মানভূম আন্দোলন: ভাষার লড়াই, গানের প্রতিরোধ
আমার বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা রে।
(ও ভাই) মারবি তোরা কে তারে।।
বাংলা ভাষা রে।।
এই ভাষাতে কাজ চলেছে
সাত পুরুষের আমলে।
এই ভাষাতেই মায়ের কোলে
মুখ ফুটেছে মা বলে।।
এটি একটি টুসু গান। ঝুমুর ও ভাদু গানের মতোই টুসু পুরুলিয়ার লোকসংগীত। বাংলা পঞ্জিকায় পৌষ মাসের শেষ দিন মকর সংক্রান্তির পুরো রাত ধরে টুসু গান গাওয়া হয়।
অন্যান্য অনেক লোকগানের মতোই টুসু সংগীত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাহিত হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মূল গীতিকার বা সুরকার অজানা থেকে যায়।
তবে ১৯৪০ এর দশকের শেষভাগ থেকে ১৯৫০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, তৎকালীন মানভূম— বর্তমান পুরুলিয়া— এমন কিছু টুসুর গানের জন্ম দিয়েছিল যেগুলোর বিষয়বস্তু ছিল সম্পূর্ণ আলাদা।
রাজনৈতিক-সামাজিক বক্তব্য তুলে ধরা ছাড়াও সেই গানগুলো ভাষা দিয়েছিল একটি আন্দোলনকে। লেখার শুরুতে দেওয়া হলো তেমনি একটা গান। এর গীতিকার অরুণ চন্দ্র ঘোষ।
আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হলেও মানভূমে ছিল উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালি যারা বরাবরই নিজ ভাষা ও সংস্কৃতিকে লালন ও চর্চা করেছেন। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর লোকেরাও সেখানে বাংলা ভাষায় কথা বলেন।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর মানভূমকে বিহার রাজ্যের অধীনে আনা হয়। মানভূম এর আগে ছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অংশ।
বিহার রাজ্যে অন্তর্ভুক্তি মানভূমের বাঙালিদের জন্য ছিল অভিশাপ। তাদের মাতৃভাষা ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, বাঙালি অফিসাদের গণহারে অন্যান্য জেলায় বদলি হয়ে যায়। রুল জারি হয় প্রাথমিক শ্রেণি থেকেই হিন্দি পড়াতে হবে। এ দিকে স্থানীয় জিলা স্কুলে বাংলা বিভাগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্কুল ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নোটিশ বোর্ডের জন্য হিন্দি বাধ্যতামূলক করা হয়।
হিন্দিকে করা হয় মানভূম জেলার সরকারি ভাষা।
ঠিক যেমন তৎকালীন পূর্ব বাংলার জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করার অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি, মানভূমেও তেমনি অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠে খুব স্বাভাবিকভাবেই।
১৯৪৮ সালের ১৪ জুন গায়ের জোরে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য গঠিত হয় লোকসেবক সংঘ।
বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন আকারে শুরু হয় বিক্ষোভ আর প্রতিরোধ। এটি একই সঙ্গে ছিল একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব, একটি রাজনৈতিক লড়াই ও নিপীড়ণবিরোধী সামাজিক আন্দোলন।
অবশ্যই এটি ছিল একটি ভাষা আন্দোলন। নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসাই ছিল এর কেন্দ্রে।
এই আন্দোলনের একটা বড় হাতিয়ার ছিল গান, বিশেষ করে টুসু গান। মানভুমের প্রতিটা কোনায় টুসু গান ধ্বনিত হতো আন্দোলনের শক্তি বাড়াতে আর আন্দোলনের কথা বলতে।
ঠিক যেমন ১৯৫২ থেকে শুরু করে আমাদের সব লড়াই-সংগ্রামে অজস্র গান জুগিয়েছে অশেষ আশা-উদ্দীপনা আর সাহস।
‘টুসু গানে মানভূম’ বইটা তখনকার সময়ের অত্যন্ত দারুণ একটা প্রকাশনা ছিল। এর এক লাখ কপি দ্রুতই বিক্রি হয়েছিল।
ভজহরি মাহাতোর একটা গানের কথা না বললেই নয়—
শুন বিহারী ভাই
তোরা রাখতে নারবি ডাঙ্গ দেখাই।
(তোরা) আপন স্বার্থে ভেদ বাড়ালি
বাংলা ভাষায় দিলি ছাই।
ভাইকে ভুলে করলি বড়
বাংলা-বিহার বুদ্ধিটাই।।
বাঙালী বিহারী সবাই
এক ভাষাতে আপন ভাই।
এই গানগুলোর জন্য কিনা জানি না, এই আন্দোলন পরিচিতি পায় টুসু সত্যাগ্রহ নামে।
আন্দোলন যখন তুঙ্গে, বিহার রাজ্য সরকার শুরু করে চরম দমনপীড়ন। ১৯৫৪ সালটি ছিল আন্দোলনের কর্মীদের জন্য ভয়াবহতম বছর। নির্যাতন ও গ্রেপ্তার নিত্যদিনের বিষয় ছিল। সমাবেশ ছিল নিষিদ্ধ। কিন্তু, আন্দোলন কখনো থামেনি।
অবশেষে, কেন্দ্রীয় সরকার ‘রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন’ গঠনের ঘোষণা দেয়। ১৯৫৫ সালে কমিশন বাংলাভাষী অধ্যুষিত একটি নতুন জেলা ‘পুরুলিয়া’ গঠনের প্রস্তাব করে, সেই সঙ্গে প্রস্তাব করে তা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে।
এর প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। বিহারপন্থি নেতাকর্মীরা ১৯৫৬ সালের ১৭ থেকে ২০ জুন মানভূমে ধর্মঘট ডাকে। ধনবাদ জেলাকে বিহারে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করা হয় বলে ভাষা আন্দোলনকারীরাও খুব খুশি হননি।
এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিংহ পশ্চিমবঙ্গকে বিহারের সঙ্গে একত্রীকরণের প্রস্তাব দেন।
এর প্রতিবাদে লোকসেবক সংঘ ১৯৫৬ সালের ২০ এপ্রিল পাকবিড়রা গ্রাম থেকে কোলকাতার উদ্দেশে এক ইতিহাস-খ্যাত পদযাত্রা শুরু করেন। মে মাসের ৭ তারিখে পশ্চিমবঙ্গে পৌঁছানো মাত্রই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
এক পর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গকে বিহারের সঙ্গে একত্রীকরণের প্রস্তাব প্রত্যাহার করা হয়।
‘বেঙ্গল-বিহার সীমানা চিহ্নিতকরণ’ বিলটি ১৯৫৬ সালের ১৭ আগস্ট লোকসভায় ও ১৯৫৬ সালের ২৮ আগস্ট রাজ্যসভায় পাস হয়।
অবশেষে একটি থানা, ২,০০৭ বর্গমাইল এলাকা ও ১১ লাখ ৯৯ হাজার ৯৭ জনসংখ্যার সমন্বয়ে নব-গঠিত পুরুলিয়া জেলাকে সেই বছরের ১ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এই আন্দোলনসহ ইতিহাসের নানা বাঁকে ঘটে যাওয়া মানুষের এরকম জাগরণ আর প্রতিরোধ গাঁথা ঘুরে ফিরে জানান দেয় নিজ নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রশ্নে আপোস চলে না।
১৯৫২ সালেও আমরাও তা প্রমাণ করেছি রক্ত দিয়ে। দেশে বা দেশের বাইরের সব জাতিগোষ্ঠীর লড়াইকেও তাই আমাদের বুঝতে হবে, জানতে হবে। সবার ভাষা-সংস্কৃতির প্রতিও থাকতে হবে পূর্ণ সম্মান।
তথ্যসূত্র: পুরুলিয়া জেলা পরিচিতি, ড. শান্তি সিংহ’র প্রবন্ধ, ভারতীয় পত্রিকা ও ওয়েব পোর্টাল
Comments