাইক্রোবাসে তোলা হলো। মুশতাক ভাই ঠিকমত হাঁটতে পারছিলেন না। হাঁটতে পারছিলাম না আমিও। নির্যাতনের অজানা স্থান থেকে খিলগাঁও র‌্যাব কার্যালয়ে নিয়ে গেল। মাইক্রোবাস থেকে ঠেলে নামানো হলো। ঠিকমত হাঁটতে পারছি না দুজনই। একবার ঠেলে নামায়, একবার ধাক্কা দিয়ে তোলে। এভাবে উঠানো-নামানো হলো কয়েকবার। যাতে আমরা ঠিকমত হেঁটে র‌্যাব অফিসে ঢুকি, যেন শুটিংয়ের রিহার্সেল। তখনো আমার কান দিয়ে রক্ত পড়ছিল। রক্তে শার্ট ভিজে গেছে। একজন বলল, “ওর রক্ত তো বন্ধ হয়নি”। একজন বলল, “এই নে পানি খা”। পানি খাওয়ানোর মতো করে কানে-গায়ে পানি ঠেলে দিলো। যেন রক্ত ধুয়ে যায়। খিলগাঁও র‌্যাব কার্যালয় থেকে আনা হলো টিকাটুলি র‌্যাব কার্যালয়ে। সেখানে শুটিংয়ের মতো করে ভিডিও করা হলো। তারপর হস্তান্তর করা হলো রমনা থানায়। সেই ভিডিওগুলো প্রকাশ করলেও বোঝা যাবে তখন আমাদের অবস্থা কেমন ছিল,’ চুপ করে তাকিয়ে থাকেন কিশোর।

কিশোরের ডায়াবেটিস অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। পায়ে আঘাতের তীব্রতাও কমছে। কিন্তু, দুশ্চিন্তার নাম কান। চোখে আগে সমস্যা ছিল না। এখন ঝাপসা দেখছেন।

গত দুই দিনের পরিচর্যায় কান দিয়ে পুঁজ বের হওয়া বন্ধ হয়েছে। কিন্তু, ডান কানে কিছুই শুনছেন না। কানের ডাক্তার এলেন। পর্যবেক্ষণ করলেন। তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না, এভাবে কেন একজন মানুষকে মারধর করা হবে! মেরে কানের পর্দা ফাটিয়ে দিল!

আজ কিশোরের কানের চুড়ান্ত পরীক্ষা হবে। কানের ভেতরের প্রকৃত অবস্থা হয়ত বোঝা যাবে। তার ওপর ভিত্তি করে হবে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত। অপারেশন করতে হবে কি না? কেমন অপারেশন, কতো বড় অপারেশন? অপারেশনে ডান কান কতটা স্বাভাবিক হবে, আদৌ স্বাভাবিক হবে কি না?— প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যেতে পারে।

ডান কানে কিশোর আবার কোনোদিন শুনতে পাবেন কি না সন্দেহ থাকলেও, কিশোরের মামলা চলা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

‘ছয় মাসের জামিন পেয়েছি, কিন্তু আমি তো স্বাধীন নই। রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খেতে পারছি না, হাঁটতে-চলতে পারছি না। কোনো অন্যায় অপরাধ করলাম না। অন্যায়-অপরাধ করা হলো আমার সঙ্গে, মুশতাক ভাইয়ের সঙ্গে। আমার মামলা চলবে, আমাকে এই অবস্থাতেও মামলা মোকাবিলা করতে হবে! অথচ, আমাদের যারা ধরে নিয়ে গেল, অজ্ঞাতস্থানে রেখে নির্যাতন করল তাদের কিছু হবে না! মামলা তো হওয়ার কথা তাদের নামে। টাকার সঙ্গে ক্ষমতার কী নীবিড় সম্পর্ক। একজন টাকাওয়ালার নাম উল্লেখ করে কতবার যে জানতে চেয়েছে আর মারধর করেছে, কেন তাকে নিয়ে কার্টুন এঁকেছি। কতজনের ছবি-ভিডিও দেখিয়ে জানতে চেয়েছে, চিনি কি না,’ বলছিলেন কিশোর।

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলছিলেন, ‘কিশোরকে যে প্রক্রিয়ায় গ্রেপ্তার ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জড়ানো হয়েছে, তার পুরো প্রক্রিয়াটাই বেআইনিভাবে হয়েছে। এর আগে কাজল-শহিদুল আলমদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। হেফাজতে নির্যাতন বন্ধে আইন হয়েছে ২০১৩ সালে। নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে মামলার সুযোগ আছে।’

‘সাদা পোশাকে কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারবে না, এটা আপিল বিভাগ বলে দিয়েছেন ২০১৫ সালে। তাহলে এখনো নিজস্ব বাহিনীর পোশাক ব্যতীত কোনো নাগরিককে গ্রেপ্তার করছেন কীভাবে? সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ বলছে উচ্চ আদালতের রায়ই আইন,’ বলছিলেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

যেকোনো কথা বলতে বলতে কিশোরের মুখে চলে আসে লেখক মুশতাকের নাম। দম বন্ধ করা কান্নায় ভেঙে পড়েন। পুরো সময়জুড়ে শরীরী মুশতাকের উপস্থিতি না থাকলেও অশরীরী মুশতাকের উপস্থিত প্রবল। সামনে অসহায় সাংবাদিক। যার কাছে প্রশ্ন আছে, আছে উত্তরও। করার নেই কিছু, কিছুই।

কিশোর জানেন, এই অবস্থা থেকে তাকে বেরিয়ে আসতে হবে। মামলা অসত্য প্রমাণ করে হাতে নিতে হবে পেন্সিল, রঙ-তুলি। মুশতাক ভাইয়ের জীবন তো কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবেন না। কিশোর বিশ্বাস করতে চান, মুশতাক ভাইয়ের জীবন আর আমাদের নির্যাতনের নিচে চাপা পড়ুক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। বাতিল করা হোক, প্রত্যাহার করে নেওয়া হোক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। আর কারো যেন কানের পর্দা না ফাটে, আর কারো জীবন যেন না যায়!

s.mortoza@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

Grim discovery: Five bodies found on vessel in Meghna

The incident had occurred on the Meghna river under Chandpur Sadar upazila in an area adjacent to Shariatpur

1h ago