ভারতে করোনার নতুন স্ট্রেইন, বাংলাদেশে সতর্কতা জরুরি
গত এক সপ্তাহে হঠাৎ করে মহারাষ্ট্রসহ দক্ষিণ ভারতের আরও কয়েকটি রাজ্যে করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেছে আশংকাজনকভাবে। গত কয়েক মাস ধরে পাঁচ হাজারের বেশি সংখ্যক মিউটেশন অ্যানালাইসিস করে হায়দ্রাবাদের সেন্টার ফর সেলুলার অ্যান্ড মলিক্যুলার বায়োলজির গবেষকগণ ধারণা করছেন যে ভাইরাসের এই দ্রুত বিস্তারের পেছনে নতুন ধরনের মিউটেশন ‘এন-৪৪০-কে’ দায়ী। এই মিউটেশনটি ঘটেছে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনে।
মিউটেশনটি প্রথম পাওয়া গিয়েছিল গত বছরের শেষের দিকে। কিন্তু, গত একমাসে এই নতুন স্ট্রেইনটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে দক্ষিণ ভারতে, সেই সঙ্গে সংক্রমণও বেড়ে যাচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন যে এই মিউটেশনটির সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাওয়া মিউটেশনের চারিত্রিক কিছু মিল রয়েছে। অর্থাৎ, এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট ভাইরাসটি আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে ফাঁকি দিতে পারে। রি-ইনফেকশন করতে পারে এবং মূল করোনাভাইরাসের বিপরীতে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি এই মিউট্যান্ট ভাইরাসকে নিস্ক্রিয় করতে পারে না। এই ধরনের মিউটেটেড ভাইরাসগুলো সাধারণত ভ্যাকসিনবিরোধী হয়ে থাকে। এটাই হচ্ছে শঙ্কার মূল কারণ।
যদিও কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন এই নতুন ভ্যারিয়্যান্টের ওপর কতটুকু কার্যকর তা এখনো পরীক্ষা করে দেখা হয়নি, তবে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
করোনাভাইরাসের মিউটেশন নতুন কিছু নয়। আরএনএ ভাইরাসে ক্রমাগত মিউটেশন বা রূপান্তর ঘটে ও তৈরি হয় নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট বা স্ট্রেইন। চীনে আবির্ভাবের পর থেকে প্রতি মাসে গড়ে করোনাভাইরাসের দুটি করে উল্লেখযোগ্য মিউটেশন ঘটেছে। মিউটেশনের ফলে ভাইরাস হয়ে ওঠতে পারে আগের চেয়ে শক্তিশালী ও ভ্যাকসিনের বিপরীতে তৈরি করতে পারে শক্ত প্রতিরোধ। এ কারণেই বিশ্বব্যাপী ভাইরাসের জেনোম সিক্যুয়েন্স করা হচ্ছে নিয়মিত এবং লক্ষ্য রাখা হচ্ছে ভাইরাসের গঠন ও চারিত্রিক পরিবর্তনের উপর।
করোনাভাইরাসের সর্বপ্রথম আলোচিত মিউটেশনটি ছিল ডি-৬১৪-জি মিউটেশন। মূলত গত বছরের মার্চের পর থেকে গোটা বিশ্বে ৯৫ শতাংশ সংক্রমণই হয়েছে এই মিউট্যান্ট ভাইরাস দিয়ে। এই মিউটেশনটি ঘটেছে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনে। তবে এর কারণে ভাইরাসের আক্রান্ত করার ক্ষমতা কোনো প্রকার বৃদ্ধি পায়নি এবং এ যাবৎ উৎপাদিত সব ভ্যাকসিনই এর ওপর কার্যকর।
সম্প্রতি, করোনাভাইরাসের আরও বেশ কয়েকটি মিউটেশন মহামারি নিয়ন্ত্রণে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরে যুক্তরাজ্যের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ‘বি-১.১.৭’ ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনে মিউটেশন ঘটেছে ১৭টি। মিউটেশনটি ‘কেন্ট মিউটেশন’ নামেও পরিচিত। এই গুচ্ছ-মিউটেশনগুলোর ভেতরে এন-৫০১-ওয়াই নামক মিউটেশনটি ঘটেছে স্পাইক প্রোটিনের প্রান্তে থাকা রিসিপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইনে। এই ক্ষুদ্র অংশটির মাধ্যমেই ভাইরাস কোষকে সংক্রমিত করে। আবার ভ্যাকসিনের মাধ্যমে তৈরি হওয়া নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডিও এই অংশটির ওপর কাজ করে ভাইরাসকে নিস্ক্রিয় করে। সুতরাং এন-৫০১-ওয়াই মিউটেশনটি ভাইরাসের সংক্রমণ ও ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত।
এই মিউট্যান্ট ভাইরাসটি এখন যুক্তরাজ্যেসহ ৯৪টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এর ভেতরে রয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও। মিউটেশনের কারণে ভাইরাসের সংক্রমণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে ৫০ শতাংশ এবং মারাত্মকভাবে আক্রান্ত করার ক্ষমতা বেড়েছে ৩০ শতাংশ।
তবে আশার কথা হচ্ছে, এই মিউটেশনের কারণে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতায় উল্লেখযোগ্য তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি। অর্থাৎ, অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনসহ সব ভ্যাকসিনই এই কেন্ট মিউটেশনের ওপরে কাজ করছে।
অন্যদিকে, দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়্যান্ট ‘বি-১.৩৫১’ ভাইরাসটি হয়ে ওঠেছে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার জন্যে হুমকি। এই নতুন স্ট্রেইনে একই সঙ্গে দুটি মিউটেশন ঘটেছে রিসিপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইনে। একটি কেন্ট মিউটেশনের মতো এন-৫০১-ওয়াই ও আরেকটি ই-৪৮৪-কে মিউটেশন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় এখন ৯০ শতাংশ সংক্রমণই হচ্ছে এই মিউট্যান্ট ভাইরাস দিয়ে। এখন পর্যন্ত এই স্ট্রেইনটি ছড়িয়ে পড়েছে ৪৬টি দেশে। ব্রাজিলেও পাওয়া গেছে এই একই ধরনের মিউটেশন যা পি-১ নামে পরিচিত।
অতি-সম্প্রতি ল্যাবরেটরি ও ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে প্রমাণিত হয়েছে যে দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন স্ট্রেইনটির ওপর ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। অক্সফোর্ড বা কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমে গেছে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ আর ফাইজার ভ্যাকসিন তার কার্যকারিতা হারিয়েছে দুই-তৃতীয়াংশ। অর্থাৎ, ভ্যাকসিনগুলো এই নতুন ভ্যারিয়্যান্টের ওপর অনেকটাই অকার্যকর। এ কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকা সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা ১০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন ফিরিয়ে দিতে চাচ্ছে।
গোটা বিশ্বের জন্য এই দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্ট এখন হুমকি স্বরূপ। ভ্যাকসিন প্রয়োগের মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবন স্বাভাবিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে বিশ্বব্যাপী। করোনায় ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ যুক্তরাজ্য। তাদের ২৪ শতাংশ মানুষকে এরই মধ্যে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশও ২০ লাখ মানুষকে দেওয়া হয়েছে কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন।
বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। এ অবস্থায় যদি দেশে দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল বা ভারতের নতুন করোনাভাইরাস স্ট্রেইন ঢুকে পরে এবং তা ছড়িয়ে পরে দেশব্যাপী, তাহলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। এটা বিবেচনা করেই যুক্তরাজ্য সরকার দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলসহ ৩৩টি দেশকে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। এসব দেশ থেকে যারাই আসুক তাদেরকে ১৪ দিনের হোটেলে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করেছে। উদ্দেশ্য একটাই, তাদের দেশে যেন ভ্যাকসিন প্রতিরোধী দক্ষিণ আফ্রিকা মিউটেশন না প্রবেশ করে।
বাংলাদেশ এ ব্যাপারে কি উদ্যোগ নিচ্ছে? যেহেতু ভ্যাকসিন রেজিস্ট্যান্ট নতুন স্ট্রেইন অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে এবং ভারতেও নতুন স্ট্রেইনটি ভ্যাকসিন রেজিস্ট্যান্ট হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ কি কোনো ‘লাল তালিকা’ তৈরি করেছে এ ব্যাপারে? কোয়ারেন্টিন ও জেনোম সিক্যুয়েন্স সংখ্যা কি বৃদ্ধি করা হয়েছে? আমাদের দেশে কি উপরোল্লেখিত কোনো মিউটেশনের অস্তিত্ব আছে?
করোনাভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণশীল ও ভ্যাকসিন-রেজিস্ট্যান্ট স্ট্রেইনের অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে পারা হবে সবচেয়ে কার্যকরী উদ্যোগ। আর এর জন্য লাল তালিকাভুক্ত দেশগুলো থেকে আসা সবাইকে ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখতে হবে। কোয়ারেন্টিনে থাকাকালে দুইটি স্যাম্পল টেস্ট করতে হবে। সব পজিটিভ স্যাম্পলকে জেনোম সিক্যুয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে মিউটেশন স্ট্যাটাস চেক করতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থা সম্প্রতি সব দেশকে জেনোম সিক্যুয়েন্সিংয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে তাগিদ দিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন দেওয়ার পরও যদি কেউ কোভিডে আক্রান্ত হন, তবে তাদের স্যাম্পল সিক্যুয়েন্সিং করতে হবে। কারণ, এক্ষেত্রে সংক্রমণ ভ্যাকসিন-রেজিস্ট্যান্ট ভাইরাস দিয়ে হওয়ার সম্ভবনাই বেশি।
তৃতীয়ত, যারা দ্বিতীয়বার কোভিডে আক্রান্ত হবে তাদের স্যাম্পল অবশ্যই সিক্যুয়েন্সিং করতে হবে। কারণ রি-ইনফেকশন অনেক ক্ষেত্রেই মিউটেটেড ভাইরাস দিয়ে হয়ে থাকে। যেহেতু আমাদের জেনোম সিক্যুয়েন্সিং সক্ষমতা কম, সেহেতু হাই-রিস্ক কেইসগুলোকে সিক্যুয়েন্সিং করতে পারলে অন্ততপক্ষে দেশে করোনাভাইরাসের মিউটেশনের একটা সার্ভাইল্যান্স হয়ে যাবে। এ সময়টাতে ভাইরাস মিউটেশনের দিকে কঠোর নজর রাখা জরুরি। কারণ ভ্যাকসিন অনেক মিউটেশনের ক্ষেত্রেই অকার্যকর।
ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম, এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি, সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য
Comments