ঢাবি লাইব্রেরিতে যেভাবে ধ্বংস হচ্ছে মাস্টারপিস শিল্পকর্ম

বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পকলার চারটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির দেয়ালে থাকা ভাস্কর নভেরার ভাস্কর্য ও শিল্পী হামিদুর রাহমানের ম্যুরালগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পকলার অন্যতম পথিকৃৎ দুই শিল্পীর শিল্পকর্মগুলোর কোথাও উঁইপোকা বাসা বেঁধেছে। কোথাও চটা ওঠে গেছে, কোথাও ফাটল ধরেছে। কোথাও ফোস্কা উঠেছে। আবার কোথাও দেয়ালে নোনা ধরেছে।

বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পকলার চারটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির দেয়ালে থাকা ভাস্কর নভেরার ভাস্কর্য ও শিল্পী হামিদুর রাহমানের ম্যুরালগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পকলার অন্যতম পথিকৃৎ দুই শিল্পীর শিল্পকর্মগুলোর কোথাও উঁইপোকা বাসা বেঁধেছে। কোথাও চটা ওঠে গেছে, কোথাও ফাটল ধরেছে। কোথাও ফোস্কা উঠেছে। আবার কোথাও দেয়ালে নোনা ধরেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ভাস্কর্য শিল্পের পথিকৃৎ ভাস্কর নভেরার শিল্পকর্মের সামনে নতুন করে কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে। হামিদুর রাহমানের ‘ফিশারমেন’স ভিলেজ’ ম্যুরালের ওপর তোলা হয়েছে দেয়াল। আর ‘বোরাক দুলদুল’ ম্যুরালের সামনের একটি অংশকে স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘বোট কম্পোজিশন’ ম্যুরালের নিচের রিসেপশন দপ্তরটি। এছাড়াও তিনটি ম্যুরালের চারপাশের বর্ডারে এক থেকে তিন ইঞ্চিজুড়ে লেগে আছে সাদা রং। ছোপ-ছোপ সাদা রং লেগে আছে শিল্পকর্মগুলোর উপর। সব কয়টি ম্যুরালেই দেখা গেছে মাকড়শার বাসা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির দেয়ালে থাকা শহীদ মিনারের ডিজাইনার ভাস্কর নভেরা আহমেদ ও শিল্পী হামিদুর রাহমানের শিল্পকর্মগুলোকে গবেষকরা ঐতিহাসিক, শৈল্পিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। গবেষকদের মতে, সচেতনতা ও যথাযথ যত্নের অভাবে শিল্পকর্মগুলো নষ্ট হচ্ছে।

পাবলিক ভবনে ম্যুরাল ও ভাস্কর্য স্থাপনের ঘটনা এদেশে সূচনা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি তথা সাবেক পাবলিক লাইব্রেরি ভবনের মাধ্যমে। পাবলিক লাইব্রেরির দেয়ালে ভাস্কর নভেরা করেছিলেন রিলিফ ভাস্কর্য ও শিল্পী হামিদুর রাহমান করেছিলেন তিনটি ম্যুরাল পেইন্টিং।

বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির দক্ষিণ ও পূর্ব অংশটি বিগত শতকের পঞ্চাশের দশকে পাবলিক লাইব্রেরি ভবন হিসেবে নির্মাণ করা হয়। আশির দশকে সরকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী নির্মিত কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি ভবন জায়গাসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বিনিময়ে চারুকলা অনুষদ ও জাতীয় জাদুঘরের মধ্যবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি ভবন নির্মাণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সরকারের কাছে হস্তান্তর করে।

ছবি: রাশেদ সুমন

এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাবেক পাবলিক লাইব্রেরি ভবনের পশ্চিম-উত্তর দিকে আরও ভবন নির্মাণ করে পুরাতন ও নতুন ভবন নিয়ে প্রতিষ্ঠা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি। ভাস্কর নভেরা ও হামিদুর রাহমানের শিল্পকর্ম রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ভবনের পুরাতন অংশ তথা সাবেক পাবলিক লাইব্রেরি ভবনের নিচতলায় ও দোতলায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ভবনটিও একটি তাৎপর্যপূর্ণ স্থাপত্য। এশিয়ার দেশগুলোর স্থপতিদের সংগঠন ‘আর্ক এশিয়া’র সভাপতি ও বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আবু সাঈদ এম আহমদ জানিয়েছেন, ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত প্রথম কয়েকটি ভবনের অন্যতম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি ভবনটির ডিজাইন করেছিলেন এদেশে আধুনিক স্থাপত্যের পথিকৃৎ স্থপতি মাযহারুল ইসলাম।

স্থপতি লুই আই কানের ডিজাইন করা জাতীয় সংসদ ভবন ও স্থপতি মাযহারুল ইসলামের ডিজাইন করা পাবলিক লাইব্রেরি ভবন ও চারুকলা অনুষদ ভবনকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। এই স্বীকৃতি অর্জনের প্রক্রিয়ায় যুক্ত রয়েছে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট।

অধ্যাপক আবু সাঈদ এম আহমদ আরও বলেন, ঢাকায় ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল, এসএম হল, বর্ধমান হাইজ, আহসান মঞ্জিল ইত্যাদি ভবন কলোনিয়াল রীতি অনুযায়ী নির্মিত হয়েছে। এসব ভবনের একটা মূল গেট থাকে। মাটি থেকে ভবনটি বেশ উঁচুও হয়ে থাকে।

কিন্তু, পাবলিক লাইব্রেরি ভবন ও চারুকলা অনুষদ ভবনে প্রবেশের তেমন কোনো মূল গেট নেই। ভবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে রয়েছে উন্মুক্ত পরিবেশ। ভবন দুটির মেঝে প্রায় মাটির কাছাকাছি। ভবন প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। প্রকৃতি ও ভবনকে তিনি ব্লেন্ড করেছেন। এদেশের জলবায়ুকে তিনি বিবেচনায় রেখেছেন প্রবলভাবে।

অধ্যাপক আবু সাঈদ এম আহমদের মতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ব্যাংকসহ বিভিন্ন পাবলিক ভবনের দেয়ালে আমরা যে শিল্পকর্ম প্রতিষ্ঠার বিষয় দেখি, এদেশে তার সূচনা পাবলিক লাইব্রেরি ভবন থেকে। এ অঞ্চলে পাবলিক লাইব্রেরি ভবনে প্রথম একতলা ও দোতলার মধ্যে র‌্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল।

ইউরোপে তখন কিছু কিছু ভবনে র‌্যাম্প স্থাপন করা হলেও ভারতীয় উপমহাদেশে সে সময় অন্য কোনো ভবনে র‌্যাম্প স্থাপনের কথা জানা যায় না। পাবলিক লাইব্রেরি ভবনে নিচতলা ও দোতলার দুটি সুপ্রশস্ত রিসেপশন ফ্লোরকে কানেক্ট করেছে পূর্ব পাশের র‌্যাম্প। র‌্যাম্প দিয়ে নিচে নামলেই বা র‌্যাম্প দিয়ে ওপরে উঠলেই দেয়ালের শিল্পকর্ম দেখা যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ লাইব্রেরির নতুন অংশ নির্মাণ করার পর বদলে যায় আদি নকশা অনুযায়ী ভবনের ব্যবহার। র‌্যাম্পের পাশে একতলা ও দোতলার রিসেপশন সেন্টার বন্ধ করে নতুন ভবনে স্থানাস্তর করা হয়। বদলে দেওয়া হয় ভবনের কাঠামোও।

ছবি: রাশেদ সুমন

নানা সময়ে ভবনটিতে ডিজাইন বহির্ভূত নির্মাণ কাজ করা হয়েছে। এর মধ্যে নিচতলা ও দোতলার রিসেপশন ফ্লোরও রয়েছে। নিচতলায় আদি রিসেপশন ফ্লোরে রয়েছে নভেরার শিল্পকর্ম। নভেরার ভাস্কর্য ও র‌্যাম্পের মধ্যে ছিল উন্মুক্ত পরিসর। ম্যুরালের পূর্ব ও দক্ষিণ দিক ছিল উন্মুক্ত। কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরবর্তীকালে র‌্যাম্প সংলগ্ন উন্মুক্ত স্পেসের অধিকাংশ স্থানজুড়ে একটি কক্ষ নির্মাণ করেছে।

রিসিপশন কক্ষের থাকা বাকি অংশের উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে বর্তমানে রাখা হয়েছে পরিত্যক্ত চেয়ার। ভাস্কর, গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক লালা রুখ সেলিম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘নভেরার ভাস্কর্যটি বর্তমানে যে পরিবেশে আছে এটা কোনো শিল্পকর্ম প্রদর্শনের পরিবেশ না। পরিবেশ দেখে মনে হয় না এটা কোনো শিল্পকর্ম। ভাস্কর্যের সামনে নতুন কক্ষ নির্মাণ করায় আলো-বাতাস আসতে পারে না। স্থানটি অন্ধকার হয়ে থাকে।

নভেরার ম্যুরালের নানাস্থানে বিশেষত নিচের দিকে বেশ কয়েকটি স্থান ফেটে গেছে। এর মধ্যে সাদা হাতি ও সাদা ঘোড়া অন্যতম। সাদা হাতিতে দুটি স্থানে ও সাদা ঘোড়ায় সাতটি ফাটল সরেজমিনে দেখা গেছে। ভাস্কর্যের বেশ কয়েকটি স্থানে মাকড়শার বাসা বেঁধেছে। ভাস্কর্যের বিভিন্ন অংশে গাঢ় রংয়ের দাগ দেখা গেছে।

দোতলার রিসেপশন ফ্লোরে রয়েছে শিল্পী হামিদুর রাহমানের ‘ফিশারমেন’স ভিলেজ’ ও ‘বোট কম্পোজিশন’ ম্যুরাল। এ দুটির বিষয় প্রায় একই। নদী, নৌকা, জেলেদের জীবনযাপন, জলাভূমি তথা আবহমান বাংলার জলজ ঐতিহ্য। দোতলার রিসেপশন কক্ষের উত্তর দেয়ালে রিসেপশন দপ্তরের ওপরে রয়েছে ‘বোট কম্পোজিশন’ এবং কক্ষের পশ্চিম দেয়ালের ওপরের অংশে রয়েছে ‘ফিশারমেন’স ভিলেজ’ ম্যুরাল।

দোতলার রিসিপশন দপ্তরটি এখন পরিত্যক্ত। দোতলার রিসিপশন কক্ষটিকে শিল্পকর্মের মাঝে দেয়াল দিয়ে দুভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে মেঝে থেকে ম্যুরালের প্রায় দুই ইঞ্চি ওপর পর্যন্ত ইট দিয়ে দেয়াল ও এর ওপর ছাদ পর্যন্ত ম্যুরালের ওপর লোহার রডের ফ্রেম দিয়ে দেয়াল দেওয়া হয়েছে।

বিভক্ত কক্ষের দক্ষিণ অংশ বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি প্রশাসনের প্রসেসিং সেকশনের দপ্তর আর উত্তর অংশ ক্যাটালগ সেলফ রাখার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দেয়ালের কারণে হামিদুর রাহমানের ‘ফিশারমেন’স ভিলেজ’ শিল্পকর্মটির কিছু অংশ ঢাকা পড়ে গেছে। এছাড়া দেয়াল দিয়ে ভাগ করার কারণে কক্ষের কোনো স্থান থেকেই এখন আর হামিদুর রাহমানের ‘ফিশারমেন’স ভিলেজ’ পুরোপুরি দেখা যায় না।

ছবি: রাশেদ সুমন

‘ফিশারমেন’স ভিলেজ’ ম্যুরাল সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, দেয়াল ও ছাদ রং করার সময় পেইন্টিংটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে এর ওপর, নিচ ও বাম পাশে দেখা গেছে সাদা রংয়ের প্রলেপ। এছাড়া বর্গা (I beam) সংলগ্ন শিল্পকর্মটির তিন দিকেই দুই থেকে তিন ইঞ্চি পর্যন্ত লেগে গেছে সাদা রং।

‘বোট কম্পোজিশন’ শীর্ষক ম্যুরালের নিচের রিসেপশন দপ্তরটি এখন ব্যবহৃত হয় ভাঙ্গা চেয়ার রাখার স্থান হিসেবে। ম্যুরাল সংলগ্ন পূর্ব দিকে নিচে স্থাপন করা হয়েছে বৈদ্যুতিক সার্কিট বক্স। ম্যুরালের নিচের অংশে স্থাপন করা হয়েছে ইলেকট্রিক তার। সরেজমিনে দেখা গেছে, ‘বোট কম্পোজিশন’ ম্যুরালটির বেশ কয়েকটি স্থানে ফাটল ধরেছে। ম্যুরালটির নিচে ও ওপরের দিকে প্রায় দুই ইঞ্চি স্থান জুড়ে লেগে আছে সাদা রং। আর বর্গা (I beam) সংলগ্ন ম্যুরালটির ওপর তিন দিকে প্রায় তিন ইঞ্চি স্থান জুড়ে সাদা রং লেগেছে।

হামিদুর রাহমানের তিনটি শিল্পকর্মের মধ্যে ভবনের পশ্চিম অংশের পশ্চিম প্রান্তে দেয়ালজুড়ে রয়েছে ‘বোরাক দুলদুল’ পেইন্টিং। ধর্মীয় বিশ্বাসের আধুনিক রূপায়নের এক অনন্য নিদর্শন এই শিল্পকর্মটি। এ বিষয়ে সাঈদ আহমদ সম্পাদিত ‘হামিদুর রাহমান’ শীর্ষক গ্রন্থে বলা হয়েছে, পাবলিক লাইব্রেরির দেয়ালে ১,৭০০ বর্গফুট স্থানজুড়ে রয়েছে ‘বোরাক-দুলদুল’।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির ভবনের ম্যুরালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ‘বোরাক-দুলদুল’। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সাময়িকী বিভাগ কক্ষের পশ্চিমের পুরো দেয়ালের ওপর জুড়ে রয়েছে ‘বোরাক দুলদুল’।

সরেজমিনে দেখা গেছে, শিল্পকর্মটির ছাদ থেকে নিচে প্রায় তিন ফুট স্থান পুরো দেয়াল জুড়ে নোনা ধরেছে। নোনা ধরেছে শিল্পকর্মটির দক্ষিণ দিকে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত প্রায় এক ফুট জায়গায়। নোনা ধরা অংশে স্থানে স্থানে ম্যুরালের চটা উঠে গেছে। কোথাও কোথাও ফোস্কা হয়ে আছে। আবার কোথাও ফোস্কা ফেটে ফাটল ধরেছে। দুলদুলের গলায় এমন একটি ফাটল দেখা গেছে।

‘বোরাক দুলদুল’র সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অংশ ঝুল বারান্দা সংলগ্ন দক্ষিণ দিকের অংশ। সাময়িকী বিভাগ কক্ষের পশ্চিম দিকে রয়েছে একটি ঝুল বারান্দা। ম্যুরাল সংলগ্ন ঝুল বারান্দাটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ব্যবহার করছেন অনেকটা ‘স্টোর রুম’ হিসাবে। সরেজমিনে দেখা গেছে, সেখানে পরিত্যক্ত আলমারি, কার্টন ভর্তি বই ইত্যাদি অপরিকল্পিতভাবে রাখা আছে। পেইন্টিংয়ে গা ঘেঁষে রাখা হয়েছে আলমারি। ফলে ঝুল বারান্দার অংশে পেইন্টিং এখন আড়ালে পড়ে গেছে।

আলমারির ফাঁক দিয়ে দেখা গেছে, সেই স্থানটি খুবই নোংরা অবস্থায় আছে। ‘বোরাক দুলদুল’র এই অংশে একাধিক জায়গায় উঁই পোকা বাসা বেঁধেছে। উঁইয়ের একটি বাসা ভাঙা ও একটি বাসা অক্ষত দেখা গেছে। তবে আলমারি দিয়ে আড়াল থাকায় সেই অংশে উঁইয়ের আরও বাসা আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

পাবলিক লাইব্রেরি ভবনে শিল্পকর্মগুলোতে আধুনিকতা ও লোক ঐতিহ্যের সমন্বয় ঘটেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দীপ্তি রাণী দত্ত এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ভাস্কর নভেরা, শিল্পী হামিদুর রাহমান, শিল্পী মুর্তজা বশীর, শিল্পী আমিনুল ইসলাম, শিল্পী কাজী বাসেদ প্রমুখ ইউরোপ, আমেরিকায় গিয়ে সেখানকার শিল্পকলা শিক্ষার বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনা করেছেন। দেশে ফিরে এসে তারা সবাই কাজ করেন আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের সমন্বয়ে। ফোক আর্ট, প্রিমিটিভ আর্টকে তারা আধুনিক রূপে নিয়ে আসেন। পাবলিক লাইব্রেরি ভবনের চারটি শিল্পকর্মেই আমরা ফোক আর্ট ও প্রিমিটিভ আর্টের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করি।

তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পকলা চর্চার সূচনাকালের শিল্পচেতনা ও বৈশিষ্ট্য বহন করে চলছে সেসব শিল্পকর্ম।

দীপ্তি রানী দত্ত আরও বলেন, নভেরার কাজের ফিগার সরলীকৃত ও জ্যামিতিক। কালেক্টিভ চেতনা ভাস্কর নভেরার কাজের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। তবে এটা রাজনৈতিক নয়— পারিবারিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির নিচতলার প্রবেশপথে নভেরার ভাস্কর্যেও আমরা পরিবার দেখি। দেখি লোকশিল্পের প্রভাব, প্রিমিটিভ আর্টের প্রভাব। নেগেটিভ স্পেসের (ভাস্কর্যের মধ্যে উন্মুক্ত অংশ) ব্যবহার নভেরার কাজের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। নভেরার এই কাজটিতে ফিগার ও জ্যামিতিক ব্লকের মাঝে রয়েছে নেগেটিভ স্পেস, যা একাডেমিক শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার।

শিল্পকর্ম সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাসিমুল খবির ডিউক বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির রিলিফ ও ম্যুরালগুলো মাস্টারপিস ওয়ার্ক। শিল্পকর্মগুলো ঐতিহাসিক, শৈল্পিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের শিল্পকলা-স্থাপত্যের ইতিহাস, আমাদের জাতীয় ইতিহাস।

তিনি ভাস্কর নভেরা আহমেদ ও হামিদুর রাহমানের শিল্পকর্মগুলো দ্রুত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পকর্ম সংস্কার করা একটি জটিল প্রক্রিয়া। সময় ও শ্রমসাধ্য কাজ। অনেক যত্ন নিয়ে করতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির ম্যুরালগুলোর ক্ষতিগ্রস্ত অংশ পুনরায়ণের (রেস্টোরেশন) কাজটি যত্ন নিয়ে করতে হবে। কনজারভেশন এপ্রোচে রেস্টোরেশনের কাজটি করা দরকার।

ছবি: রাশেদ সুমন

ভাস্কর, গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক লালা রুখ সেলিম এ প্রসঙ্গে বলেন, সংস্কারের কথা বললে কিছুটা ভয় পাই। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সংস্কারের নামে ঠিক করতে গিয়ে বেঠিক করে ফেলে, নষ্ট করে ফেলে, নতুন কিছু করে ফেলে। অতীতে ভাস্কর নভেরার ভাস্কর্য সংস্কারের সময় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।

তিনি আরও বলেন, যথাযথভাবে সংরক্ষণের জন্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে টিম করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়েই বিশেষজ্ঞরা আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন, ভাস্কর্য, পেইন্টিং ইত্যাদি বিভাগের শিক্ষকদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তবে শুধু সংরক্ষণ করলেই হবে না। শিল্পকর্মগুলোর প্রপার ডিসপ্লের ব্যবস্থা করতে হবে।

স্থপতি মাযহারুল ইসলাম ভবনটিতে সুপরিকল্পিতভাবে শিল্পকর্মের জন্য স্থান রেখেছিলেন, রেখেছিলেন ডিসপ্লের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ। কিন্তু, অপরিকল্পিত নানা উদ্যোগের ফলে সেই ডিসপ্লের পরিবেশ নষ্ট হয়েছে।

অধ্যাপক আবু সাঈদ এম আহমদ বলেন, স্থপতি মাযহারুল ইসলাম যেমন পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব, তেমনি পাবলিক লাইব্রেরি ভবনের দেয়ালে ম্যুরাল করেছিলেন এদেশের আধুনিক শিল্পকলার দুজন পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব। নানা দিক থেকেই ভবনটি ও ভবনের দেয়ালের শিল্পকর্মগুলো গুরুত্বপূর্ণ। পাবলিক লাইব্রেরি ভবনটি শুধু জাতীয় ঐতিহ্যই নয়, বৈশ্বিক আধুনিক স্থাপত্য ঐতিহ্যে একটি উল্লেখযোগ্য তাৎপর্যপূর্ণ স্থাপত্য।

ভবনটিতে ডিজাইন বহির্ভূত ইট ও লোহার বিভিন্ন ধরনের কাঠামো স্থাপনের ফলে ওপেননেস বৈশিষ্ট্য নষ্ট করা হয়েছে। ভবনটিতে ডিজাইন বহির্ভূত যে সব কাঠামো স্থাপন করা হয়েছে, তা অপসারণ করে আদিরূপে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব এবং এটা করা দরকার। প্রয়োজন ভবনটির  ভাস্কর্য ও ম্যুরালগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ।

Comments

The Daily Star  | English

Yunus’ economic gambit paying off

Two months ago, as Professor Muhammad Yunus waded into Bangladesh’s unprecedented political turmoil, he inherited economic chaos by default.

5h ago