২০২০: ফুটবলেও বলার মতো কিছু গল্প ছিল
রাতের পর রাত আন্তর্জাতিক ফুটবল থাকবে না, কল্পনাতেও কি এনেছিল ক্রীড়াপ্রেমীরা? কিন্তু ২০২০ তো সব অসম্ভবের সম্ভব হওয়ার বছর! করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে স্থবির হয়ে গিয়েছিল গোটা দুনিয়া। ফুটবলেই বা কেন তার ব্যতিক্রম ঘটবে? ফুটবলপ্রেমীদের জন্য এ এক দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা। কিছুই যেন নেই আলোচনার, নেই রোমাঞ্চ, নেই উত্তেজনা! একঘেয়ে সব। যদিও মানুষের মৃত্যুর মিছিলের কাছে ফুটবল একেবারেই তুচ্ছ।
অথচ কী রোমাঞ্চকর হওয়ারই না কথা ছিল বছরটির! কিন্তু প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের ছোবলে সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ ও কোপা আমেরিকার মতো দুটি মহাদেশীয় লড়াই অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। একে একে পৃথিবীর সব দেশের লিগই হয়েছে স্থগিত। একেকটি রাত যায়, আর ফুটবলপ্রেমীদের ছটফটানি বাড়তে থাকে। কী যেন নেই, কী যেন নেই! অনেক না পাওয়ার মাঝেও শেষ পর্যন্ত লম্বা বিরতি পেরিয়ে ফুটবল মাঠে গড়িয়েছে। শঙ্কার মাঝে তড়িঘড়ি করে ফেরা হলেও আলোচনার খোরাকের কিন্তু খামতি ছিল না।
ফিরে তাকিয়ে দেখা যাক, কেমন ছিল ‘বদলে যাওয়া এই ২০২০-এর ফুটবল পৃথিবী’।
ইউরো ও কোপার সূচি বদল
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে চলতি বছর যে সকল আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ইভেন্ট হওয়ার কথা ছিল, তার সব কিছুই পিছিয়ে যায়। গত ১১ মার্চ করোনাভাইরাসকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা করার অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ ও কোপা আমেরিকা স্থগিত করা হয়। দুটি আসরই নতুন সূচিতে অনুষ্ঠিত হবে ২০২১ সালে।
মৌসুম শেষ না করেই চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
ফরাসি লিগ ওয়ান ছাড়া ইউরোপের শীর্ষ চারটি লিগই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কিছুটা কমলে ফের শুরু হয়ে মৌসুম শেষ করে। কিন্তু সে পথে হাঁটেনি ফরাসি লিগ কর্তৃপক্ষ। লিগ স্থগিত করার দেড় মাস না যেতেই গত ২৮ এপ্রিল জানা যায়, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফ্রান্সে সব ধরনের খেলাধুলা নিষিদ্ধ করেছে দেশটির সরকার। যে কারণে মাঝ পথেই মৌসুম বাতিল করে লিগ দা ফুটবল প্রফেশনাল (এলএফপি)। দুদিন পর লিগ টেবিলের শীর্ষে থাকা পিএসজিকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়। লিগ ওয়ানে যা পিএসজির টানা তৃতীয় ও সবমিলিয়ে নবম শিরোপা।
দর্শকহীন ফুটবল, বুন্ডেসলিগা দিয়ে শুরু
অনাকাঙ্ক্ষিত বিরতির ইতি টেনে ইউরোপের শীর্ষ লিগগুলোর মধ্যে সবার আগে মাঠে গড়ায় জার্মান বুন্ডেসলিগা। তবে দর্শকদের মাঠে ঢোকার অনুমতি ছিল না। অংশগ্রহণকারী দুদলের খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফ, মাঠের নিরাপত্তাকর্মী ও অন্যান্য যারা আছে, সবমিলিয়ে স্টেডিয়ামে সর্বোচ্চ ৩০০ জন ঢোকার অনুমতি মেলে।
পাঁচ বদলি খেলোয়াড়
করোনাভাইরাসের কারণে শুধু যে দর্শকদের মাঠে ঢোকার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আসে তা নয়, ফুটবলের নিয়মেও আসে ব্যাপক পরিবর্তন। তিন জনের জায়গায় বদলি খেলোয়াড় হিসেবে পাঁচ জন খেলোয়াড় নামানোর নিয়ম চালু করেছে ফিফা। অল্প সময়ে বেশি ম্যাচ থাকায় খেলোয়াড়দের ইনজুরি প্রবণতা কমাতে এই পদক্ষেপ নেয় ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। যা পরবর্তীতে সর্বজনীনভাবেই স্বীকৃত হয়। এছাড়া, ম্যাচ শুরুর ২৪ ঘণ্টা আগে ও অনুশীলনের আগেও খেলোয়াড়দের করোনা পরীক্ষার নিয়ম চালু হয়। স্কোয়াডের অন্তত ১৩ জন খেলোয়াড় সুস্থ থাকলেই ম্যাচ খেলার নিয়মও চালু করে উয়েফা। গোল উদযাপনে সতীর্থকে জড়িয়ে ধরা, হাত মেলানো থেকে শুরু করে খেলোয়াড়দের জার্সি বদলেও নিষেধাজ্ঞা আসে। ধীরে ধীরে সেসব অবশ্য শিথিল হতে শুরু করেছে।
লিভারপুলের ৩০ বছরের অপেক্ষার অবসান
এক সময় ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে লিভারপুলের ধারেকাছে ছিল না কোনো দল। কিন্তু সেই দলটি ১৯৯০ সালের পর শিরোপা জিততেই যেন ভুলে গিয়েছিল! মাঝে দুটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা জিতলেও ঘরোয়া লিগের শিরোপা অধরাই থেকে যায় দলটির। তবে চলতি বছরে তিন দশকের অপেক্ষার অবসান হয়েছে অলরেডসদের। তাও আবার রেকর্ড সাত ম্যাচ হাতে রেখেই। তবে তাদের স্বপ্ন পূরণে বড় ধাক্কা দিতে পারত করোনাভাইরাস! দ্বিতীয় স্থানে থাকা ম্যানচেস্টার সিটির চেয়ে ২৫ পয়েন্টে এগিয়ে থাকার পরও লিগ বাতিলের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ফুটবল ফের মাঠে গড়ালে স্বস্তি ফিরে আসে তাদের। ফেরার পর প্রথম দুই রাউন্ডেই প্রতীক্ষার অবসান ঘটায় ইয়ুর্গেন ক্লপের দল।
ভিন্ন সংস্করণে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ
দ্বিতীয় রাউন্ডের চারটি ম্যাচ বাকি থাকতে এবার স্থগিত হয়ে গিয়েছিল উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের আসর। ফুটবল ফের যখন মাঠে গড়ায়, তখন মৌসুমের নির্ধারিত সময় শেষ। তাই দ্রুত এ আসর শেষ করতে হোম-অ্যাওয়ে পদ্ধতিতে না গিয়ে বিশ্বকাপের আদলে এক লেগে নিরপেক্ষ ভেন্যুতে আয়োজন করা হয় আসরের বাকি অংশ। পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে জৈব-সুরক্ষা বলয়ে এক লেগের কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল দিয়ে শেষ হয় প্রতিযোগিতাটি।
বায়ার্ন মিউনিখের ট্রেবল
লকডাউনের পর মাঠে ফেরার পর থেকেই অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলে বায়ার্ন মিউনিখ। বুন্ডেসলিগার শিরোপা তো জিতে নেয়ই, জিতে নেয় ঘরোয়া আসর ডিএফবি পোকালও। পরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও শিরোপা জিতে নিয়ে সফলতার ষোলোকলা পূর্ণ করে বাভারিয়ানয়া। তাতে বার্সেলোনার পর দ্বিতীয় ক্লাব হিসেবে দুবার ট্রেবল জয়ের বিরল কীর্তি গড়ে হ্যান্সি ফ্লিকের শিষ্যরা।
বায়ার্ন মিউনিখ ৮-২ বার্সেলোনা
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা উৎসবের পথে অবিশ্বাস্য এক কীর্তি গড়ে বায়ার্ন। বিশ্বকাপ আবহের টুর্নামেন্টে কোয়ার্টারের লড়াইয়ে গত ১৪ আগস্ট বার্সেলোনাকে ৮-২ গোলের ব্যবধানে বিধ্বস্ত করে দলটি। পরে প্রথমবার ফাইনালে ওঠা পিএসজিকে হারিয়ে শিরোপা জেতে দলটি। তবে আসরের পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন বার্সার এভাবে বিধ্বস্ত হওয়া ফুটবল ভক্তদের বাড়তি আলোচনার জোগান দেয়।
বার্সার ধস, রিয়ালের শিরোপা পুনরুদ্ধার
চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বায়ার্নের কাছে ধরাশায়ী হওয়ার পাশাপাশি বার্সেলোনা ঘরোয়া লিগেও ব্যর্থতার বৃত্তেই আবদ্ধ থাকে। লকডাউনের আগে শীর্ষে থাকা দলটি ফিরে এসে দুই ম্যাচ পরই হোঁচট খায়। একের পর এক বাজে পারফরম্যান্সে লিগ জয়ের লড়াই থেকেই ছিটকে যায়। অন্যদিকে, লকডাউনের পর অসাধারণ ছন্দে এগিয়ে চলে রিয়াল মাদ্রিদ। ফলে দুই আসর পর ফের লা লিগার শিরোপা পুনরুদ্ধার করে জিনেদিন জিদানের দল।
বুরোফ্যাক্স পাঠিয়ে মেসির বার্সা ছাড়তে চাওয়ার ইচ্ছা
চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ভরাডুবির কিছুদিন পরই বার্সেলোনা ছাড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন লিওনেল মেসি। সাড়া বিশ্বে তোলপাড় তুলে ক্লাবকে একটি বুরোফ্যাক্স পাঠান বার্সা অধিনায়ক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠেননি দল ছাড়তে। ৭০০ মিলিয়ন ইউরো রিলিজ ক্লজের বাধায় আটকে যান তিনি। ১০ দিনের টানাপড়েনের পর মেসি থেকে যান ন্যু ক্যাম্পে। সেসময় মেসিকে ধরে রাখতে তৎকালীন বার্সা প্রেসিডেন্ট জোসেপ মারিয়া বার্তোমেউর পদত্যাগ দাবি করে রাস্তায়ও নামেন সমর্থকরা। পরে অবশ্য বার্তোমেউ পদত্যাগ করেন। তবে এখনও বার্সার সঙ্গে নতুন চুক্তির ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি মেসি। আগামী মৌসুমেই ফুরোচ্ছে দলটির সঙ্গে তার বর্তমান চুক্তির মেয়াদ।
রোনালদোর ১০০
ইতিহাসের মাত্র দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে আন্তর্জাতিক গোলের সেঞ্চুরি পূরণ করেছেন ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো। গত সেপ্টেম্বরে উয়েফা নেশন্স লিগের ম্যাচে সুইডেনকে ২-০ ব্যবধানে হারানোর ম্যাচে পর্তুগালের হয়ে দুটি গোলই করেন তিনি। তাতে সেঞ্চুরি পূরণ করে গোলসংখ্যাকে ১০১-এ উন্নীত করেন জুভেন্টাস ফরোয়ার্ড। তার সামনে কেবল রয়েছেন ইরানের আলী দাই। আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বোচ্চ ১০৯ গোল করেছেন তিনি।
আবার মুখোমুখি মেসি-রোনালদো
২০১৮ সালে রোনালদো যখন রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে জুভেন্টাসে যোগ দেন, তখনই মেসির সঙ্গে তার মুখোমুখি দ্বৈরথ অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। তবে চলতি মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ পর্বের ড্র খুলে দেয় নতুন দুয়ার। আড়াই বছর পর ফের মুখোমুখি হন সময়ের সেরা দুই তারকা ফুটবলার। তাতে অবশ্য জয় হয়েছে রোনালদোর। করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় প্রথম লেগে ছিলেন না তিনি। ফিরতি লেগে তাকে নিয়ে ন্যু ক্যাম্পে এসে ৩-০ গোলের বড় জয় পায় জুভরা। একইসঙ্গে প্রথমবারের মতো এ আসরে বার্সেলোনার বিপক্ষে গোল পান তিনি। সে ম্যাচে দুটি পেনাল্টি থেকে গোল আদায় করে নেন পর্তুগিজ তারকা।
ব্যালন ডি’অর বাতিল, ফিফা দ্য বেস্ট লেভানদভস্কি
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে এ বছর বাতিল করা হয় মর্যাদাপূর্ণ ব্যালন ডি’অর। তবে শুরুতে বাতিলের সিদ্ধান্ত নিলেও পরে ফিফা দ্য বেস্ট পুরস্কার ঠিকই দেয় ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। আর তাতে মেসি ও রোনালদোকে পেছনে ফেলে প্রথমবারের মতো বর্ষসেরা হন বায়ার্নের পোলিশ তারকা রবার্ত লেভানদভস্কি। এর আগে উয়েফার সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ২০১৯-২০ মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলে ৪৭ ম্যাচে ৫৫ গোল করেন ৩২ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড।
কিংবদন্তিদের চিরবিদায়
করোনাভাইরাসের কারণে সবমিলিয়েই বছরটা ভালো যায়নি। তার উপর ফুটবল অঙ্গনে বড় ধাক্কাটা আসে গত ২৫ নভেম্বর। ‘ফুটবল ঈশ্বর’ খ্যাত দিয়েগো ম্যারাডোনা হার্ট অ্যাটাকে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। মাত্র ৬০ বছর বয়সে তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে পুরো পৃথিবীতে। এই শোকের রেশ থাকতে থাকতেই অসীমের পথে পাড়ি জমান ১৯৮২ বিশ্বকাপজয়ী ইতালিয়ান কিংবদন্তি পাওলো রসি। আর্জেন্টিনাকে ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে নিয়ে যাওয়া কোচ ও ম্যারাডোনার সাবেক সতীর্থ আলেসান্দ্রো সাবেয়াও ছাড়েন পৃথিবীর মায়া।
পেলেকে ছাড়িয়ে মেসি
অনেক নাটকীয়তার পর বার্সেলোনায় থেকে যাওয়া মেসি এক ক্লাবের হয়ে সবচেয়ে বেশি গোলের মালিক হয়ে গেছেন। সান্তোসের হয়ে ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলের ৬৪৩ গোলকে ছাড়িয়ে কাতালান ক্লাবটির জার্সিতে ৬৪৪ গোল করেছেন রেকর্ড ছয়বারের ব্যালন ডি’অর জয়ী আর্জেন্টাইন তারকা।
Comments