নীরবে হারিয়ে যাচ্ছে
দুই বছর আগে বিপন্ন ঘোষিত ১৪টি ভাষার ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় সেগুলো এখন বিলীন হওয়ার পথে রয়েছে। এসব ভাষা সংরক্ষণের জন্যে সরকারের পক্ষ থেকে বিস্তৃত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এর মধ্যে কয়েকটি ভাষার অবস্থা এতই শোচনীয় যে, নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ১০ থেকে ১২ জন প্রবীন শুধু ওই ভাষাগুলোতে কথা বলে থাকেন।
ইউনেসকোর মতে, ‘একটি ভাষা তখনই হারিয়ে যায়, যখন সেই ভাষায় কথা বলার লোক হারিয়ে যায় কিংবা তারা অন্য ভাষায় কথা বলতে শুরু করে— বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটি তুলনামূলক শক্তিশালী গোষ্ঠী দ্বারাই বৃহত্তর ভাষা ব্যবহার হয়ে থাকে।’
তারা আরও বলছে, ‘সামরিক, অর্থনীতি, ধর্ম, সাংস্কৃতিক বা শিক্ষামূলক পরাধীনতার মতো বাহ্যিক চাপ ও কোনো সম্প্রদায়ের তাদের নিজস্ব ভাষার প্রতি নেতিবাচক মানসিকতার মতো অভ্যন্তরীণ চাপের কারণে ভাষাগুলো হুমকির সম্মুখীন।’
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (আইএমএলআই) কর্তৃক পরিচালিত ২০১৮ সালে শেষ হওয়া এক ভাষাগত জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বিপন্ন ঘোষিত ১৪টি ভাষা হলো— কন্দ, খাড়িয়া, কোডা, সৌরা, মুণ্ডারি, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিত্চা, চাক, খিয়াং, লুসাই ও লালেং (পাত্র)।
সাধারণত দেশের উত্তরাঞ্চল, সিলেট অঞ্চল ও চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে এসব ভাষাভাষী লোক রয়েছে। দেশে নৃ-গোষ্ঠীদের মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহৃত ৪১টি ভাষার মধ্যে এই ১৪টিও রয়েছে।
এই ভাষাগুলোর কোনো লিখিত রূপ বা বর্ণমালা না থাকায় এগুলোর সংরক্ষণ বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে এই ভাষাভাষী লোকের সংখ্যাও কমেছে এবং সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের পরবর্তী প্রজন্ম এ ভাষা আর শিখছে না বা ব্যবহার করছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে বিপন্ন এই ভাষাগুলো সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক শিক্ষাসহ হারিয়ে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাশরুর ইমতিয়াজ বলেন, এই ১৪টি ভাষায় কথা বলা জনগোষ্ঠীতে লোকের সংখ্যা এক থেকে ৪০ হাজারের মধ্যে।
তিনি বলেন, ‘মুণ্ডারির ক্ষেত্রে মোট জনসংখ্যা ৪০ হাজারের মতো। কিন্তু, ভাষাগত দিক থেকে বাস্তবে এ ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা আরও অনেক কম।’
তিনি আরও জানান, বর্তমানে খড়িয়া ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারা লোকের সংখ্যা ১৫ এর চেয়েও কম।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যখন কোনো একটি ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা পাঁচ হাজারেরও কম হয়, তখন সেটি বিপন্ন ভাষা বলে বিবেচিত হয়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের উপপরিচালক (প্রকাশনা ও গবেষণা পরিকল্পনা) ড. মো. ইলতেমাস বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের লোকেরা যদি তাদের ভাষা সংরক্ষণ করতে চায়, তাহলে তাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। এরপর সরকার তাদেরকে পরবর্তী প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে পারবে।’
তিনি জানান, ভাষাতত্ত্ব সমীক্ষা প্রকল্পের আওতায় গবেষকরা প্রতিটি ভাষার ৩০০টি করে শব্দ নিয়েছেন এবং এগুলোর বাংলা ও ইংরেজি অর্থও সংগ্রহ করেছেন। এসব ভাষায় কীভাবে বাক্য গঠন করতে হয় এবং এগুলোর নৃতাত্ত্বিক উৎস কী, সেসব নিয়ে কাজ করছেন গবেষকরা।
গবেষণা কাজটি বাংলা ও ইংরেজিতে প্রকাশ করা হবে এবং প্রধনামন্ত্রী তা উদ্বোধন করবেন বলেও জানান ড. ইলতেমাস।
গবেষণাটি শেষ হওয়ার দুই বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো সেটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়নি।
ড. ইলতেমাস জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তার ৭ই মার্চের ভাষণ পাঁচটি নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় অনুবাদ করে তা প্রকাশ করা হয়েছে। ওই পাঁচ ভাষা হলো— চাকমা, মারমা, গারো, সাদরি ও ককবরক।
আইএমএলআইর এক কর্মকর্তা জানান, তারা ১০টি নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে একটি তথ্যচিত্রও নির্মাণ করছেন।
তবে, ঢাবির ভাষাতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৌরভ সিকদার বলেন, বিপন্ন ভাষাকে বাঁচাতে কেবল তথ্যচিত্র নির্মাণই যথেষ্ট নয়।
‘শুধু একটি ভাষার তথ্যচিত্র নির্মাণ সেই ভাষাকে বাঁচাতে পারে না। আমাদের এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে ওইসব সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের ভাষা চর্চা করতে পারে। তারা যাতে তাদের মাতৃভাষায় পড়তে, লিখতে ও কথা বলতে পারে’, বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘তারা যাতে অন্তত প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত পড়াশোনা নিজ ভাষাতে করতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে এই ১৪টি ভাষার ক্ষেত্রে সরকারের এমন কোনো উদ্যোগ নেই।’
২০১৭ সালে সরকার পাঁচটি ভিন্ন ভাষায় প্রি-প্রাইমারি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বই প্রকাশ করতে শুরু করে। ভাষাগুলো হলো— চাকমা, মারমা, ককবরক, গারো ও সাদরি।
চাকমা ও মারমা ভাষার বই তাদের নিজস্ব স্ক্রিপ্টে হয়েছে। বাকি তিনটি হয়েছে রোমান স্ক্রিপ্টে। সাঁওতাল ভাষার বই প্রকাশের বিষয়টি প্রকল্পে রাখা হলেও পরবর্তীতে বইয়ে কোন বর্ণমালা ব্যবহার করা হবে, তা নিয়ে সম্প্রদায়টি একমতে পৌঁছাতে না পারায় সেটি বাদ দেওয়া হয়।
প্রকল্পটিতে এক ধরনের মিশ্র সাফল্যের কথা উল্লেখ করে নতুন বইয়ের আঙ্গিকে শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকার কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সৌরভ সিকদার বলেন, ‘মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার প্রকল্পটি বিভিন্ন কারণে খুব বেশি সফল হয়নি।’
বিপন্ন ভাষা রক্ষায় বিভিন্ন ব্যবস্থা নেবে, এমন একটি ভাষা কমিশন গঠন করতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি।
মাতৃভাষার জন্যে লড়াইয়ের গৌরবময় ইতিহাসের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দেশের সব নাগরিকই যাতে নিজ মাতৃভাষা শেখার ও চর্চা করার সুযোগ পায়, তা নিশ্চিত করতে সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।’
ভাষা বিভাজন
২০১৯ সালে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন, ২০১০’ এর গেজেটে সরকার ৫০টি নৃ-গোষ্ঠীকে তালিকাভুক্ত করে।
আইএমএলআইর সমীক্ষায় দেখে গেছে, বাংলা ও উর্দুর পাশাপাশি এসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো তাদের মাতৃভাষা হিসেবে ৩৯টি ভাষায় কথা বলে।
ওই ভাষাগুলো হলো— বম, চাক, চাকমা, মান্দি (গারো), হাজং, কোল, খাসি, খাড়িয়া, কোচ, মুণ্ডা, খিয়াং, খুমি, মারমা, মণিপুরি (মৈতৈ), মণিপুরি (বিষ্ণুপ্রিয়া), লুসাই, ম্রো, অহমিয়া, কানপুরী, মাহলে, কুরুখ, মালতো, কন্দ, থর, লালেং (পাত্র), পাংখোয়া, রাখাইন, সাঁওতালি, সৌরা, মাদ্রাজি, তেলেগু, তঞ্চঙ্গ্যা, ককবরক, নেপালি (গুরখা), রেংমিত্চা, কোডা, লিঙ্গম, ওড়িয়া ও সাদরি।
ভাষাতাত্ত্বিক ওই সমীক্ষায়র তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে কথিত ৪১টি ভাষার মধ্যে কেবল আটটির নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। সেগুলো হলো— বাংলা, চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, লাখাইনম ম্রো, মণিপুরি ও অহমিয়া।
ককবরক, মাণ্ডি ও বমসহ কিছু ভাষার নিজস্ব কোনো বর্ণমালা না থাকলেও তারা বাংলা বা রোমান স্ক্রিপ্ট ব্যবহার করে থাকে।
জনপ্রিয় মঞ্চনাটক পরিচালক ও লেখক, মণিপুরি (বিষ্ণুপ্রিয়া) সম্প্রদায়ের সুভাষিশ সিনহা বলেন, তাদের বর্ণমালা হারিয়ে গেছে।
‘আমরা এখন বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করে মণিপুরি লিখি’, যোগ করেন তিনি।
বম, চাক, চাকমা, মারমা, খুমি, ম্রো, রেংমিত্চা, পাংখোয়া, খিয়াং, লুসাই, তঞ্চঙ্গ্যা, ককবরক ও নেপালি (গুরখা) ভাষাভাষীদের বেশিরভাগই চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে বাস করে। কিছুসংখ্যক রয়েছেন কক্সবাজার অঞ্চলেও।
নেপালি ভাষাভাষী কেবল কিছুসংখ্যক লোক বান্দরবান ও সিলেট চা-বাগান এলাকায় বসবাস করেন। ধারণা করা হয়, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ সৈন্যদের সঙ্গেই তারা চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে এসেছিলেন।
ইয়ংগুয়ং নামে ম্রো সম্প্রদায়ের এক লেখক বলেন, বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার ক্রাংশি পাড়ায় বসবাসরত কিছু ম্রো সম্প্রদায়ের মানুষ রেংমিত্চা ভাষায় কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘কেবল কিছুসংখ্যক লোক এখনো রেংমিত্চা ভাষায় কথা বলেন। যদিও তারাও ম্রো সম্প্রদায়েই লোক, তবে, আমরা তাদের ভাষা বুঝি না। এটি একটি আলাদা ভাষা।’
সিলেটের চা-বাগানের শ্রমিকরা মুণ্ডা, অহমিয়া, মাহলে, কুরুখ, কানপুরী, সাঁওতালি, মাদ্রাজি, তেলেগু, ওড়িয়া, মালতো, সৌরা, সাদরি, গুরখা ও ভোজপুরিসহ একাধিক ভাষায় কথা বলে থাকেন।
সিলেটে বসবাসরতদের ব্যবহৃত আরও অন্যান্য ভাষাগুলো হলো— খাসি, মণিপুরি (মৈতৈ), মণিপুরি (বিষ্ণুপ্রিয়া) ও লালেং (পাত্র)।
মান্দি (গারো) ও হাজং মূলত বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে বসবাসকারী নৃ-গোষ্ঠীর লোকেরা ব্যবহার করে থাকে। কোচ ও লিঙ্গম ভাষাভাষী কিছুসংখ্যক লোকও এই অঞ্চলে বসবাস করেন।
সাঁওতাল, কোল, কোডা ও মুণ্ডা ভাষাভাষীদের বেশিরভাগই দেশের উত্তরাঞ্চলে বসবাস করেন। কিছুসংখ্যক রয়েছে সিলেটেও। মুণ্ডা সম্প্রদায়ের কিছুসংখ্যক বাস করেন সুন্দরবন এলাকার কাছেই। আর বেদে সম্প্রদায়ের লোকেরা কথা বলেন থর ভাষায়।
রাখাইন ভাষাভাষী লোকেরা বসবাস করেন কক্সবাজার এবং বগুড়া ও বরিশালে।
২০১০ সালে ইউনেসকো কর্তৃক প্রকাশিত ‘অ্যাটলাস অব দ্য ওয়ার্ল্ডস ল্যাংগুয়েজ ইন ডেঞ্জার’ শীর্ষক বইয়ে প্রায় আড়াই হাজার বিপন্ন ভাষার একটি তালিকা আছে। চলতি শতাব্দীর শেষে এই সংখ্যা তিন হাজারে গিয়ে পৌঁছাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছেন গবেষকরা।
Comments