মূল্যবোধের অবক্ষয়ে সংক্রমিত উপাচার্যের চেয়ারও

অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী, অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল ও অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন। (বাম দিক থেকে)

• মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রমিত হয়েছে, সংক্রমিত হয়েছে উপাচার্যের চেয়ারও: অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী

• রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যে কাণ্ডটা করেছেন, একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমি লজ্জিত। রাবি উপাচার্য তো একেবারে নিয়মবহির্ভূত কাজ করেছেন: অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম

• উপাচার্য মানে রাজা না। উপাচার্য মানে স্বেচ্ছাচারিতা না। এত বড় একটা পদের গুরুত্ব-মর্যাদা যারা বুঝতে পারেন না, তারা কীভাবে উপাচার্যের পদে থাকবেন: অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল

• আমাদের নীতি-নির্ধারক, সরকার বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়টি বোঝেনই না: অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন

‘উপাচার্যরা রাজা, উপাচার্যরা জমিদার’, কথাগুলো কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনায় এসেছে। উপাচার্যদের আচরণ যদি হয় রাজা বা জমিদারের মতো, তবে কি তারা প্রজার মতো দেখছেন শিক্ষার্থীদের? কেন এমন আলোচনা, কী ঘটছে সেখানে? কেন ঘটছে?

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) ভিসির বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে না যাওয়ার অভিযোগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে (খুবি) শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবির সঙ্গে সংহতি প্রকাশের অপরাধে এক শিক্ষককে বরখাস্ত ও দুই শিক্ষককে অপসারণ কিংবা রাবি উপাচার্য কর্তৃক ছাত্রলীগকে চাকরি দিতে ‘সর্বোচ্চ’ অগ্রাধিকারের আশ্বাসের খবর সবারই জানা।

কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতি-অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়গুলো নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক উপাচার্য ও ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, আইন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল ও একই বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জনের সঙ্গে।

অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, খুবি কিংবা রাবি, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটছে, নির্দিষ্ট ঘটনার বিস্তারিত না জেনে সেগুলো সম্পর্কে আমি বলতে পারব না। কিন্তু, সামগ্রিকভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশৃঙ্খলা এড়ানোর বিষয়ে আমি বলতে পারব। সেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগ যে পদ্ধতিতে দেওয়া হয়, সেখানে কোনো সিনেট নেই। সুতরাং ভোটের বিষয় নেই। সরাসরি সরকারের পক্ষ থেকে রিকমেন্ড করে পাঠায়। পর চ্যান্সেলর নিয়োগ দেন। এই নিয়োগ পদ্ধতিকে কার্যকর বা অকার্যকর বলব না। কিন্তু, আমার কাছে মনে হয়, প্রজ্ঞাবান, সিনিয়র শিক্ষক, যারা ন্যায়বিচারসম্পন্ন, যারা বিশেষ পণ্ডিত, অভিজ্ঞতা আছে, তাদের নিয়ে একটা বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি করতে পারে। এবং যদি সেই প্যানেলের মাধ্যমে ভিসি, প্রো-ভিসি ও রেজিস্ট্রার নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে পদ্ধতিটা আরও সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য হতো। একইসঙ্গে যারা নিয়োগ পেতেন, তারাও সম্মানিত বোধ করতেন।’

‘সরকারই পছন্দ অনুযায়ী নিয়োগ দেবে, আমি বলছি না সেখানে দলীয়করণটা বাদ দেওয়া যাবে। কিন্তু, বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মাধ্যমে করলে কিছু ভুল-ত্রুটি থাকলে সেগুলো শুধরে আসবে। সেজন্য ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমার মনে হয়, এটা করা উচিত। ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের আইনি সক্ষমতা, জনবল ও কার্যক্ষমতা অনেক বেশি। আমি যখন আমাদের ইউজিসির চেয়ারম্যান ছিলাম চার বছর, চেষ্টা করেছিলাম উচ্চশিক্ষা কমিশন করার জন্য। আমি ইউজিসিকে বাদ দেওয়ার কথা নয়, চেয়েছিলাম ইউজিসিকে সক্ষমতা দিলে তারা উচ্চশিক্ষার সব কার্যক্রম তদারকি করত। সেখানেও তাদের একটা কাজ হতে পারত, যা এখনো করা যায়, যারা শিক্ষা-গবেষণায় অন্যান্যদের চেয়ে উচ্চস্থানে রয়েছেন, যারা পড়াশোনায়-প্রশাসনিক দক্ষতা-সামাজিক অবস্থানে ভালো, তাদের নিয়ে একটা প্যানেল করা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে সেই প্যানেল বাছাই করে তিন জনের নাম সরকারের কাছে প্রস্তাব করবে। পরে সরকার সেখান থেকে বেছে তাদের পছন্দের লোকটাকে নিতে পারে। এতে একটা স্ক্রুটিনি হয়। এই স্ক্রুটিনি হওয়াতে অনেক দুর্বলতা থাকলেও সক্ষমতার জায়গাগুলো আগে আসে। আমি যে উচ্চশিক্ষা কমিশন করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম, সেটা বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে একটা কারণ হলো, আমলাতন্ত্র তা চায়নি। আমলাতন্ত্র চায়নি যে, তাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কিছু দেখভাল করার ক্ষমতা উচ্চশিক্ষা কমিশনে যাক। কিন্তু, সেখানে গেলে সমস্যা কী আছে? সেই কমিশনও তো সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই কাজ করত’, বলেন তিনি।

আপনি যখন ঢাবির ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তখন ঢাবির পরিস্থিতি অনেকটা উত্তাল ছিল। রাজনীতি, সন্ত্রাস, ছাত্র সংগঠনগুলো মধ্যে মারামারি লেগে ছিল। কিন্তু, সেই সময়ে ভিসিদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ উঠেনি। অথচ সেই তুলনায় বর্তমানে পরিস্থিতি ভালো হওয়া সত্ত্বেও ভিসিদের বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ আসছে। এর কারণ কী বলে মনে করেন?, জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘আমার মনে হয়, সমাজে তখন পরিস্থিতি উত্তাল হলেও মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়নি। গোলাগুলি হয়েছে, কিন্তু মূল্যবোধের অবক্ষয় মারাত্মক জিনিস। এখন যে অবস্থা, যার যে ক্ষমতা আছে, তা ব্যবহার করা। অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতার লোভে যা কিছুকেই প্রশ্রয় দেওয়া এখন সমাজের রোগ হয়ে গেছে। এ সমাজের প্রত্যেকেই অনিশ্চয়তার ভেতরে থাকে এবং নিশ্চয়তাহীন জীবনে মনে করে যে, টাকা বেশি হলেই বোধহয় নিশ্চয়তা হবে। মনে করে, ক্ষমতা আরেকটু বেশি হলে বোধহয় নিশ্চয়তা হবে। এই যে মূল্যবোধের অবক্ষয়, এটাই সমাজকে শেষ করেছে। সারাবিশ্বেই মূল্যবোধের অবনতি হয়েছে। তবে, বাংলাদেশে বেশি হয়েছে। মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রমিত হয়েছে, সংক্রমিত হয়েছে উপাচার্যের চেয়ারও।’

বেরোবির ঘটনার বিষয়ে অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, ‘প্রথমেই বলতে চাচ্ছি, বাংলাদেশে যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, সেখানে যদি আমি ভিসির দায়িত্ব পাই বা আমি যদি নিতে আগ্রহী হই বা যদি আমাকে অফার করা হয়, তাহলে প্রথম শর্ত হচ্ছে, আমাকে মেনে নিতে হবে যে, আমাকে সেখানে থাকতে হবে। আমি জানি অন্যান্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসিরা গিয়ে সেখানে থাকেন। যেমন: নোয়াখালী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসিরা সেখানেই থাকেন। এটা যদি জেনেই ভিসি হন, তাহলে তারা সেখানে থাকেনই। কিন্তু, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যে কাণ্ডটা করেছেন, একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমি এতে লজ্জিত। এটা একজন শিক্ষকের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়। আরও লক্ষণীয় যে, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন জন উপাচার্য, একজন তো দুর্নীতির দায়ে জেলে গিয়েছিলেন। আরেকজনকেও পুলিশি নিরাপত্তায় বাড়ি ফিরতে হয়েছে। আর তৃতীয় জনের কথা আমরা শুনলাম যে, তিনি পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। তার সম্পর্কে তো অনেক ধরনের বিষয় সামনে এসেছে, শিক্ষকরা নিয়ে এসেছেন। এক্ষেত্রে ইউজিসি পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সেখানে তদন্ত হয়েছে। কিন্তু, মন্ত্রণালয় নীরব থেকেছে। এর কারণ আমরা বুঝি না। যখন তারা দেখেন যে, একজন উপাচার্য যিনি তার কাছ থেকে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছেন, সেখানে যদি (শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের) কোনো হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকে, তা করা প্রয়োজন।’

খুবির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘খুবির যিনি উপাচার্য, তার নিয়োগের সময়সীমা প্রায় শেষ। এখানে শিক্ষার্থীদের যে দাবিগুলো ছিল, তারা দ্বিতীয় পরীক্ষক চায়, আবাসন চায়, সেই দাবি-দাওয়া প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে যদি তারা কোনোভাবে শিক্ষকদের মানহানি করে থাকে, তাহলে সেটার সঠিক একটা তদন্ত হওয়া উচিত বলে মনে করি। পক্ষপাতমূলক না, একটা সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। আমি তিন দশক ধরে শিক্ষকতা করছি। আমি জানি যে, যৌন হয়রানির জন্য চাকরি গেছে, চৌর্যবৃত্তির জন্য চাকরি গেছে। কিন্তু, এ ধরনের ঘটনা আমাদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার জন্ম দিচ্ছে যে, একটা সিন্ডিকেট যারা সিলেক্টেড হয়ে এসে থাকেন, তারা এরকম একটা সিদ্ধান্ত দিলেন, যেটাতে পুরো জাতিই বিচলিত হয়ে পড়েছে। যদি শিক্ষকরা কিছু করে থাকেন, তাহলে তদন্তের মাধ্যমে তাদেরকে প্রশ্ন করা যায়, অভিযোগ প্রমাণিত হলে মাইনর শাস্তির দিকে যাওয়া যায়। কিন্তু, এখানে দেখা গেল একেবারে বহিষ্কার করে বের করে দেওয়া। ঢাবিতেও যখন নকল ধরা পড়ে, আমরা সেটা ডিসিপ্লিনারি কমিটিতে নিয়ে আসি, পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সেটা নিয়ে আলোচনা করি, মানবিক দিক বিবেচনা করি। কিন্তু, খুবিতে যেটা করা হলো, এর মধ্যে একজন শিক্ষক কিন্তু মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আছেন। তিনি তো ঘটনাস্থলেই নেই। তিনি এমন কী কাণ্ড করলেন যে তাকে চাকরি থেকে বিদায় করে দেওয়া হবে? আমি মনে করি তাদের সঙ্গে আরও আলোচনা করা উচিত এবং বস্তুনিষ্ঠভাবে এ ঘটনার নিষ্পত্তি হওয়া উচিত।’

রাবির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘রাবির যিনি ভিসি, তিনিও দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু, আমার কাছে যেটা মনে হয়, উপাচার্যদেরও একটা মূল্যায়ন প্রয়োজন। রাবির ভিসি কিন্তু কোনো সিনেটে নির্বাচিত হননি। সেখানে কোনো সিনেট হয়নি, যদিও সেটা হওয়া প্রয়োজন। দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি শুধু এক্সটেনশন পেয়েছেন। কিন্তু, আমাদের ঢাবিতে প্রথম মেয়াদের পরে সিনেট ভোটে তাকে দ্বিতীয় মেয়াদের বিষয়টি জায়েজ করে নিতে হয়। এবং কেউ সর্বোচ্চ ভোট পেলেই ভিসি হয়ে যাবেন, তা নয়। কারণ, এরপর সরকারের মূল্যায়ন করার একটা জায়গা থাকে যে, তিনি স্বজনপ্রীতি কতটুকু করেছেন, রিজিওনালিজম কতটুকু করেছেন। আমি লক্ষ্য করছি, কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রিজিওনালিজম ঢুকে যাচ্ছে। যেমন: আমি যদি কুমিল্লার হই, তাহলে কুমিল্লার মানুষকে চাকরি দেবো; নোয়াখালীর হলে নোয়াখালীর মানুষকে চাকরি দেবো। এটাই একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ভেঙে দেয় এবং এটা অন্যান্য শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি করে। রাবি উপাচার্য তো একেবারে নিয়মবহির্ভূত কাজ করেছেন। সিজিপিএ ক্রাইটেরিয়া পরিবর্তন করে মেয়ে ও জামাতাকে নিয়োগ দিয়েছেন। ইউজিসি এই ঘটনায় তাকে নির্দেশনা দেওয়ার পরেও তিনি সেটা অমান্য করছেন। আমি জানি না এখন তারা কার নির্দেশনার জন্য বসে আছেন। ইউজিসিকে যতটুকু ক্ষমতা সরকার দিয়েছে, তারা সেই মোতাবেকও কাজ করতে পারছে না। অর্থাৎ, ইউজিসির সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রাবিতে কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।’

এরশাদ সরকারের ক্ষমতাকালীন পুলিশ কর্তৃক শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি-হামলা চালানোর প্রতিবাদে ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে পদত্যাগ করেছিলেন ঢাবির তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী। বর্তমানে তিনি ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। অর্থাৎ ভিসিদের এমন ইতিবাচক নজির আছে। আপনি অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরীর মেয়ে এবং নিজেও তিন দশক ধরে শিক্ষকতা করছেন। আজকে ভিসিরা যে নজির তৈরি করছেন, এ ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ কী আপনার কাছে?, জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, ‘তিনি (অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী) মনে করেছিলেন যে, আত্মসম্মান নিয়ে তার পক্ষে সেখানে আর টিকে থাকা সম্ভব নয়। আত্মসম্মানটা তার কাছে সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল। কারণ, তিনি আপাদমস্তক একজন শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকরা যখন প্রশাসনে যাবেন, তখন তাকে শিক্ষকসুলভ মনোভাবটাও রাখতে হবে। কিন্তু, বর্তমানে প্রত্যেকটা ক্ষেত্রের সঙ্গেই বৃহত্তর রাজনীতিকে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে, হচ্ছে। আমিও নীল দল করি। কিন্তু, সবার আগে তো আমি একজন শিক্ষক। সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের ডিন হিসেবে আমি যদি ভাবি, সাদা দলকে কম দেবো, নীল দলকে বেশি দেবো, এটাতো হবে না। সবাই আমার শিক্ষক। সেক্ষেত্রে ন্যায্যতা আমাকে দিতে হবে। যখন শিক্ষকসুলভ মনোভাব হারিয়ে যায় এবং বৃহৎ রাজনীতির দিকে বেশি ঝুঁকে যায়, তখন কোনো প্রশাসনের পক্ষেই নিরপেক্ষ বা কিছুটা নিরপেক্ষ হওয়াটা দায় হয়।’

‘আরেকটা বিষয় বলব, আমি কিন্তু ঢাবিতে কখনো দেখিনি যে, রাজনীতিবিদরা এসে আমাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করছেন। কোনো সংসদ সদস্য কিন্তু আমাকে ফোন দিয়ে বলেননি যে, আপনি এটা করে দেন। আমি ২০০৪ সাল থেকে নিয়মিত নিয়োগের সিলেকশন কমিটিতে বসছি। আমি এ ধরনের কোনো ফোন পাইনি। আমরা যে দোহাই দেই, আমি যদি উনাদেরকে খুশি না করি, তাহলে থাকতে পারব না, এটা সবসময় ঠিক না। তারা তো অবশ্যই রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে উপাচার্য হয়ে এসেছেন। কিন্তু, এখন তো তাদেরকে সেই স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে যে, আপনারা সুন্দর মতো চালান। কিন্তু, আমি বসে যদি এখানে রিজিওনালিজম করি, আত্মীয়-স্বজনদের চাকরি দিতে শুরু করি, যিনি ভালো লেখাপড়া করেন, সেই শিক্ষককে দাবায়ে রাখি, তখন তো এরকম পরিস্থিতি তৈরি হবে। সরকারের তো কাজ না যে এগুলো এসে দেখবে। সরকার তো ভিসিকে দায়িত্ব দিয়েছেনই সুষ্ঠুমতো এগুলো পরিচালনা করতে। কিন্তু, এখনকার উপাচার্যরা সেইদিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছেন। ক্ষমতা পেয়ে তারা মনে করেন যে, তারা রাজা হয়ে গেছেন। ফলে এ ধরনের অন্যায়-অপকর্ম বাড়ছে’, যোগ করেন তিনি।

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমাদের ভিসিদের ছোটখাটো বিচ্যুতি এর আগেও দুয়েকটা ক্ষেত্রে ছিল। কিন্তু, এত ব্যাপক মাত্রায়, যে একজন ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেনই না, যা ইচ্ছা তাই করছেন, ইচ্ছামতো বহিষ্কার করছেন, স্বৈরাচারের মতো আচরণ করছেন, এটা আমরা আগে দেখিনি। আমার কাছে মনে হয়, আমাদের দলীয় রাজনীতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, ভিসিরা হয়তো ভাবেন, তারা দলগতভাবে অত্যন্ত অনুগত থাকলে যা ইচ্ছা তা করতে পারবেন। এটার প্রকাশ আমরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখছি, সবক্ষেত্রে না। তারা দলীয় আনুগত্য বজায় রেখে স্বেচ্ছাচারিতা করার লাইসেন্স পেয়ে গেছেন বলে মনে করছেন। এখন এটার তো রাশ টেনে ধরতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় আছে, চ্যান্সেলরের অফিস আছে, তারা যদি এসব বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাহলে পরিশেষে এ ধরনের স্বৈরাচারিতা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, এগুলোকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। অবশ্যই তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।’

‘এখানে আরেকটা বিষয় হলো, প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহির বাইরে একটা অপ্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিও ছিল উপাচার্যদের। সেটা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-ছাত্রদের ভিন্ন মত প্রকাশ করার অধিকার, আন্দোলন করার অধিকার। এখন সার্বিকভাবে দেশে আন্দোলন করার, ভিন্নমত পোষণ করার, সমালোচনা করার অধিকার এত সংকুচিত হয়ে গেছে যে, উপাচার্যরা এখানেও এক ধরনের প্রশ্রয় বা দায়মুক্তি অনুভব করেন যে, আমাদেরকে কেউ কিছু বলবে না। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা এসব করছেন, শিক্ষক-ছাত্রদের অবশ্যই নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। একইসঙ্গে মূল দায়িত্বটা সরকারের। এত সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে, এত কিছু হচ্ছে, এরপরেও যদি সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে একটি বার্তাই যায় যে, উপাচার্যরা দলীয়গতভাবে অনুগত থেকে যা ইচ্ছা করতে পারবে। যদি সরকার এই বার্তা দিতে থাকে, তাহলে তো এরকম ঘটতেই থাকবে। সরকার যদি এ বার্তা দেওয়া বন্ধ করতে চায়, তাহলে অবিলম্বে এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে’, বলেন তিনি।

অন্যথায় এ ধরনের কর্মকাণ্ড ভবিষ্যতে আরও বাড়বে বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ‘পৃথিবীতে একটা কথাই আছে যে, যখন দায়বদ্ধতা থাকে না, তখন মানুষ অতিরিক্ত স্বৈরাচারী হয়ে যায়, অতিরিক্ত স্বৈরাচারী আচরণ করে। এটা তো সারা পৃথিবীতে সমাজ-অপরাধ বিজ্ঞানে প্রচলিত সত্য। দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। উপাচার্য মানে রাজা না। উপাচার্য মানে স্বেচ্ছাচারিতা না। এত বড় একটা পদের গুরুত্ব-মর্যাদা যারা বুঝতে পারেন না, তারা কীভাবে উপাচার্যের পদে থাকবেন?’

অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এত ছাত্র-শিক্ষক থাকলে কিছু সমস্যা থাকবেই। একদম নির্বিঘ্ন চলবে, সেটা তো সম্ভব না। কিছু সমস্যা, কিছু প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হতেই পারে। কিন্তু, বিষয়টি সেটা না। বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পদবাচ্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কি আছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ তো পড়াশোনা আর গবেষণা। সেই কাজটা কি হচ্ছে? বিশ্ববিদ্যালয়কে চিহ্নিত করা হবে কী দিয়ে? এখানে দেখতে হবে, সেখানে মানসম্পন্ন পড়াশোনা হচ্ছে কি না। দ্বিতীয়ত, সেখানে গবেষণার কাজ ও পাবলিকেশন ঠিকমতো চলছে কি না। এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই যদি ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকে, উপাচার্যের নিয়োগ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাহলে তো সেটা বিশ্ববিদ্যালয় হলো না। আমাদের এখানে আসলে নীতি-নির্ধারক, সরকার, তারা বিশ্ববিদ্যালয় বোঝেনই না।’

‘বিশ্ববিদ্যালয় মানে দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ টিচিং না। মূল কাজ হচ্ছে নতুন জ্ঞান উৎপাদন করা। সেই মানদণ্ডে বিচার করতে হবে যে, কোন বিশ্ববিদ্যালয়টা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বড় অবদান। কিন্তু, সেটা আমরা নষ্ট করে ফেলছি। কিংবা ষাটের দশকের যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দীর্ঘদিন ধরে অবদান রাখছে, সেগুলোর অবস্থা কী? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, এগুলোর তো অনেক অবদান রয়েছে। কিন্তু, আমরা তো সেই জায়গাটা থেকে সরে যাচ্ছি’, বলেন তিনি।

একজন উপাচার্য দুর্নীতি করলে সেটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করেন অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন। তিনি বলেন, ‘একজন শিক্ষকের পড়াশোনা-গবেষণার পাশাপাশি আরেকটা বিষয় হচ্ছে তার চারিত্রিক শুদ্ধাচার। একজন শিক্ষক যদি দুর্নীতি করেন, তাহলে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব? এখন তো একজন না, অনেক উপাচার্যের দুর্নীতির খতিয়ান আমরা পাচ্ছি। সেটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এখানে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের খুবই সতর্ক হওয়া উচিত। শুধু যে দলীয় উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, এখানেও একটা কোটারি। কিছু দলীয় নেতা যারা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব বা অতিরিক্ত সচিব, তাদের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে, সেই কোটায় তাকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু, উপাচার্য নিয়োগে তো একটা নির্দিষ্ট মানদণ্ড থাকবে, তার শিক্ষাগত ক্যারিয়ার, গবেষণা, কতদিন শিক্ষকতা করছেন, পাণ্ডিত্য, প্রশাসনিক দক্ষতা, গবেষণায় অবদান, কোনো ধরনের অসততা বা দুর্নীতির কিছু আছে কি না। আবার দুর্নীতির রেকর্ড ছিল না, কিন্তু উপাচার্য হওয়ার পর করার অভিযোগ এলে তাৎক্ষণিক ইউজিসির মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া।’

‘এখন আমাদের এখানে বিশ্ববিদ্যালয় যে নিয়মে চলা উচিত, সেটা নেই। দ্বিতীয়ত, নিয়মের ভেতর যখন অসঙ্গতি-ত্রুটি থাকে, তখন তো সমস্যা হবেই। কিন্তু, সেগুলোকে সংশোধন বা প্রতিকার করার কোনো ব্যবস্থা প্রতীয়মান হচ্ছে না। গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ভিসি দুর্নীতির অভিযোগে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করলেন, তাকে দ্বিতীয় মেয়াদে কেন নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল? তার বিরুদ্ধে তো অনেক অভিযোগ ছিল। প্রচণ্ড ছাত্র আন্দোলনের পর তার বিরুদ্ধে তদন্ত করা হলো। আন্দোলনের চাপ না থাকলে তো তার বিরুদ্ধে তদন্তটাও হতো না। দেখা গেল, দুর্নীতি করে তিনি শত কোটি টাকার মালিক। কাজেই নিয়মের ভেতর তো এটা থাকতে হবে যে, কেউ যাতে দুর্নীতি করতে না পারে। করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে, তাকে সরিয়ে দেওয়া যাবে’, বলেন তিনি।

সবশেষে অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ‘প্রত্যেকটা জায়গাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশটা কিন্তু সেভাবে নেই। সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আর উপাচার্য-শিক্ষক নিয়োগ, গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ, এসব জায়গাগুলো ঠিক না করলে তো বিশ্ববিদ্যালয় হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় যে বলা হবে, বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার যে পূর্বশর্ত, সেটা কয়টা বিশ্ববিদ্যালয় পূরণ করছে? সেটা আমরা যারা শিক্ষক তাদের কিছুটা দায় আছে। কিন্তু, বড় দায়টা রাষ্ট্রের, সরকারের। কারণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডিং থেকে শুরু করে উপাচার্য নিয়োগ, সবকিছু তারা নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং তাদের সদিচ্ছা না থাকলে তো এখানে বিশ্ববিদ্যালয় হবে না।’

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

7h ago