বছরের আলোচিত চরিত্র: করোনার প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্প আর দুর্নীতি

করোনাভাইরাস অতি ক্ষুদ্র। অতি ক্ষুদ্র মানে কত ক্ষুদ্র? এক ডোজ করোনা ভ্যাকসিনে মানে একটি টিকা যখন আপনি নেবেন, আপনার শরীরে প্রবেশ করবে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ভাইরাস! দুই ডোজ বা সম্পূর্ণ একটি ভ্যাকসিনে ভেতরে আছে ১০০ বিলিয়ন ভাইরাস। করোনাভাইরাসের ক্ষুদ্রতা সম্পর্কে নিশ্চয়ই কিছুটা ধারণা করতে পারছি। চলে যাওয়া বছরের আলোচিত চরিত্রের শীর্ষ স্থানটি দখলের ক্ষেত্রে এই অতি ক্ষুদ্র করোনাভাইরাসের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না।

পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত, ধনী-গরিব নির্বিশেষে আতঙ্ক ছড়িয়ে আলোচনার এক নম্বর অবস্থানে নিজেকে অটুট রেখেছে করোনাভাইরাস। নতুন বছরেও করোনাভাইরাস তার অবস্থান ছাড়বে, এমন ইঙ্গিত দৃশ্যমান নয়। সহজে যে এক নম্বর আসন ছাড়বে না, বারবার রূপ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সেই জানানও দিয়েছে। নতুন রূপে আবির্ভূত হয়ে ৭০ শতাংশ বেশি সংক্রমণের সক্ষমতা অর্জন করে ভ্যাকসিন উৎপাদনকারীদের কপালেও ভাঁজ ফেলে দিয়েছে।

তবে করোনাভাইরাসের এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থান নিয়ে বেশ কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে মূলত দুটি দেশে। প্রথম দেশটি পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় দেশটির নাম বাংলাদেশ।

প্রথমে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অতি ক্ষুদ্র করোনাভাইরাসকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় স্থান দেওয়া তো দূরের কথা, ধর্তব্যের মধ্যেই আনতে চাননি। সর্দি-কাশি ছাড়া কিছু নয়, দুই সপ্তাহের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন করোনাভাইরাসকে। ট্রাম্প করোনার ভয়ে মাস্ক পরতে রাজি হননি। সমর্থকদেরও মাস্ক পরায় নিরুৎসাহিত করে বড় বড় নির্বাচনী জনসভা করেছেন। স্বাস্থ্যবিধি বা সামাজিক দূরত্ব মানেননি। স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শক-বিজ্ঞানীদের মধ্যে যারা বিজ্ঞানভিত্তিক কথা বলেছেন, তাদের কাউকে তিরস্কার করেছেন, কাউকে বহিষ্কার করেছেন। আলোচনার শীর্ষে অবস্থান করেছেন ট্রাম্প।

সেই সুযোগে রাজ্যের পর রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। সংক্রমণে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে আমেরিকানদের জনজীবন। তিন লাখেরও বেশি আমেরিকানের প্রাণ কেড়ে নিয়ে আলোচনার শীর্ষ অবস্থান থেকে ট্রাম্পকে হটিয়ে দিয়েছে অতি ক্ষুদ্র এই ভাইরাস।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও করোনাভাইরাসের সঙ্গে আলোচনায় থাকার প্রতিযোগিতায় শরিক হয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের সৌন্দর্য প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্ককে বিশৃঙ্খল রূপ দিয়ে আলোচনায় এসেছেন। পরাজিত হলেও ক্ষমতা ছাড়বেন না, সিদ্ধান্ত হবে আদালতে, নজিরবিহীন এমন মন্তব্য করে আলোচনায় থেকেছেন। আলোচনায় থেকেছেন তড়িঘড়ি করে সুপ্রিমকোর্টে নিজের অনুগত বিচারপতিকে নিয়োগ দিয়ে। মার্কিন জনগণের ভোটে পরাজিত হয়েও মানতে চাননি পরাজয়। একের পর এক আদালতে গেছেন, পরাজিত হয়েছেন। টুইটের বন্যা বইয়ে দাবি করে গেছেন ‘আমিই জিতেছি’। ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে পরাজয়ের পরও বলেই যাচ্ছেন ‘আমিই জিতেছি’। সব প্রক্রিয়ায় পরাজিত হয়েও একগুঁয়ে আচরণে তিনি এখনও আলোচনায়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায়ও করোনাভাইরাসের কাছে তিনি পরাজিত হয়েছেন। শীতে আরেকবার তাণ্ডব চালিয়ে আলোচনায় শীর্ষস্থান আরও পোক্ত করেছে করোনাভাইরাস।

এবার আসি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। ‘করোনাভাইরাস বাংলাদেশে আসবে না’ এমন নিশ্চয়তা দিয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন একজন বিশেষজ্ঞ। এই নিশ্চয়তাকে তোয়াক্কা না করে করোনাভাইরাস যখন আসব আসব করছিল, তখন আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ নেতা-মন্ত্রী ও সরকারি বিশেষজ্ঞরা নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন করোনা প্রতিরোধে ‘আমরা শতভাগ প্রস্তুত’। পৃথিবীর আর কোনো দেশের নেতা-মন্ত্রীরা এমন নিশ্চয়তা দিয়েছেন বলে জানা যায়নি। ‘ভ্যাকসিন আসার আগে বাংলাদেশ থেকে করোনাভাইরাস চলে যাবে’, ‘ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলে মাস্ক পরতে হবে না’, এমন বহু মন্তব্য করে আলোচনায় ছিলেন, আছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তবে পদমর্যাদায় এগিয়ে থাকা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ‘আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী’ সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আলোচিত বক্তব্য। এমন আরও বহু মন্তব্যকে চাপা দিয়ে আলোচনার শীর্ষস্থান দখলে রাখতে করোনাভাইরাসকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি।

দুর্নীতির সংবাদ বাংলাদেশে করোনাভাইরাসকে সবচেয়ে বড় রকমের চ্যালেঞ্জে ফেলে দেয়। বেশকিছু অভিনব দুর্নীতির সংবাদ বাংলাদেশে আলোচনার কেন্দ্রে অবস্থান নিয়ে নেয়। করোনাভাইরাস শীর্ষস্থান ধরে রাখতে পারবে কি না, আশঙ্কা তৈরি হয়। করোনার নমুনা পরীক্ষা না করেই করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট দিয়ে শাহেদ-সাবরিনারা আলোচনায় চলে আসে। এমন অনিয়ম-দুর্নীতি পৃথিবীর ধনী-গরিব আর কোনো দেশে ঘটেছে বলে জানা যায় না। শাহেদ-সাবরিনাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়েছিল স্বাস্থ্যমন্ত্রী, তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের উপস্থিতে। সেই ছবি প্রথমে সামাজিক মাধ্যমে, পরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে।

ভুয়া সনদের কারণে ইতালি বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানো হয়। ইতালির মূলধারার প্রায় সব গণমাধ্যমে সে সংবাদ ফলাও করে প্রচার হয়। আন্তর্জাতিক সংবাদে স্থান পেয়ে শাহেদ-সাবরিনারা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় করোনাভাইরাসকে পেছনে ফেলে বেশ এগিয়ে যায়। এন৯৫ মাস্কের নামে অত্যন্ত নিম্নমানের স্থানীয়ভাবে তৈরি মাস্ক সরবরাহ করে জেএমআই নামক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতি প্রিয় একটি প্রতিষ্ঠান। চীন থেকে পিপিইর নামে রেইনকোট আমদানিও আলোচনায় থাকে। পিপিই না পেয়ে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী মারা যেতে থাকেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শতকোটি টাকার মালিক ড্রাইভার মালেক চলে আসেন আলোচনায়।

ড. বিজন কুমার শীলের নেতৃত্বে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে প্রথম অ্যান্টিবডি এবং অ্যান্টিজেন র‍্যাপিড টেস্ট কিট উদ্ভাবনের ঘোষণা দেন। আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ড. বিজন কুমার শীলরা। তাদের কিটের শতভাগ সাফল্যের দাবি করে দ্রুত পরীক্ষা করে সরকারের থেকে অনুমোদন প্রত্যাশা করেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। অনুমোদন প্রক্রিয়া শুরু না করেই শুরু হয় এর বিরুদ্ধে প্রচারণা। সরকার সমর্থক চিকিৎসকদের কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, কেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রায় শতভাগ কার্যকারিতার দাবি করল? ‘বিদেশ থেকে করোনা আক্রান্তের রক্ত এনে ট্রায়াল করেছেন’ একথা বলায় তাদের কেউ কেউ টকশোতে এসে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিচার দাবি করেন।

একটি বড় মাপের ইতিবাচক সংবাদও কী করে নেতিবাচক সংবাদে পরিণত হতে পারে, তার এক অনন্য উদাহরণ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এই কিট। শেষ পর্যন্ত যা অনুমোদন পায়নি। ওয়ার্ক পারমিট আটকে যাওয়ায় সিঙ্গাপুরে চলে যেতে বাধ্য হন ড. বিজন।

এখন আলোচনায় ভ্যাকসিন। আমাদের মন্ত্রীদের বক্তব্য অনুযায়ী, ভারতের বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের ভ্যাকসিন পাওয়ার কথা। কীসের ভিত্তিতে তারা এই দাবি করছিলেন, তার কোনো ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভারত জানিয়ে দিয়েছে নিজের চাহিদা না মিটিয়ে তারা ভ্যাকসিন অন্য কোনো দেশকে দেবে না। তাহলে সেরামের সঙ্গে কী চুক্তি হয়েছিল বাংলাদেশের? বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীরা কি বেক্সিমকোর কথা অনুযায়ী বক্তব্য দিয়েছে, না নিজেরা সেরামের সঙ্গে কথা বলেছে? এমন সিদ্ধান্ত ভারত হুট করে নিয়েছে, তা হয়ত নয়। তারচেয়েও বড় প্রশ্ন ভ্যাকসিনের জন্য বাংলাদেশ একটি উৎসের উপর নির্ভর করে বসে ছিল। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ একাধিক ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে। বাংলাদেশ ফ্রি ভ্যাকসিন পাওয়ার যে আশা করছে, তাও বহু দূরের বিষয়। আলোচনা ছিল বাংলাদেশের ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনা নিয়ে। এখন আলোচনার বিষয় বাংলাদেশ আসলে কবে বা কত দেরিতে ভ্যাকসিন পাবে? এখন অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করলেও দ্রুত ভ্যাকসিন পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে চীনের ভ্যাকসিনের সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কূটনৈতিক কারণেই চীন হয়ত এগিয়ে আসতে পারে। কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ আছে ভারতের সঙ্গেও। চীন এগিয়ে আসলে ভারত নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বহাল রাখতে নাও পারে।

এরমধ্যে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইন। অদ্ভুত বিষয়, বাংলাদেশের কোনো আরটি-পিসিআরে নতুন স্ট্রেইন শনাক্তের সুযোগ নেই!

করোনাভাইরাস বাংলাদেশে পরীক্ষা কম, শনাক্তের সংখ্যা কম। প্রাণহানির সংখ্যাও কম। করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে দুর্নীতি বিস্তৃত। এখন ভ্যাকসিন পাওয়ার অনিশ্চয়তা। কোনো কোনো সময় করোনাভাইরাসের চেয়ে করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে সংগঠিত দুর্নীতি বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

তারপরও সবকিছু ছাপিয়ে বছরের আলোচিত চরিত্র করোনাভাইরাসই।

s.mortoza@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka sends diplomatic note to Delhi to send back Hasina: foreign adviser

The Ministry of Foreign Affairs has sent a diplomatic note to the Indian government to send back ousted former prime minister Sheikh Hasina to Dhaka.

4h ago